চট্টগ্রাম: সন্ধ্যা কাব্যগ্রন্থে কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন-‘বারেবারে যথা কালবৈশাখী ব্যর্থ হল রে পুব-হাওয়ায়/দধীচি-হাড়ের বজ্র-বহ্নি বারেবারে যথা নিভিয়া যায়/কে পাগল সেথা যাস হাঁকি–‘বৈশাখী কালবৈশাখী!’
বৈশাখের প্রথম সপ্তাহেই এই কালবৈশাখীর রুদ্ররূপ দেখলো নগরবাসী। বুধবার (২০ এপ্রিল) সকালে ১০ মিনিটের তাণ্ডবে উড়ে গেছে কারও ঘরের ছাউনি, ভেঙেছে গাছপালা।
বৈশাখ মাসে যে ঝড় তাণ্ডবলীলা চালায় তাকে কালবৈশাখী ঝড় বলা হয়। কেন হয় এ কালবৈশাখী? তার জীবনচক্রকে তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত করা যায় যেগুলো ঊর্ধগামী বা নিম্নগামী বায়ুস্রোতের মাত্রা এবং গতিবিধি দ্বারা নির্ণীত হয়।
কালবৈশাখীর পর্যায়গুলো হচ্ছে: কিউমুলাস বা ঘনীপূঞ্জীভবন পর্যায়, পূর্ণতা পর্যায় ও বিচ্ছুরণ পর্যায়। আবহাওয়াবিদদের মতে, সাধারণত এপ্রিল-মে মাসে সাগরে যে নিন্মচাপ তৈরি হয় তাতে কালবৈশাখী হয় না।
নিম্নচাপ না থাকলে সাগরের আর্দ্র বাতাস স্থলভাগে চলে আসে। সাধারণত তিন ধরনের বাতাস একীভূত হয়ে কালবৈশাখীর সৃষ্টি হয়। সাগরের আর্দ্র বাতাসের সঙ্গে অপেক্ষাকৃত পূবালি বাতাস এবং স্থলভাগের বাতাস একসঙ্গে হলে তা বজ্রমেঘের সৃষ্টি করে। পরে তা চাপ আকারে নিচে নেমে আসে এবং প্রচণ্ড ঝড়ের সৃষ্টি হয়।
কালবৈশাখীকে বায়ুপুঞ্জ বজ্রঝড় অথবা পরিচলনগত বজ্রঝড় নামেও আখ্যায়িত করা যায়। বাংলাদেশে কালবৈশাখী সৃষ্টির প্রধান কারণ হচ্ছে- দেশের দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে আসা উষ্ণ ও আর্দ্র বায়ু যা ঊর্ধ্বে ২ কিলোমিটার পর্যন্ত আরোহন করে থাকে।
এই উষ্ণ ও আর্দ্র বায়ু উত্তর-পশ্চিম এবং পশ্চিম দিক থেকে আসা অপেক্ষাকৃত শীতল ও শুষ্ক বায়ুর সঙ্গে মিলিত হয়। উষ্ণ ও আর্দ্র বায়ু ছোটনাগপুর মালভূমিতে সৃষ্টি হয়ে পূর্বদিকে ধাবিত হয়ে বাংলাদেশের সীমায় উপস্থিত হয়।
বিপরীতধর্মী ও অসম এ দুই বায়ুপ্রবাহের মুখোমুখি হওয়ার ফলে প্রাক-কালবৈশাখীর সৃষ্টি হয়। তবে কালবৈশাখীর স্থায়িত্ব ক্ষণিকের। ঝড় তৈরি হয়ে পূর্ণতা পাওয়ার পর ৩০ থেকে ৪৫ মিনিট পর্যন্ত এর সর্বোচ্চ তীব্রতা থাকতে পারে।
তারপর ধীরে ধীরে তার গতি কমে যায়। তবে সবসময় যে সে একই ছকে চলে, তা বলা যাবে না। কখনও কখনও কালবৈশাখীর শক্তি এক ঘণ্টার বেশি সময় থাকতে পারে। বাতাসের গড় গতিবেগ ঘণ্টায় ৪০ থেকে ৬০ কিলোমিটার। কখনও ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটারের বেশিও হতে পারে।
কালবৈশাখীর সময় অঝোর ধারায় বৃষ্টি হয়। বিদ্যুৎ চমকায়, বজ্রপাত হয়, দ্রুত তাপমাত্রা কমে যায় এবং শিলাবৃষ্টি হয়। ঝড় থেকে সৃষ্ট বজ্রবিদ্যুতে মানুষ মারা যায়। বাংলাদেশে এভাবে মৃত্যুর ঘটনা বিশ্বের অন্যান্য দেশের চেয়ে বেশি।
ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয় এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, বজ্রপাতের সময় ঘরে অবস্থান করা এবং ঘন কালো মেঘ দেখা দিলে ঘরের বাহিরে না যাওয়া; অতি জরুরি প্রয়োজনে রাবারের জুতা পড়ে বাইরে বের হতে হবে।
বজ্রপাতের সময় খোলা জায়গা, খোলা মাঠ অথবা উঁচু স্থানে না থাকা, ধানক্ষেত বা খোলা মাঠে থাকলে তাড়াতাড়ি পায়ের আঙ্গুলের ওপর ভর দিয়ে এবং কানে আঙ্গুল দিয়ে মাথা নিচু করে বসে থাকা, যত দ্রুত সম্ভব দালান বা কংক্রিটের ছাউনির নিচে আশ্রয় নিতে হবে।
এছাড়া টিনের চালা যথাসম্ভব এড়িয়ে চলা, উঁচু গাছপালা ও বৈদ্যুতিক খুঁটি ও তার বা ধাতব খুঁটি, মোবাইল টাওয়ার ইত্যাদি, নদী, পুকুর, ডোবা বা জলাশয় থেকে দূরে থাকতে হবে। বজ্রপাতের সময় গাড়ির ভেতর অবস্থান করলে, গাড়ির ধাতব অংশের সঙ্গে শরীরের সংযোগ ঘটানো যাবে না। সম্ভব হলে গাড়িটি নিয়ে কংক্রিটের ছাউনির নিচে আশ্রয় নিতে হবে।
বজ্রপাতের সময় বাড়িতে থাকলে জানালার কাছাকাছি ও বারান্দায় থাকা যাবে না, জানালা বন্ধ রাখতে হবে এবং ঘরের ভেতরে বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম থেকে দূরে থাকতে হবে। মোবাইল, ল্যাপটপ, কম্পিউটার, ল্যান্ডফোন, টিভি, ফ্রিজসহ সব বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহার থেকে বিরত থাকা এবং এগুলো বন্ধ রাখতে হবে।
বজ্রপাতের সময় ধাতব হাতলযুক্ত ছাতা ব্যবহার করা যাবে না। শিশুদের খোলা মাঠে খেলাধুলা থেকে বিরত রাখতে হবে, ছাউনিবিহীন নৌকায় মাছ ধরা যাবে না। বাড়ির ধাতব কল, সিঁড়ির ধাতব রেলিং, পাইপ ইত্যাদি স্পর্শ করা যাবে না।
খোলাস্থানে অনেকে একত্রে থাকাকালীন বজ্রপাত শুরু হলে প্রত্যেকে ৫০ থেকে ১০০ ফুট দূরে দূরে সরে যেতে হবে। কোনো বাড়িতে যদি পর্যাপ্ত নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা না থাকে তাহলে সবাই এক কক্ষে না থেকে আলাদা আলাদা কক্ষে যেতে হবে।
বজ্রপাতে কেউ আহত হলে বৈদ্যুতিক শকে আহতদের মতোই চিকিৎসা করতে হবে। প্রয়োজনে দ্রুত চিকিৎসককে ডাকতে হবে বা হাসপাতালে নিতে হবে। বজ্র আহত ব্যক্তির শ্বাস-প্রশ্বাস ও হৃদস্পন্দন ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৫০০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২০, ২০২২
এসএস/এসি/টিসি