ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

কর্ণফুলী বাঁচাতে বাস্তবায়ন নেই মহাপরিকল্পনার 

সোহেল সরওয়ার, সিনিয়র ফটো করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৫৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১২, ২০২১
কর্ণফুলী বাঁচাতে বাস্তবায়ন নেই মহাপরিকল্পনার  ছবি: বাংলানিউজ

চট্টগ্রাম: দখল-দূষণের কবলে পড়েছে কর্ণফুলী নদী। দুই পাড়ে গড়ে ওঠা কল-কারখানা এবং নগরের ময়লা-আবর্জনা দূষণের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে।

 

কর্ণফুলীতে এখন শুধু বর্জ্যই মিলবে। আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে এই নদী।

দেখা গেছে, নদীতে সরাসরি ফেলা হচ্ছে বর্জ্য। পানি শুকিয়ে পড়ে গেছে চর, দূষণে নিজের সৌন্দর্য হারিয়েছে চিরযৌবনা কর্ণফুলী।

বাংলাদেশ-ভারতের এই আন্তঃসীমান্ত নদীর গড় প্রস্থ ৪৫৩ মিটার এবং এর প্রকৃতি সর্পিলাকার। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কর্তৃক কর্ণফুলী নদীর প্রদত্ত পরিচিতি পূর্ব পাহাড়ি অঞ্চলের নদী নম্বর: ০৩।

ভারতের মিজোরামের মমিত জেলার শৈতা গ্রাম (লুসাই পাহাড়) হতে শুরু হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রামের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চট্টগ্রামের পতেঙ্গার কাছে বঙ্গোপসাগরে মিলিত হয়েছে কর্ণফুলী নদী। এর মোহনাতে দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর চট্টগ্রাম বন্দর অবস্থিত। এই নদীর দৈর্ঘ্য ৩২০ কিলোমিটার। কথিত আছে, আরাকানের এক রাজকন্যা চট্টগ্রামের এক আদিবাসী রাজপুত্রের প্রেমে পড়েন। এক জ্যোৎস্নাস্নাত রাতে তারা এই নদীতে নৌ-ভ্রমণ উপভোগ করছিলেন।  

নদীর পানিতে চাঁদের প্রতিফলন দেখার সময় রাজকন্যার কানে গোঁজা একটি ফুল পানিতে পড়ে যায়। ফুলটি হারিয়ে কাতর রাজকন্যা সেটা উদ্ধারের জন্য পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। কিন্তু প্রবল স্রোতে রাজকন্যা ভেসে যান, তার আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। রাজপুত্র রাজকন্যাকে বাঁচাতে পানিতে লাফ দেন, কিন্তু সফল হননি। রাজকন্যার শোকে রাজপুত্র পানিতে ডুবে আত্মাহুতি দেন। এই করুণ কাহিনী থেকেই নদীটির নাম হয় কর্ণফুলী।

মধ্যযুগীয় পুঁথিতে নদীটিকে কাঁইচা খাল নামে অভিহিত করা হয়েছে। মার্মা আদিবাসীদের কাছে নদীটির নাম কান্সা খিওং এবং মিজোরামে কর্ণফুলীর নাম খাওৎলাং তুইপুই। ১৮৮৩ সালে কর্ণফুলীর মোহনায় সৃষ্টি হয় লুকিয়া চর। ১৮৭৭ সালে সৃষ্টি হয় জুলদিয়া চ্যানেল। এই চ্যানেলটি আড়াই মাইল দীর্ঘ এবং দেড় মাইল প্রশস্ত। ১৯০১ সাল থেকে ১৯১৭ সালের মধ্যে পতেঙ্গা চ্যানেলটি জুলদিয়া চ্যানেল থেকে প্রায় দেড় হাজার ফুট পশ্চিমে সরে যায়। হালদা নদীর সঙ্গে কর্ণফুলীর সংযোগ স্থলে আছে বিশাল চর, যা হালদা চর হিসাবে পরিচিত।

নদীর প্রবাহের কিছু অংশ নাজিরচর ঘেঁষে, কিছু অংশ বালু চ্যানেলের মধ্য দিয়ে এবং কিছু মূল স্রোত হিসেবে প্রবাহিত হচ্ছে। ১৯৩০ সালে কালুরঘাট রেলওয়ে সেতু নির্মাণের আগে নদীর মূল প্রবাহ প্রধানত কুলাগাঁও অভিমুখে বাম তীর ঘেঁষেই প্রবাহিত হতো। কালুরঘাট সেতু হওয়ার পর সেতুর ডান দিকে আরও একটি প্রবাহের মুখ তৈরি হয়। ফলে নদীর মাঝপথে সৃষ্টি হয় বিশাল একটি চর- যা কুলাগাঁও চর নামে পরিচিত।  

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরিন সায়েন্সেস অ্যান্ড ফিশারিজ ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক অহিদুল আলম এক গবেষণায় দেখিয়েছেন, কর্ণফুলী নদীতে পড়া বর্জ্য, জাহাজ থেকে নিঃসরিত তেল ও শিল্প-কারখানার বর্জ্য নিঃসরণের কারণে কর্ণফুলীর পানিতে সালমোনেলা, বিব্রিও, ইকোলাই, স্ট্রেপটোকক্ষাই, স্টেফাইলোকক্ষাইয়ের মতো মারাত্মক ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া বেড়ে গেছে।

কর্ণফুলী নদীর পানিতে ক্ষতিকারক বিব্রিও নামে ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ ৬৭ দশমিক ২৩ শতাংশ। আর সালমোনেল ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ ৩২ দশমিক ৭৭ শতাংশ। এসব ব্যাকটেরিয়ার কারণে নদীর পানি ব্যবহারকারী পরিবারগুলো পানিবাহিত ডায়রিয়া, টাইফয়েড, জন্ডিসসহ নানা ধরনের চর্মরোগে আক্রান্ত হচ্ছে।

কিন্তু বছরের পর বছর দূষণ হলেও পরিবেশ অধিদপ্তরের এ ব্যাপারে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেই। যদিও তারা দাবি করছে, নদী দূষণ রোধে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে, নদী দূষণকারী প্রতিষ্ঠানকে জরিমানাও করা হচ্ছে।

স্থানীয়রা জানান, ট্রাকে করে নদীর আশপাশে খোলা জায়গায় ময়লা ফেলা হচ্ছে। এ ছাড়াও কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পাড়ে গড়ে ওঠা শিল্প-কারখানার বর্জ্যও নদীতে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। কর্ণফুলী উপজেলার একাধিক খালের পানির উপরের অংশে তেলের স্তরও দেখা যায়।

পরিবেশবাদীদের মতে, কর্ণফুলীকে রক্ষায় দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ না নিলে অচিরেই এ নদী তার অস্তিত্ব হারাবে।

কর্ণফুলী নদীর ওপর বাঁধ দিয়ে রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলায় কাপ্তাই বাঁধ তৈরি করা হয় ১৯৬৪ সালে। এই বাঁধে সঞ্চিত পানি ব্যবহার করে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হচ্ছে।

কবি ওহীদুল আলম ১৯৪৬ সালে কর্ণফুলীর মাঝি নামে একটি কাহিনী-কাব্য রচনা করেন। ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, কবি আলাউদ্দিন আল আজাদ ১৯৬২ সালে রচনা করেন তার উপন্যাস কর্ণফুলী। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম  কবিতায় লিখেছেন: ‘ওগো ও কর্ণফুলী, তোমার সলিলে পড়েছিল কবে কার কানফুল খুলি/ তোমার স্রোতের উজান ঠেলিয়া কোন তরুণী, কে জানে/ সাম্পান নায়ে ফিরেছিল তার দয়িতের সন্ধানে। ’

এছাড়াও চট্টগ্রামের ভাষার গানে এবং লোক সংস্কৃতিতে এই নদীর প্রভাব অনেক। ছোড ছোড ঢেউ তুলি পানিত ছোড ছোড ঢেউ তুলি/লুসাই ফা-রত্তুন লামিয়ারে যারগই কর্ণফুলী’। কিংবা ‘ওরে সাম্পানওয়ালা, তুই আমারে করলি দিওয়ানা’।

কর্ণফুলী নদী বাঁচাতে চূড়ান্ত করা ১০ বছরের মহাপরিকল্পনারও বাস্তবায়ন নেই। নগরের বর্জ্য এবং কলকারখানার দূষিত পানি যাতে নদীতে মিশতে না পারে, সে বিষয়েও আছে নির্দেশনা।

এছাড়া অবৈধ দখলে থাকা ভূমি কীভাবে উদ্ধার করা হবে, উদ্ধারকৃত ভূমি কীভাবে সংরক্ষণ করা হবে, এটিকে কাজে লাগিয়ে কীভাবে পর্যটন সুবিধা বাড়ানো যাবে, নগরের বর্জ্য কোথায় কীভাবে বিকল্প স্থানে সংরক্ষণ করা হবে- এসব বিষয়েরও দিকনির্দেশনা আছে এ মহাপরিকল্পনায়।

বাংলাদেশ সময়: ০৯৫০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১২, ২০২১
এসএস/এসি/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।