ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১, ০২ মে ২০২৪, ২২ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

ট্রাফিক আইনের দুর্বল প্রয়োগে চট্টগ্রামে সড়ক দুর্ঘটনা

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৪৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ৯, ২০২২
ট্রাফিক আইনের দুর্বল প্রয়োগে চট্টগ্রামে সড়ক দুর্ঘটনা ...

চট্টগ্রাম: সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে তিন বছর আগে চট্টগ্রাম মহানগরীতে দিনের বেলায় সব ধরনের ভারি যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করে সিএমপির ট্রাফিক বিভাগ। এরপর শুরু হয় গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলোতে অভিযান।

 

কিন্তু সপ্তাহ না যেতেই বিশেষ স্টিকার লাগিয়ে রপ্তানি পণ্যবাহী গাড়ি চলাচল করার অনুমতি দেওয়া হয়। এরপর আগের অবস্থান থেকে আরও একটু সরে এসে খাতুনগঞ্জের পণ্যবাহী ট্রাকগুলো চলাচলের অনুমতিও দেওয়া হয়।

ওইসময় অন্য কোনও ভারি যানবাহন চট্টগ্রাম শহরে চলাচল করতে পারবে না বলে জানানো হলেও ট্রাফিক পুলিশ কঠোর হয়নি। এই সুযোগে কাভার্ড ভ্যান, লরি, ডাম্প ট্রাকও বেপরোয়া গতিতে চলছে নগরের বিভিন্ন সড়কে, ঘটছে একের পর এক দুর্ঘটনা।

নগরে ২ লাখের বেশি যানবাহন চলাচল করে। এর মধ্যে ট্রাক এবং কাভার্ড ভ্যান রয়েছে ৩০ হাজারের বেশি। বিশেষ করে বন্দর থেকে পণ্য নিয়ে এসব ট্রাক নগরের সড়ক দিয়ে চট্টগ্রাম-ঢাকা মহাসড়কের দিকে যাতায়াত করে।  

বিআরটিএ সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রামে বাস-মিনিবাসের ১৪টি রুট রয়েছে। এসব রুটে ১ হাজার ১৩৪টি বাস-মিনিবাস চলাচল করছে। এছাড়া ১৬টি হিউম্যান হলারের রুটে ১ হাজার ২৫০টি এবং ১৬টি অটোটেম্পু রুটে ১ হাজার ৬৬২টি গাড়ি চলছে।  

অপরদিকে ফিটনেস সার্টিফিকেট ছাড়াই চট্টগ্রাম বিভাগে ১ লাখ ১৯ হাজার ৫৮৮ যানবাহন চলাচল করছে। এসব যানবাহনের মধ্যে রয়েছে ট্রাক, মিনি ট্রাক, বাস, হিউম্যান হলার, মিনিবাস, টেম্পো, সিএনজি অটোরিকশা, মাইক্রোবাস। এর মধ্যে অটোরিকশা সবচেয়ে বেশি। এছাড়া নগরে লাইসেন্সধারী রিকশার সংখ্যা ৩৫ হাজার। কিন্তু সড়কে চলাচল করে লাখেরও বেশি। অলি-গলিতে চলাচল করছে ২০ হাজারের বেশি রিকশা।

এদিকে গ্রামাঞ্চলের জন্য নিবন্ধিত সিএনজিচালিত অটোরিকশাও শহরে প্রবেশ করছে। নগরের  বাকলিয়া, আরেফিন নগর, হামজারবাগ, বহদ্দারহাট-কালুরঘাট এবং নতুন ব্রিজ থেকে কোতোয়ালী থানার মোড় এলাকায় চলাচল করে এসব যানবাহন।

বিআরটিএর হিসাবে, প্রতিবছরই চট্টগ্রামে মোটরসাইকেল নিবন্ধনের হার বাড়ছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে নিবন্ধনের সংখ্যা ছিল ৯ হাজার ৫৭৩টি। আর এ পর্যন্ত চট্টগ্রামে ১ লাখের বেশি মোটরসাইকেল নিবন্ধন হয়েছে।  

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদন বলছে, সড়ক দুর্ঘটনার প্রায় অর্ধেকই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা। গত বছরে চট্টগ্রাম বিভাগে দুর্ঘটনা হয়েছে ১৬.২৪ শতাংশ ও নিহত হয়েছে ১৭.৭৩ শতাংশ। ভোরে দুর্ঘটনা ঘটেছে ৪.৫১ শতাংশ, সকালে ৩১.৩৫ শতাংশ, দুপুরে ১৮.৭৮ শতাংশ, বিকেলে ২০.৩৩ শতাংশ, সন্ধ্যায় ৬.০৭ শতাংশ এবং রাতে ১৮.৯২ শতাংশ।

সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা গবেষকরা বলেছেন, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনাগুলো মূলত ঘটে বেপরোয়া গতি, ওভারটেকিংয়ের চেষ্টা, বারবার লেন পরিবর্তন, ট্রাফিক আইন না মানা ও চলন্ত অবস্থায় মুঠোফোনে কথা বলার কারণে। হেলমেট ব্যবহার না করা ও নিম্নমানের হেলমেটের কারণে দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা বাড়ছে।

যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য মতে, বেপরোয়া গতি, বিপজ্জনক ওভারটেকিং, রাস্তাঘাটের ত্রুটি, ফিটনেসবিহীন যানবাহন, যাত্রী ও পথচারীদের অসতর্কতা, চালকের অদক্ষতা, চলন্ত অবস্থায় মোবাইল বা হেড ফোন ব্যবহার, মাদক সেবন করে যানবাহন চালানো, রেলক্রসিং ও মহাসড়কে হঠাৎ ফিডার রোড থেকে যানবাহন উঠে আসা, রাস্তায় ফুটপাত না থাকা বা ফুটপাত বেদখলে থাকা, ট্রাফিক আইনের দুর্বল প্রয়োগ দুর্ঘটনার কারণ।  

এছাড়া ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন চালাচ্ছে লাইসেন্সবিহীন চালকরা। নগরের বিভিন্ন সড়কে ১৪-১৫ বছর বয়সী কিশোররাও গাড়ি চালাচ্ছে। হিউম্যান হলার ও টেম্পোতে কমবয়সী চালকের সংখ্যা বেশি। নগরের ৩টি ফ্লাইওভারে ওঠানামার মুখে দুর্ঘটনা বাড়ছে। গত আড়াই বছরে বিভিন্ন দুর্ঘটনায় ৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর সবগুলোই ঘটেছে ভারি যানবাহনের কারণে। এছাড়া ফ্লাইওভার থেকে নামার মুখে পাশের মূল সড়ক সরু হওয়ায় দুর্ঘটনা ঘটছে।

প্রতিনিয়ত প্রাণহানির ঘটনা ঘটলেও একপ্রকার ঘুমিয়ে আছে সড়ক দুর্ঘটনা তদারকির দায়িত্বে বিআরটিএ, ট্রাফিক পুলিশ ও জেলা প্রশাসন। তাদের মধ্যে নেই সমন্বয়ও। বছরের বিভিন্ন সময় হুটহাট অভিযান পরিচালনা করেই দায়িত্ব শেষ করছে তারা। একে অপরের ওপর দায়িত্ব দিয়ে সারছে দায়ও। অন্যদিকে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির পরও দায়ী চালক অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ায় নিজেদের শোধরাচ্ছে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।  

ট্রাফিক সার্জেন্টরা জানান, বড় গাড়ির তুলনায় নগরে ছোট গাড়িগুলো অনিয়ম বেশি করে। তাই সেসব গাড়ির বিরুদ্ধে মামলাও হয় বেশি। অধিকাংশ চালক লেন মেনে গাড়ি চালান না। অনেক সময় অপ্রয়োজনীয়ভাবে লেনও পরিবর্তন করেন। সুযোগ পেলেই ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করার চেষ্টা করেন। উল্টো পথ দিয়ে আসেন। ছোটখাটো দুর্ঘটনা হলে রাস্তার মাঝখানে তর্ক করে যানজট সৃষ্টি করা এখন প্রতিদিনের চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। আইন ভঙ্গের জন্য মামলা বা ব্যবস্থা নেওয়ার সময় তারা নানা রকম তদবিরের চেষ্টা করেন। বড় যানবাহনগুলো পথচারীদের চাপা দেয়, না হয় ছোট গাড়িকে চাপা দেয়। এই বিষয়টা নিয়ন্ত্রণে আনতে ট্রাফিক বিভাগ কাজ করছে।

নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) চট্টগ্রাম মহানগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক শফিক আহমেদ সাজীব বাংলানিউজকে বলেন, অদক্ষ চালকদের জন্য সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ যাচ্ছে মানুষের। স্বজন হারানোর কষ্ট আজীবন বয়ে বেড়াতে হচ্ছে পরিবারকে। সড়ক পরিবহন আইন কার্যকরের ঘোষণা দেওয়া হলেও তা বাস্তবায়ন করা যায়নি। উল্টো মালিক-শ্রমিকদের আইনের ৩৪টি ধারা সংশোধনের প্রস্তাবের মধ্যে ২৯টি আমলে নিয়ে সংশোধনের সুপারিশ করেছে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের গঠিত কমিটিও কিছু নির্দেশনা দিয়েছিল। কিন্তু সেগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও কোনও অগ্রগতি দেখা যায়নি।

সিএমপির ট্রাফিক (উত্তর) বিভাগের উপ-কমিশনার জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘আমরা পথচারীদের ট্রাফিক আইন সম্পর্কে সচেতন করছি, লিফলেট বিতরণ করছি এবং তারা যাতে জেব্রা ক্রসিং দিয়ে রাস্তা পার হয় সে বিষয়ে তাদের সচেতন করছি। ’ 

বাংলাদেশ সময়: ১৫৪৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৯, ২০২২
এসি/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।