ঢাকা, মঙ্গলবার, ৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৯ মার্চ ২০২৪, ০৮ রমজান ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

এনজিও কর্মীর সঙ্গে পরকীয়ার জেরে স্ত্রী খুনের পরিকল্পনা বাবুলের

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০৪৮ ঘণ্টা, মে ১৩, ২০২১
এনজিও কর্মীর সঙ্গে পরকীয়ার জেরে স্ত্রী খুনের পরিকল্পনা বাবুলের বাবুল আক্তার

ঢাকা: কক্সবাজারে কর্মরত অবস্থায় জনৈক গায়ত্রী অমর শিং নামে এক এনজিও কর্মীর সঙ্গে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন সাবেক পুলিশ সুপার (এসপি) বাবুল আক্তার। এ নিয়ে পারিবারিক কলহের একপর্যায়ে বাবুল আক্তার নিজেই স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতুকে খুনের পরিকল্পনা করেন।

আর এই পরিকল্পনা থেকেই বাবুলের নির্দেশনা অনুযায়ী নৃশংসভাবে খুন করা হয় মিতুকে।
 
এ ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার তদন্তের ধারাবাহিকতায় বাবুল আক্তারের সম্পৃক্ততা পায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
বহুল আলোচিত মিতু হত্যাকাণ্ডের প্রায় পাঁচ বছর পর বুধবার (১২ মে) চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থানায় বাবুল আক্তারকে প্রধান আসামি করে আরো একটি হত্যা মামলা মামলা দায়ের করেন মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেন। ওই মামলায় বাবুল আক্তারকে পাঁচদিনের রিমান্ডে নিয়েছে পিবিআই।
 
মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, ২০১৩ সালে বাবুল আক্তার কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে কর্মরত থাকাকালীন ইউএনএইচসিআরের এক ফিল্ড অফিসার (প্রটেকশন) গায়ত্রী অমর শিংয়ের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। একপর্যায়ে ওই নারীর সঙ্গে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন বাবুল আক্তার, এর জেরে তার পারিবারিক কলহ সৃষ্টি হয়। পরকীয়ার বিষয়টি মিতু জেনে গেলে এর প্রতিবাদ করায় মিতুকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করতে থাকেন বাবুল।
 
২০১৪ সালের জুলাই থেকে ২০১৫ সালের জুন পর্যন্ত বাবুল আক্তার সুদানে জাতিসংঘ মিশনে কর্মরত ছিলেন। তখন তার মোবাইল রেখে যান বাসায়। গায়ত্রী ওই মোবাইল নম্বরে বিভিন্ন সময়ে ২৯টি মেসেজ পাঠান। মেসেজগুলো মিতু তার ব্যবহৃত একটি খাতায় লিখে রাখেন।
 
হত্যাকাণ্ডের কয়েকমাস আগে বাবুল আক্তার চীনে যান প্রশিক্ষণের জন্য। তখন বাবুল আক্তারকে গায়ত্রীর উপহার দেওয়া ‘তালিবান’ ও ‘বেস্ট কেপ্ট সিক্রেট’ নামে দু’টি বই পান মিতু। তালিবান বইয়ের তৃতীয় পাতায় গায়ত্রীর নিজ হাতে ইংরেজিতে লেখা আছে— 05/10/13, Coxsbazar, Bangladesh. Hope the memory of my offering you this personal gift, shall etarnalize our wonderful bound, love you, Gaitree.
 
একই বইয়ের শেষ পৃষ্ঠা ২৭৬ নম্বরের পরের পাতায় বাবুল আক্তারের নিজের হাতে লেখা আছে গায়ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের কথা। এজাহার অনুযায়ী, ‘First meet: 11 Sept, 2013, First PR in Cox. 07 Oct 2013. G Birth Day, 10 October, First Kissed, 05 Oct 2013; First beach walk: 8th Oct, 2013, 11 Oct 2013, Marmaid with family, 12 Oct 013, Temple Ramu Prayed Together, 13 Oct 2013; Ramu Rubber Garden Chakaria night beach walk.’ এছাড়া ‘বেস্ট কেপ্ট সিক্রেট’ বইটির প্রথম দিকের দ্বিতীয় পাতায় গায়েত্রীর নিজ হাতে ইংরেজিতে লেখা আছে “‘5/10/2013; with my sincere love.’ Yours Gaitree.”
 
মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, কামরুল ইসলাম শিকদার মুসা শুরু থেকেই এ হত্যাকাণ্ডের অন্যতম সন্দেহভাজন। পরে তার সম্পৃক্ততার বিষয়টিও নিশ্চিত হওয়া গেছে। আবার মুসা ছিলেন বাবুল আক্তারের সোর্স। অথচ হত্যাকাণ্ডের পর তদন্তের পর্যায়ে বাবুল আক্তার দাবি করেছিলেন, মুসাকে তিনি চেনেন না। মুসা দীর্ঘদিনের পরিচিত হওয়া স্বত্ত্বেও সুকৌশলে তাকে শনাক্ত না করে জঙ্গিদের দ্বারা হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছে বলে দাবি করে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করেন বাবুল।
 
মিতু খুনে তিন লাখ টাকার লেনদেন
 
পিবিআই সূত্র জানায়, বাবুল আক্তারের পূর্বপরিচিত ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি ও ব্যবসায়িক অংশীদার সাইফুল হক। সাইফুল হক ও গাজী আল মামুন নামে আরেক ব্যক্তি আদালতে জবানবন্দি দেন। জবানবন্দিতে সাইফুল হক জানিয়েছেন, মিতু হত্যার তিন দিন পর তিনি বাবুল আক্তারের নির্দেশে গাজী আল মামুনের মাধ্যমে মো. কামরুল ইসলাম শিকদার মুসাকে তিন লাখ টাকা দেন। গাজী আল মামুন সেই মুসার আত্মীয়। মামুনও জবানবন্দি দিয়ে টাকা দেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন।
 
মূলত এই টাকা লেনদেনের তথ্যপ্রমাণ পাওয়ার পর পিবিআই নিশ্চিত হয়, মিতুকে হত্যার জন্যই এই তিন লাখ টাকার লেনদেন হয়েছে। বাবুল আক্তারের পরিকল্পনায় এটি ছিল একটি কন্ট্রাক্ট কিলিং। বিকাশের মাধ্যমে এই টাকা লেনদেন হয়েছে। বিকাশের লেনদেনের স্লিপও তদন্তকারী কর্মকর্তারা উদ্ধার করেছেন।
 
বুধবার (১২ মে) দুপুরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদার বলেন, মিতু হত্যার ঘটনায় উদ্ধার হওয়া ভিডিও ফুটেজ আমরা একজনকে দেখেছিলাম তার নাম কামরুল ইসলাম মুসা। কিন্তু মুসা এখনো নিখোঁজ। আমরা জেনেছি মুসা নিয়মিত বাবুল আক্তারের বাসায় যাতায়াত করতেন। বাবুলের অনুপস্থিতিতে মুসা ঘরের বাজারও করে দিতেন। ভিডিও ফুটেজ স্পষ্ট এই মুসাকে চেনা গেছে। পরে আমরা তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে নিশ্চিত হয়েছি যে বাবুল আক্তার ইচ্ছাকৃতভাবে তার ব্যক্তিগত সোর্স মুসাকে সন্দেহ করেনি বা সন্দেহজনক বলে পুলিশকে জানায়নি।
 
বনজ কুমার মজুমদার বলেন, মিতু হত্যাকাণ্ডের কিছুদিন আগে জঙ্গি কার্যক্রমে আহত হন বলে দাবি করেন বাবুল। আমরা সেটিই বিশ্বাস করেছি। আবার স্ত্রী মিতু নিহতের পর যে তার আচরণ ছিল, তা ছিল সবচেয়ে আপনজন হারানোর মতো। তাই তার কথা সবাই বিশ্বাস করেছিলেন।
 
২০১৬ সালের ৫ জুন ভোরে চট্টগ্রামের জিইসি মোড়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয় মাহমুদা খানম মিতুকে। এ ঘটনায় ঢাকায় অবস্থান করা মিতুর স্বামী বাবুল আক্তার বাদী হয়ে চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলার অভিযোগে নিজের জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রমের জন্য স্ত্রীকে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে বলে তিনি অভিযোগ করেন।
 
ঘটনার কয়েক দিন পরেই মামলার তদন্তে নতুন মোড় নেয়। একপর্যায়ে আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে বাবুল আক্তারের সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে অভিযোগ করেন তার শ্বশুর মোশাররফ হোসেন। দীর্ঘ তদন্তের ধারাবাহিকতায় মামলার বাদী বাবুল আক্তারই এখন হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দায়েরকৃত আরেক মামলার প্রধান আসামি।
 
বাংলাদেশ সময়: ০০৪৫ ঘণ্টা, মে ১৩, ২০২১
পিএম/আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।