ঢাকা, শুক্রবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

সেলুন চালিয়ে কাব্যচর্চা, ৯ বইয়ের জনক প্রদীপ প্রোজ্জ্বল

সোহেল সরওয়ার, সিনিয়র ফটো করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১০১ ঘণ্টা, জুন ১১, ২০২১
সেলুন চালিয়ে কাব্যচর্চা, ৯ বইয়ের জনক প্রদীপ প্রোজ্জ্বল প্রদীপ প্রোজ্জ্বল। ছবি: বাংলানিউজ

চট্টগ্রাম: প্রদীপ প্রোজ্জ্বল, জন্ম কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার মালুমঘাট ডোমখালীতে ১৯৮৫ সালের ২ ডিসেম্বর। জীবিকার তাগিদে বেছে নিয়েছেন সেলুনের কাজ।

এর ফাঁকে চলছে সাহিত্যচর্চা। ইতিমধ্যে বাজারে এসেছে তার ৯টি বই।
 

কৈশোরকাল থেকে প্রদীপের লেখালেখি শুরু। চলমান সমাজ-সভ্যতার অবক্ষয়ী চেতনার বিপরীতে আত্নমগ্নতাই তার কবিতার উপজীব্য। ব্যক্তিজীবনে না পাওয়ার বেদনা প্রতিমূর্ত হয়ে উঠেছে তার সৃষ্ট কাব্যকথায়।  

প্রদীপের মেঝ মামা ভানু চন্দ্র শীল সেলুনের কাজ করতেন চকরিয়ার ফাঁসিয়াখালী ক্যান্টনমেন্টে। সেখানকার মালুমঘাট বাজারে একদিন পরিচয় হয় নিত্যানন্দ পালের সঙ্গে। এই নিত্যানন্দ ছিলেন রাঙামাটির বেতবুনিয়া পুলিশ স্পেশাল ট্রেনিং স্কুলের (পিএসটিএস) অধীন চকরিয়ার ডুলাহাজারা উপশাখার প্রশিক্ষক।

১৯৮৩ সাল। পরিবারকে রাজি করানোর পর ভানু চন্দ্র তার বোন প্রমিলা বালাকে বিয়ে দেন পুলিশ কর্মকর্তা সুবেদার নিত্যানন্দ পালের সঙ্গে। সেই সংসারে জন্ম নেন প্রদীপ। এর মধ্যে খোঁজ নিয়ে চলে আসেন নিত্যানন্দের ১ম স্ত্রী শোভা রানী পাল। তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। প্রদীপকে পেয়ে তিনিও খুশি।

পাঁচ বছর পর ১৯৮৮ সালে রাজশাহীতে বদলি হন নিত্যানন্দ পাল। এরপর থেকে আর স্ত্রী-সন্তানের খবর রাখেননি তিনি। ১৯৯৪ সালে প্রমিলা বালাকে আবারও বিয়ে দেওয়া হয় চকরিয়ার যতীন্দ্র মোহন দে’র সঙ্গে। সেই ঘরে জন্ম নেয় এক পুত্র ও দুই কন্যা। এদিকে প্রদীপ বেড়ে ওঠেন দিদি মা ও মামার আশ্রয়ে। পার হন স্কুলের গণ্ডি।  

জীবিকার তাগিদে তিনি এখন বসবাস করেন চট্টগ্রাম শহরে। চকবাজার আতুরার দোকান এলাকায় তার প্রতিষ্ঠান অদ্বৈত হেয়ার ড্রেসার। বিয়ে করেছেন তিনি, সংসারে আছে এক ছেলে ও এক মেয়ে। সংসার-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সামলে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন লেখালেখিতে। তিনি লিখেছেন: 

অপরিহার্য শব্দের কান্নায়-অনাদর আশ্রয়ে
জুলুমের শব্দকাঠি
তাড়া করছে নিভৃতে, সন্ধানে।
একাবৃত্ত করুণাতল অনাগত রাস্তায় অমলিন স্লোগান 
আর পরাস্ত প্রকাশ্য নিঃসঙ্গ আবেদন
নিহিত খুচরা মূল্য করে হৈ উল্লাস মুক্ত রাজপথ
জীবনের মালতী পার্ক একাহীন সরলতার মূর্খ শাসনে।

বড় মা শোভা রানীর সঙ্গে যোগাযোগের সূত্র ধরে প্রদীপ বাবার শেকড় খুঁজে চলেছেন আজও। ২০১৩ সালে মিরসরাইয়ের বড়তাকিয়া ঠাকুর হাট এলাকার সন্ধান পান তিনি। সেখানে ২০০২ সালে তার বাবা মৃত্যুবরণ করেছেন। আছে শ্মশানও। কিন্তু বাবার জন্মপল্লীর সন্ধান মিলেনি। অনেকটা কাছাকাছি এসেও ধরা হলো না জন্মদাতাকে। শুধু জেনেছেন- ঠাকুরদা’র নাম ছিল সুরেন্দ্র পাল, আর ঠাকুরমা ইন্দ্রা দেবি।  

২০০৫ সালে চকরিয়ায় মারা যান প্রদীপের ২য় পিতা যতীন্দ্র মোহন দে। এরপর থেকে দুই মায়ের দেখাশোনা করছেন প্রদীপ। ২০০৮ সালে পৃথিবীর মায়া ছাড়েন তাকে লালন-পালনকারী দিদি মাও। এখন সৎভাইকে নিয়ে সেলুন চালান। পড়ালেখা করছে দুই সৎ বোনও। রাজনীতি সচেতন প্রদীপ সাহিত্য বিশারদ সুহৃদ চট্টগ্রাম এর অর্থ সম্পাদক, মালুমঘাট শ্রীকৃষ্ণ যুব কল্যাণ সনাতনী সংঘের সহসভাপতি সহ বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত।

চট্টগ্রামের স্পন্দন প্রকাশন থেকে প্রদীপ প্রোজ্জ্বলের ১ম কাব্যগ্রন্থ ‘দুরন্ত পথ’ প্রকাশিত হয় ২০১৪ সালে। এরপর ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে ‘অগ্নিবেদীতে তাকিয়ে রই’ প্রকাশিত হয় তরুমন প্রকাশনী থেকে। গলুই প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয় উপন্যাস ‘বৃত্তের আবর্তে’ ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশ হয় ‘নিশ্চয়ই দাঁড়াবে’। এছাড়া শিশুকিশোর গল্পগ্রন্থ ‘গল্প-কথায় ছড়া’ প্রকাশিত হয় ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে এবং গল্পগ্রন্থ ‘জন্ম জন্মান্তর’ বাজারে আসে ২০১৯ সালের আগস্ট মাসে। ২০১৯ সালের মে মাসে ‘পরিত্যক্ত নগর’ এবং ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ‘খুঁৎ’ ও নভেম্বর মাসে প্রকাশিত হয় ‘অন্বিত অর্ধাঙ্গ’।

প্রদীপ প্রোজ্জ্বল এখনো হাল ছাড়েননি, বাবার পরিবারের পরিজনের সন্ধান পেতে তিনি মরিয়া। কথাপ্রসঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজনের সাহায্যও চান। প্রমাণ হিসেবে আছে, বড় মায়ের কাছ থেকে পাওয়া বাবার পেনশনের বই। তাই কখনও বেতবুনিয়া, কখনও ডুলাহাজারা কিংবা রাজশাহী, কখনও বিভাগীয় হিসাব নিয়ন্ত্রক (ডিসিএ) এর কার্যালয়ে তার ছুটে চলা।

প্রদীপ প্রোজ্জ্বল বাংলানিউজকে বলেন, এই জীবনকে বাস্তবতার কাছে হারিয়ে সমর্পণ করে দিয়েছি সাহিত্যের মাঝে। বাবার মুখ দেখা হয়নি, মাকে আগলে রেখেছি নিজের বুকে। মা, ভাই-বোন, স্ত্রী-সন্তানদের নিয়েই এখন আমার সংসার। লালিত জঠরের বাক্যের বাস্তবায়নে আছি সদা প্রস্তুত। নিজের অভিধান শুধুই আপন পরিমাপে রচিত। নিজের বিপণিবিতান উৎসর্গ করেছি জন্মদাতা-দাত্রীর চরণে।  

বাংলাদেশ সময়: ১১০০ ঘণ্টা, জুন ১১, ২০২১
এসএস/এসি/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।