চট্টগ্রাম: মাছ ধরার ট্রলার ও পণ্যবাহী ট্রাকচালকের হাতবদল পদ্ধতিতে চলছে ইয়াবা পাচার। পুলিশ বলছে, এসব ইয়াবা বহনকারীরা ধরা পড়লেও নেপথ্যের কারবারিরা থেকে যাচ্ছে অধরা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ভয়ঙ্কর নেশা ইয়াবার মূল উপাদান মেথামফিটামিন বা এমফিটামিনের যোগান আসে মিয়ানমারের সান স্টেট থেকে। মাদকের রাজধানী হিসেবে পরিচিত সান স্টেট থেকেই এশিয়ার দেশ বাংলাদেশ, ভারত, চীন, লাওস এবং থাইল্যান্ডে এমফিটামিনের যোগান আসে। যার মধ্যে সান স্টেট-মান্দালে হয়ে সাতটি আন্তর্জাতিক রুট দিয়ে বাংলাদেশ আসছে ইয়াবা কিংবা এমফিটামিন। সান স্টেট থেকে ইয়াবা তুয়াঙ্গী-ইয়াঙ্গুন হয়ে নৌপথে সিত্তেই (মিয়ানমার) হয়ে বাংলাদেশের মহেশখালী আসছে। একইভাবে সিত্তেই রুট ব্যবহার করে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা ও বরিশাল উপকূলীয় এলাকায় যায় ইয়াবার চালান।
ইয়াবার অপর রুট হচ্ছে মান্দালে-তুয়াঙ্গী-মাগওয়ে-মিনবু-পাদান-সিত্তেই-মংডু হয়ে টেকনাফ। এছাড়াও বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের পয়েন্ট দিয়ে আসছে ইয়াবা। ছোট ওই সীমান্ত দিয়ে রোহিঙ্গা শিশু ও নারী দিয়েই ইয়াবা পাচার হচ্ছে। টেকনাফ-উখিয়ার বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে দেশে প্রবেশ করছে ইয়াবার বড় বড় চালান। এরমধ্যে নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম, গর্জনবুনিয়া, সেন্টমার্টিন, শাহপরীর দ্বীপ, লেদা, বাহারছড়া, শাপলাপুর, ডেইলপাড়া, বালুখালী, দিয়ে ইয়াবার পাচার হচ্ছে। তবে ইয়াবার রুট হিসেবে এখনও নাফ নদী ব্যবহার হচ্ছে বেশি। এ ছাড়া লোহাগাড়া, সাতকানিয়ার পাশাপাশি দোহাজারী ব্রিজের দুপাশে গড়ে ওঠা বার্মা কলোনি এখনকার ইয়াবা পাচারের ট্রানজিট পয়েন্ট। এছাড়া সর্বশেষ শুক্রবার (১ অক্টোবর) ভোর ৫টায় বান্দরবান পার্বত্য জেলার আলীকদম থানা এলাকা থেকে আনুমানিক ১৫ কোটি টাকা মূল্যের ৪ লাখ ৯৫ হাজার পিস ইয়াবাসহ ২ জন মাদক ব্যবসায়ীকে আটক করেছে র্যাব-৭। এর আগে গত বুধবার ভোররাতে পতেঙ্গা এলাকায় সাগর পথে ইয়াবা পাচারকালে ১২ কোটি টাকা মূল্যের ৩ লাখ ৯৬ হাজার পিস ইয়াবাসহ ১২ জন রোহিঙ্গাসহ ১৪ জন মাদক ব্যবসায়ীকে আটক করেছিল করেছে র্যাব-৭।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ হত্যাকাণ্ডের পর কক্সবাজারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের তৎপরতা বেশি থাকায় তখন ইয়াবা পাচার কমে যায়। তবে সম্প্রতি আবার বাড়ে ইয়াবা মাদক কারবারিদের দৌরাত্ম্য। এখন স্থল ও সাগর পথে রুট পরিবর্তন করে মিয়ানমার থেকে বিভিন্ন কৌশলে সীমান্তের বিভিন্ন পাহাড়ি এবং সাগর পথে চলছে কয়েক হাজার কোটি টাকার ইয়াবা পাচার। নিত্যনতুন কৌশলে ট্রাক, কার্ভাডভ্যান, ইমাম, শিশু, রোগী বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স এমনকি পাচারকারীরা পেটে পায়ুপথেও বহন করে গন্তব্য পৌঁছে দিচ্ছে ইয়াবার চালান।
এদিকে, স্থলপথে পছন্দের রুট নগরের ফিশারিঘাট সংলগ্ন মেরিনার্স সড়ক, বাকলিয়া এলাকার শাহ আমানত সেতু সংযোগ সড়ক এবং সদরঘাট এলাকা। পুলিশ ও র্যাব সদস্যরা নিয়মিতই এসব রুটে অভিযান চালিয়ে বহনকারীসহ ইয়াবা জব্দ করে। এরপরও থামছে না ইয়াবা পাচারকারীদের দৌরাত্ম্য।
নাম অনিচ্ছুক এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, কিছু চালান আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়লেও অধিকাংশই পার হয়ে যায় কৌশলে। মফস্বল শহরে এখন ইয়াবার রমরমা বাণিজ্য। কেননা প্রতিদিন রুট পরিবর্তন হচ্ছে। শিশু ও নারীদের দিয়েই এখন বেশি ইয়াবা বহন করাচ্ছে। চট্টগ্রামের সঙ্গে ভাষাগত কিছু মিল থাকায় রোহিঙ্গারা এই সুযোগ নিচ্ছে। তাদের প্রশ্রয় দিচ্ছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের শতাধিক ‘মাস্টার’। ক্যাম্পগুলোতে রাতে ইয়াবা মজুত করা হয়। এরপর আইনশৃঙ্খলা অবস্থান নিশ্চিত করে ভিন্ন রুটে চালানগুলো পাচার হয়। এই কাজে সবচেয়ে বেশি রোহিঙ্গা নারীরা সক্রিয়। এছাড়া, লোহাগাড়া, সাতকানিয়া, দোহাজারী ব্রিজের দুপাশে গড়ে ওঠা বার্মা কলোনি ট্রানজিট পয়েন্ট ইয়াবা পাচারের। আনোয়ারা বাঁশখালীর স্থানীয় পর্যায়ের কিছু জনপ্রতিনিধি মাদক ব্যবসায়ীদের প্রশ্রয় দেয়। তবে হোতারা অধরায়।
চট্টগ্রাম মেট্টোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) ও সিএমপি’র মুখপাত্র আরাফাতুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, মাদকের বিরুদ্ধে 'জিরো টলারেন্স' নীতিতে আমাদের নিয়মিত অভিযান চলছে। বিশেষ করে ইয়াবার বিরুদ্ধে আমাদের জিরো টলারেন্স। আমাদের নিয়মিত গোয়েন্দা নজরদারি ও সোর্স মাধ্যমে খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের অভিযান চলছে।
নাম অনিচ্ছুক চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দীর্ঘদিন জেলার মাদক নিয়ন্ত্রণে কাজ করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, ইয়াবার বাহক ও পরিবহনে পরিবর্তন এসেছে। বর্তমানে বিপুল পরিমাণ ফিশিং বোট এই কারবারে জড়িত। বিশেষ করে আনোয়ারা, বাঁশখালী এবং মহেশখালীর এসব ট্রলার কক্সবাজার থেকে ইয়াবা বহন করে নগরীর ফিসারীঘাট, ব্রীজঘাট, মাঝিরঘাট ও ১৫ নম্বর ঘাটে খালাস করতে আসে। তবে তারা এসব ইয়াবার মালিক কে জানে না। কমপক্ষে ২০ হাত বদল হয়ে এসব ইয়াবা পৌঁছে নগরী পর্যন্ত।
ইয়াবার নতুন রুটের বিষয়ে র্যাব-৭ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এমএ ইউসুফ বাংলানিউজকে বলেন, সম্প্রতি সময়ে ইয়াবা কারবারীরা আলী কদমে মোরং পাড়া নতুন পথ ব্যবহার করে ইয়াবা মজুদ করছিল। সেখান থেকে ঢাকা ও চট্টগ্রামে ইয়াবা সরবারহ করে থাকে। সমুদ্র পথে মাঝে মাঝে ঝুঁকি মনে করছে। নরমাল রাস্তায় বার বার চেকপোস্টের সম্মুখীন হয়। এ কারণে দুর্গম এলাকা ব্যবহার করতেছে। কখনো পাহাড়ি ও কখনো বাঙালি এবং নিজেদের লোক দিয়ে ইয়াবাগুলো পাচার করে।
বাংলাদেশ সময়: ২০১৩ ঘণ্টা, অক্টোবর, ২০২১
এমআই/টিসি