ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

পাঁচ উপজেলায় নেমে গেছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর, সুপেয় পানির সংকট

নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২০৪ ঘণ্টা, মে ১৬, ২০২১
পাঁচ উপজেলায় নেমে গেছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর, সুপেয় পানির সংকট পানি উঠছে না নলকূপে।

চট্টগ্রাম: মাটির নিচে পানির স্তর ৪ থেকে ১০ মিটার পর্যন্ত নেমে যাওয়ায় চট্টগ্রামের পাঁচ উপজেলায় সুপেয় পানির সংকট দেখা দিয়েছে।

জলবায়ুর পরিবর্তনই এর অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনতে জোর দিচ্ছেন জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা।

এর পরিবর্তে মাটির উপরিভাগের পানি অর্থাৎ পুকুর বা নদীর পানির ব্যবহার বাড়ানোর পরামর্শ তাদের।

বোয়ালখালীতে কয়েক হাজার নলকূপ অকেজো

বোয়ালখালী উপজেলার কধুরখীল, পূর্ব গোমদন্ডী, পশ্চিম গোমদন্ডী, শাকপুরা, সারোয়াতলী, চরণদ্বীপ এলাকার বিভিন্ন গ্রামের কয়েক হাজার নলকূপ অকেজো অবস্থায় পড়ে আছে।

বিকল্প হিসেবে অনেকে সাব-মারসিবল পাম্পের সাহায্যে পানি তুলছেন।

সারোয়াতলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বেলাল হোসেন জানান, নলকূপে উঠছে না পানি। গত ৫ মাস ধরে বিভিন্ন এলাকায় সুপেয় পানির সংকট দেখা দিয়েছে। এতে দুর্ভোগে পড়েছেন এলাকাবাসী।  

বোয়ালখালী পৌরসভার মেয়র আবুল কালাম আবু বলেন, পৌর এলাকার মানুষ পানির সংকটে ভুগছে। কয়েকটি শিল্প প্রতিষ্ঠান গভীর নলকূপ বসিয়ে পানি তোলার কারণে এলাকায় পানির জন্য হাহাকার চলছে।

উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী সুদর্শী দেওয়ান জানান, বোয়ালখালীতে বেশিরভাগ এলাকায় গভীর নলকূপ বসানো হয়েছে। এ বছর ২২৬টি নলকূপ বরাদ্দ এসেছে, এর মধ্যে ২০০টি বসানো হয়েছে।

মিরসরাইয়ে কষ্টে সাড়ে ৩ লাখ মানুষ

মিরসরাইয়ে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় নলকূপে পানি উঠছে না। এতে উপজেলার সাড়ে ৩ লাখ মানুষ কষ্টে আছে। আবার যেসব নলকূপে পানি মিলছে, সেখানে মিলছে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক।  

উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, ১৬টি ইউনিয়ন ও ২টি পৌরসভার বিভিন্ন গ্রামের নলকূপের পানিতে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক এর উপস্থিতি রয়েছে।  ২০০২-০৩ সালে ৭৫ হাজার ৩৬৬টি পরিবারের ৩২ হাজার ৪৮০টি সাধারণ নলকূপ পরীক্ষা করে পানিতে গড়ে ৩৯.৭৭ মাত্রায় আর্সেনিক পাওয়া যায়। এর মধ্যে ১২ হাজার ৮৩৩টি নলকূপের প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলিগ্রামের অধিক মাত্রায় আর্সেনিক পাওয়া গেছে। এসব নলকূপকে লাল রঙ দিয়ে চিহ্নিত করে পানি পান না করতে সতর্ক করা হয়েছে।

জোরারগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মকসুদ আহম্মদ চৌধুরী ও হিঙ্গুলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নাছির উদ্দিন হারুন জানান, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সোনাপাহাড় এলাকার কয়েকটি গ্রামে নলকূপের পানি পাওয়া যাচ্ছে না।

স্থানীয়দের অভিযোগ, মিরসরাইয়ে অপরিকল্পিতভাবে অসংখ্য শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে। এসব কারখানায় ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় বাসা-বাড়ির নলকূপে পানি উঠছে না।

আনোয়ারা উপকূলে বিশুদ্ধ পানির সংকট

আনোয়ারা উপজেলার উপকূলীয় রায়পুর ইউনিয়নেও সুপেয় পানির সংকট দেখা দিয়েছে। সাগরের জোয়ারের পানিতে এখানকার অগভীর নলকূপ ও পুকুরগুলো অধিকাংশই ব্যবহার অযোগ্য হয়ে পড়েছে। আর যেসব নলকূপে পানি পাওয়া যায়, সেগুলোর পানিও লবণাক্ত। ফলে এলাকার মানুষ দূর থেকে পানি এনে সংকট মেটাচ্ছেন।

স্থানীয়রা জানান, বারআউলিয়া, দক্ষিণ গহিরা, পূর্বগহিরা, সরেঙ্গা,  উত্তর পরুয়াপাড়া, দক্ষিণ পরুয়াপাড়া, উত্তর গহিরা ও রায়পুর এলাকায় কিছু অগভীর নলকূপ থাকলেও  জোয়ারের লবণাক্ত পানিতে অধিকাংশই অকেজো।

রায়পুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জানে আলম জানান, সাগরের জোয়ারের পানি প্রবেশ করার কারণে পানির উৎসগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। এখানে সুপেয় পানির সংকট রয়েছে।

হাটহাজারীতেও মিলছে না পানি

হাটহাজারী উপজেলার ১৪টি ইউনিয়ন ও পৌরসভায় সুপেয় পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। নলকূপে পানি পাওয়া যাচ্ছে না। ভরাট হয়ে গেছে অধিকাংশ পুকুর-দীঘি। উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় সরকারিভাবে স্থাপিত গভীর নলকূপের পানি সংগ্রহ করতে মানুষের ভিড় জমছে। নন্দীর হাট এলাকার পেপার মিলে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ফলে বড়দীঘির পাড় থেকে মদনহাট অঞ্চলে পানির জন্য হাহাকার চলছে।

মির্জাপুর ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ড মেম্বার রুপেন কুমার শীল জানান, ওয়ার্ডের বেশিরভাগ নলকূপে পানি উঠছে না।  

পটিয়ায় ৩৫০টি টিউবওয়েল বিকল

আটটি শিল্প প্রতিষ্ঠান ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের কারণে পটিয়ার হাবিলাসদ্বীপ ইউনিয়নের চরকানাই, হুলাইন, পাঁচুরিয়া এবং হাবিলাসদ্বীপ গ্রামে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের স্থাপিত ৩৫০টি টিউবওয়েল বিকল হয়ে পড়েছে। এতে গ্রামগুলোর প্রায় ৩০ হাজার মানুষ সুপেয় পানির তীব্র সংকটে পড়েছেন।

স্থানীয়দের অভিযোগ, যেসব শিল্প প্রতিষ্ঠান ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের কারণে গ্রামগুলোতে এ পানিশূন্যতা- তাদের মধ্যে ছয়টির পরিবেশগত ছাড়পত্র নেই এবং বেশিরভাগই বর্জ্য শোধনাগার প্ল্যান্ট ছাড়া পরিচালিত হচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানের বর্জ্যে বোয়ালখালী ও আলমডাঙা খালের পানি দূষিত হয়ে পড়েছে। গ্রামবাসী সুপেয় পানির পাশাপাশি চাষাবাদের পানিও পাচ্ছে না। পরিবেশ অধিদফতর কয়েকটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করলেও তা থামানো যাচ্ছে না।

গত মার্চ মাসে পটিয়ার হাবিলাসদ্বীপ ইউনিয়নের পাঁচুরিয়া এলাকা থেকে শিল্প কারখানাগুলো অবৈধভাবে পানি উত্তোলনের প্রতিবাদে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন তিন গ্রামের দুই শতাধিক মানুষ।

এর প্রেক্ষিতে সম্প্রতি পটিয়ায় সুপেয় পানি সরবরাহ প্রকল্প উদ্বোধন করা হয়েছে। পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের শের মোহাম্মদ বাড়ি এলাকায় সুপেয় পানি সরবরাহের জন্য নলকূপে কম্প্রেসার সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে এ প্রকল্প উদ্বোধন করেন পৌরসভার মেয়র মো. আইয়ুব বাবুল।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলীরা বলছেন, ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে পানির স্তর নিচে নেমে গিয়ে প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য ক্ষুণ্ন হয়। প্রত্যক্ষভাবে যে সমস্যা সৃষ্টি হয় তা হলো, পানির স্তর ক্রমাগত নেমে যাওয়ার ফলে পানি তোলার ব্যয় বেড়ে যায় এবং পানির প্রাপ্যতা কমে যায়, এমনকি ভূগর্ভস্থ পানিতে দূষণের ঝুঁকিও দেখা দিতে পারে। পাশাপাশি মাটির নিচ থেকে অতিরিক্ত পানি তোলা চলতে থাকলে ভূমিধসের ঝুঁকি বাড়ে।

বাংলাদেশ সময়: ১২০০ ঘণ্টা, মে ১৬, ২০২১
এসি/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।