ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

হামলার লক্ষ্য যখন মাথা

নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫০২ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৯, ২০২১
হামলার লক্ষ্য যখন মাথা ফাইল ছবি।

চট্টগ্রাম: চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ডা. ওয়াসিম সাজ্জাদ রানার (৫৬তম এমবিবিএস) ওপর গত ২৭ এপ্রিল সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে চমেক পুলিশ ফাঁড়ির সামনে হামলা চালানো হয়। হামলাকারীরা তার কাছে থাকা মোবাইল ও নগদ টাকা ছিনিয়ে নিয়ে মাথায় আঘাত করে।

একইদিন রাত সাড়ে ১১টার দিকে চমেক হাসপাতাল গোল চত্বরের সামনে ইন্টার্ন চিকিৎসক হাবিবুর রহমানের (৫৭তম এমবিবিএস) ওপর সশস্ত্র হামলা চালানো হয়। হামলাকারীরা তার গলায় থাকা স্বর্ণের চেইন, নগদ টাকা ছিনিয়ে নেয়।

তিনিও মাথায় আঘাত পেয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নেন।

গত বছরের ২ মার্চ দুপুর ১টার দিকে মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষের কক্ষের সামনে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে হাতাহাতি হয়। পরে তা সংঘর্ষে রূপ নেয়। ইট ছুড়ে, লাঠি দিয়ে পেটানোয় মাথায় আঘাত পান ৪-৫ জন শিক্ষার্থী।

চমেক ছাত্রাবাসে ২০১১ সালের ১৯ অক্টোবর হামলায় মৃত্যুবরণ করেন বিডিএস ৫১তম ব্যাচ ৩য় বর্ষের শিক্ষার্থী আবিদুর রহমান আবিদ। তার মাথায় ছিল আঘাতের চিহ্ন। নিহতের ভাই মো. জিল্লুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, আবিদকে তারই সহপাঠীরা হকিস্টিক, লাঠি, স্ট্যাম্প ও লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেছিল। মাথার একপাশে থেঁতলে দেওয়া হয়। ছাত্র সংসদের টর্চার সেলে আবিদের ওপর সন্ত্রাসীরা তিন-চার ঘণ্টা নির্যাতন চালায়। ২১ অক্টোবর রাতে আবিদ মারা যায়।

সর্বশেষ দেশব্যাপী আলোচিত চমেক এমবিবিএস দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মাহাদি জে আকিবের আইসিইউতে নিথর পড়ে থাকা ছবিও ‘হাড় নেই, চাপ দেবে না’ প্রমাণ দেয় হামলাকারীদের মূল লক্ষ্য ছিল- মাথায় আঘাত করা।

৩০ অক্টোবর সকালে চমেক ক্যাম্পাসের সামনে রাস্তার ওপর ছাত্রলীগের এক পক্ষের সমর্থকরা হামলা চালায় মাহাদির ওপর। ৫৮তম ব্যাচের শিক্ষার্থী তৌফিকুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, ছোরা, রড ও হকিস্টিক দিয়ে আঘাতের ফলে মাহাদির মাথার হাড় ভেঙ্গে যায়, প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়।

মাহাদির অস্ত্রোপচারের দায়িত্বে থাকা চমেক হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক মাহফুজুল কাদের জানান, মস্তিষ্ক এবং মাথার হাড়ে মারাত্মক আঘাত থাকায় হাড়ের একটা অংশ খুলে তার পেটের চামড়ার নিচে রাখা হয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানে এই পদ্ধতির নাম ‘ডিকম্প্রেসিভ ক্রেনিয়েকটমি’। বৃহস্পতিবার (১৮ নভেম্বর) দুপুরে তাকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়, হাড়হীন খালি অংশে চামড়ার মতো আবরণ তৈরি হয়েছে। পরে মাথার হাড়ের অংশটি প্রতিস্থাপন করা হবে।

জানা গেছে, ১৯৯৩ সালে চমেক ক্যাম্পাসে এক চিকিৎসকসহ তিন খুনের ঘটনা ঘটে। তিনজনেরই ময়নাতদন্তে মাথায় জখম ও ছুরিকাঘাতের চিহ্ন থাকার কথা বলা হয়।  

চমেক হাসপাতাল জরুরি বিভাগে বিভিন্ন সময়ে দায়িত্ব পালনকারী ইমার্জেন্সি মেডিক্যাল অফিসারদের (ইএমও) সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত দুই বছরে চমেক ক্যাম্পাস ও ছাত্রাবাসে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে কমপক্ষে ২০ বার সংঘর্ষে জড়ায় শিক্ষার্থীরা। প্রতিবারই হামলায় আহতদের একাংশ হাসপাতালে আসে হেড ইনজুরি (মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত) নিয়ে।

নিউরোসার্জনদের মতে, মাথায় আঘাত পেলে খুলির ভেতর থাকা মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মস্তিষ্কের আঘাত দুই ধরনের- ফোকাল ও ডিফিউজ। মস্তিষ্কের ক্ষতি প্রাইমারি বা সেকেন্ডারি হয়ে থাকে। সরাসরি মাথায় আঘাতের জন্য যে ক্ষতি হয়, তা প্রাইমারি ইনজুরি। মাথায় আঘাতের পর মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের ফলে পরবর্তী সময়ে মস্তিষ্ক ঝুলে নেমে আসে (হার্নিয়েশন) বা পানি জমে ফুলে যায় (ইডিমা)। এটাকে সেকেন্ডারি ইনজুরি বলে। তীব্রতা অনুসারে মস্তিষ্কে আঘাত সামান্য, মাঝারি ও মারাত্মক হতে পারে। আঘাতে মস্তিষ্কের সম্পূর্ণ অংশ যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে তাকে ‘ডিফিউজ অ্যাক্সোনাল ইনজুরি’ বলে।

চমেক এর সাবেক শিক্ষার্থীরা জানান, সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এখানকার ছাত্ররাজনীতিতেও পরিবর্তন হয়। নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে ছাত্রসংগঠনগুলো বিরোধে জড়ায়। ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালেও চমেক ছাত্র সংসদের কমিটি ছিল ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ছাত্রলীগ পুনরায় সংগঠিত হয়। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসার পর ছাত্রলীগ ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত হয়। ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় পর্যন্ত ছাত্রদল ও শিবির ক্যাম্পাসে আধিপত্য বজায় রাখতে সক্ষম হয়।  

২০০৮ সালের ২৪ নভেম্বর ছাত্রদল ও শিবিরের একক আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টায় সংঘর্ষ হয়। ছাত্রদল ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত হলেও ছাত্রশিবির পার্শ্ববর্তী দুই কলেজের সমর্থকদের সহায়তায় চমেকের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার চেষ্টা চালায়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ২৪ অক্টোবর ছাত্রলীগের সঙ্গে শিবিরের সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষে অংশ নেয় বহিরাগতরা। ছাত্রাবাসের শতাধিক কক্ষে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের পাশাপাশি হামলায় আহত হন অন্তত ২০ জন। আহত ছাত্রদের অধিকাংশই ছিলেন মাথায় জখমপ্রাপ্ত।

চমেক ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ডা. ফাহাদ নাছিফ বলেন, ক্যাম্পাসে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে যে বিরোধ, সেখানে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে বহিরাগতরা। তাদের নৃশংস হামলায় ঝড়ছে রক্ত। থানায় পাল্টাপাল্টি মামলা হলেও কিছুদিন না যেতে এসব মামলা ধামাচাপা পড়ে যায়।

হামলার শিকার হয়েছিলেন এমন দু্ইজন সাবেক শিক্ষার্থী বাংলানিউজকে বলেন, ‘ওরা বহিরাগতদের নিয়ে হামলার সময় মাথায় আঘাত করেছে। হকিস্টিক-লাঠি দিয়ে শরীরের অন্য অংশের চাইতে মাথায় আঘাত করা হয় বেশি। কারণ ওরা জানে, মস্তিষ্কে আঘাত করা হলে জীবন শেষ’।

২০১২ সালের ১৮ নভেম্বর দুপুরে চমেক ছাত্রাবাসে পুলিশ অভিযানে গিয়ে বেশকিছু অস্ত্রশস্ত্র ও চাঁদা আদায়ের বিভিন্ন নথিপত্র উদ্ধার করে। এছাড়া একটি ছাত্র সংগঠনের নামে করা অ্যাকাউন্টে বিপুল পরিমাণ অর্থ লেনদেনের প্রমাণ পাওয়া যায়। ছাত্রাবাসের গেস্ট রুম ও ডাইনিং হলগুলো ক্ষমতাসীন ছাত্রনেতারা টর্চার সেল হিসেবে ব্যবহার করে বলেও পুলিশকে তথ্য দেয় ওই সময় গ্রেফতারকৃতরা। কিন্তু এরপর গত ৯ বছরে চট্টেশ্বরী সড়কের প্রধান ছাত্রাবাস, লুৎফুস সালাম ছাত্রাবাস ও হাফিজুল্লা বসির ছাত্রাবাসে তেমন উল্লেখযোগ্য অভিযান চালাতে পারেনি পুলিশ।  

সাম্প্রতিক সময়ে ছাত্রলীগের দুইপক্ষের নেতাকর্মীদের মধ্যে বার বার সংঘাতের প্রেক্ষিতে চমেকে মিছিল-সমাবেশসহ সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে কলেজ কর্তৃপক্ষ। এ নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও উভয় পক্ষ গত ২৯ অক্টোবর রাতে মারামারিতে জড়ানোয় পুলিশ ঘটনাস্থলেই যায়। এসময় ছাত্রনেতারা পুলিশ সদস্যদের সঙ্গেও তর্কাতর্কিতে লিপ্ত হয়।

ওইসময় ছাত্রাবাসে গিয়ে দেখা যায়, ছাত্রাবাসের সামনে আঙিনায় হকিস্টিক, ভাঙ্গা চেয়ার, বালিশ-বিছানাপত্র, ছেঁড়া বইপত্র-ক্রেস্ট পড়ে আছে। দ্বিতীয় তলায় সাধারণ পাঠকক্ষের ভেতরে বেশকিছু ইটের টুকরা ও লাঠি জমা রাখা হয়েছে।

চমেক এর কয়েকজন সাবেক শিক্ষার্থী বাংলানিউজকে বলেন, ক্যাম্পাসের আশপাশের ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চাঁদাবাজি, হাসপাতালে খাবার সরবরাহকারী সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া এবং ওষুধপত্র হাসপাতাল থেকে বাইরে সরবরাহের ওপর কর্তৃত্ব নেওয়াকে কেন্দ্র করে ছাত্রনেতাদের মধ্যে বার বার বিরোধ হচ্ছে। নেতারা এখানকার ৩০টি প্রাইভেট ক্লিনিক এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ফার্মেসি সহ বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে চাঁদা আদায় করে।

২০১৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে চমেক ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের হাতে মারধরের শিকার হন আলোকচিত্র সাংবাদিক জুয়েল শীল।

সাবেক ছাত্রনেতারা বলছেন, মেডিক্যাল কলেজে পড়ালেখার চাপ অত্যধিক। এর বাইরে সময় দিয়ে রাজনীতি করা কঠিন। যারা রাজনীতি করে, তাদের চাপে সাধারণ শিক্ষার্থীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একবার প্রফ পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ হলে আরেকবার সাপ্লি দেওয়া কিংবা প্রফে বসা কষ্টকর। মস্তিষ্কে আঘাত করার লক্ষ্য নিয়ে দুর্বৃত্তপনার রাজনীতি অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দিচ্ছে।  

বাংলাদেশ সময়: ১৫০০ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৯, ২০২১
এসি/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।