চট্টগ্রাম: সেলুনে চুল কাটাতে গিয়ে সিরিয়াল ধরার অভিজ্ঞতা কমবেশি সবার রয়েছে। অপেক্ষার এ সময়টায় মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত থাকেন অনেকে।
নগরের চেরাগী পাহাড় আজাদী গলির ‘চেরাগী হেয়ার কাটিং সেলুন’ এর দৃশ্য এমনই। নোয়াখালী থেকে শুরু হওয়া সেলুন পাঠাগার ছড়িয়েছে বেশ কয়েকটি দেশেও।
ওই সেলুনে দেখা মিললো একাধিক বই নিয়ে একটি সেলফ এর। সেখানে রয়েছে বিভিন্ন বিষয়ের একাধিক বই। সেলফের ওপরের অংশে লেখা আছে ‘সেলুন পাঠাগার বিশ্বজুড়ে’। বাংলানিউজের কথা হয় সেলুনের নরসুন্দরদের সঙ্গে। তারা বলেন, এক মাস আগে সেলফটি দেওয়া হয়। সেখানে একাধিক বই রয়েছে। মানুষ সেলুনে এসে বইগুলো নিয়ে পড়ে৷ যারা পড়ে তারা নানা ধরনের প্রশ্ন করে। জানতে চায়- এখানে বইগুলো কিভাবে এসেছে?
সেলুনের নরসুন্দর আকাশ বাংলানিউজকে বলেন, সিরিয়াল অনুযায়ী চুল কাটা হয়। চুল কাটার জন্য অপেক্ষা করতে হয়। তখন মানুষজন বই নিয়ে পড়ে। তবে সেলুনে দৈনিক পত্রিকার পাঠক সংখ্যা অনেক বেশি। যে কাস্টমার একবার বই পড়েছেন, তিনি পুনরায় সেলুনে এলে বই নিয়ে পড়েন। এতে আমাদেরও সুবিধা হয়েছে, পত্রিকা নিয়ে টানাটানি হচ্ছে না।
জানা যায়, কবি গোলাম মাওলা জসিমের ব্যক্তিগত উদ্যোগে ২০১৮ সালের ২০ জুন নোয়াখালী জেলার মাইজদী থানা এলাকায় রতনের সেলুনে বই ও আলমিরা বিতরণের মাধ্যমে ‘অবসরে বই পড়ুন’ শীর্ষক স্লোগান সামনে রেখে যাত্রা করে ‘সেলুন পাঠাগার বিশ্বজুড়ে’ নামের ব্যতিক্রমী উদ্যোগ। দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে বিদেশে বাংলাদেশি কমিউনিটি এলাকার সেলুনে এই ব্যতিক্রমী সেলুন পাঠাগারের কার্যক্রম রয়েছে। প্রতিটি সেলুনে দেওয়া হয় নানান বিষয় বৈচিত্রের ২৫ থেকে ৩০টি বই। বিতর্কিত ও ধর্মীয় কোনও বইয সেখানে রাখা হয় না।
এখানে স্থান পায় বাংলাদেশের কবি, সাহিত্যিক, লেখক ও ঔপন্যাসিকদের এবং জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বই। এছাড়াও সমসাময়িক লেখকের বই রাখা হয়।
উদ্যোক্তা ও সমন্বয়ক গোলাম মাওলা জসিম জানান, সারাদেশে ৫২টি ‘সেলুন পাঠাগার বিশ্বজুড়ে’ রয়েছে। তার মধ্যে চট্টগ্রাম নগরে ১০টি। এছাড়া সন্দ্বীপ, ঢাকা, নোয়াখালী, কুমিল্লা ও ফেনীতে রয়েছে সেলুন পাঠাগার। বাংলাদেশ ছাড়াও বর্তমানে বিশ্বের চারটি দেশে আছে সেলুন পাঠাগার- দক্ষিণ আফ্রিকায় ১টি, নিউইয়র্ক সিটিতে ১টি, সিঙ্গাপুরে ১টি ও ভারতে ৩টি।
নগরের দামপাড়ায় দুলাল হেয়ার কাটিং, নতুন মুনছুরাবাদে পূজা হেয়ার কাটিং, কর্নেল হাটে হাবিব হেয়ার কাটিং, ফয়’স লেক এলাকায় জেন্টস পার্লার, ওয়্যারলেস মোড়ে মেনস্ হেয়ার কাটিং, চেরাগী পাহাড় মোড়ে চেরাগী হেয়ার কাটিং, চকবাজারে ফেন্সি হেয়ার কাটিং, সিডিএ এলাকায় স্বপ্ন হেয়ার কাটিং, হালিশহরে ম্যানজার কাটিং ও মোমিন রোডে কৃষ্ণ হেয়ার কাটিং সেলুনে রয়েছে এই পাঠাগার।
কবি গোলাম মাওলা জসিম বাংলানিউজকে বলেন, বর্তমানে পাঠাগার নামক স্থান ও শব্দটা হারিয়ে যাচ্ছে। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম পাঠাগার নামক যে একটা স্থান ছিল সেটা চিনতে কষ্ট হবে। সেই ভাবনা থেকে ‘সেলুন পাঠাগার বিশ্বজুড়ে’ কার্যক্রম শুরু করেছি। আমার ব্যক্তিগত অর্থে এই কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। যতদিন বেঁচে থাকবো ততদিন এই কার্যক্রম চালিয়ে যাবো।
তিনি আরও বলেন, দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে বইয়ের পাঠক। তাই পাঠবিমুখতা দূর করে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। সেলুনে মানুষ চুল কাটাতে এসে কিছু সময় অবসর পায়। এই সময়ে হাতে একটি বই তুলে দেওয়া হচ্ছে। এ সময়টুকু মানুষ বইয়ের সঙ্গে কাটালে বই পড়ার চর্চা বাড়বে।
বিদেশে সেলুন পাঠাগারের কার্যক্রম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের অনেক পরিচিত আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু বিদেশে থাকে। সেখানে বাংলাদেশি কমিউনিটি এলাকায় সেলুনে সেলফ ও বই দেশ থেকে পাঠানো হয়। আবার পরিচিতদের অর্থ দিয়েছি, তারা নিজেরাই সেলুন পাঠাগার তৈরি করে দিয়েছেন।
সেলুন পাঠাগার বিশ্বজুড়ে’র প্রধান সমন্বয়ক মোশারফ ভূঁইয়া পলাশ বাংলানিউজকে বলেন, বর্তমান প্রজন্ম এখন অতিমাত্রায় অনলাইন নির্ভর হয়ে পড়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের কারণে তরুণ প্রজন্মের যোগাযোগ ও দৈনন্দিন জীবনযাপনের পদ্ধতি বদলে যাচ্ছে। তাই বইয়ের প্রতি আগ্রহ বাড়াতে সেলুন পাঠাগার কর্মসূচি শুরু করা হয়। আমরা মনে করি, এর মাধ্যমে মানুষের মধ্যে বই পড়ার আগ্রহ তৈরি হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১১২০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৪, ২০২২
এমআই/টিসি