ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

ভোজন রসিকদের জন্য চট্টগ্রামের সেরা পাঁচ খাবার  

মিজানুর রহমান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৩০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৭, ২০২০
ভোজন রসিকদের জন্য চট্টগ্রামের সেরা পাঁচ খাবার   ছবি: সোহেল সরওয়ার

চট্টগ্রাম: দুই টুকরো শুঁটকির সঙ্গে আলু আর বেগুনের ঝোলে মাখানো চিকন চালের ভাতে আঙুল ডুবিয়ে খাওয়ার সে কি আনন্দ! কেবল শুঁটকি নয়- চট্টগ্রামে এসে অন্তত একবার গরুর মেজবানি মাংস, মুরগীর আস্ত ‘দুরুস’ না খেলে পস্তাতে আপনাকে হবেই! 

শুঁটকি কিংবা মাংস খাওয়ার পরে মহেশখালীর পান যখন মুখে পুরে দেবেন নিজেকে তখন ভোজন রসিকদের প্রথম কাতারেই ভাবতে শুরু করবেন। পড়ন্ত বিকেলে ডাউস সাইজের দুই পিস বেলা বিস্কুট আর সঙ্গে এক কাপ চা- আপনার আড্ডার আনন্দকে বাড়িয়ে দেবে বহুগুণ।

শুঁটকি, মেজবানি মাংস, দুরুস, মহেশখালীর পান এবং বেলা বিস্কুট- চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী খাবারের তালিকায় সবার আগেই থাকে এ পাঁচটি আইটেমের নাম।

শুঁটকি মাছ

শীতকালীন সবজির সঙ্গে ছুরি শুঁটকি, তেল-পেঁয়াজ-মশলা দিয়ে লইট্টা শুঁটকি এবং মরিচ-পেঁয়াজ-সরিষা মেখে ঝাল ঝাল চিংড়ি শুঁটকির ভর্তার কথা বলতেই জিভে জল আসে না এমন ‘চাঁটগাইয়া’ খুঁজে পাওয়া কঠিন।

 

তাই তো ‘গরিবের খাবার’ শুঁটকি এখন জায়গা করে নিয়েছে বিত্তশালীদের ডাইনিং টেবিল, বিয়ের খাবারের মেন্যুতে। অনন্য স্বাদের কারণে শুঁটকি জনপ্রিয়তা পেয়েছে দেশে-বিদেশে। দাম এবং চাহিদাও বেড়েছে কয়েকগুণ।

শুঁটকি ব্যবসায়ী আবদুল করিম বাংলানিউজকে জানান, রুপচাঁদা, লইট্টা, ছুরি, ছোট চিংড়ি, পুঁটি, কাঁচকিসহ ১৭ রকমের মাছের শুঁটকি হয়। তবে ছুরি, লইট্টা এবং চিংড়ি শুঁটকির কদর বেশি। জেলেরা সমুদ্র থেকে মাছ ধরে আনার পর তা রশিতে ঝুলিয়ে কিংবা মাদুরে বিছিয়ে রোদে শুকাতে দেন। বিশেষ প্রক্রিয়ায় রোদে শুকিয়েই রাসায়নিক ছাড়া শুঁটকি তৈরি হয়।  

তিনি বলেন, বৃহত্তর চট্টগ্রামের কক্সবাজার, সোনাদিয়া, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, সেন্টমার্টিন দ্বীপসহ বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী এলাকায় শুকনো মৌসুমে সামুদ্রিক মাছের শুঁটকি করা হয় বেশি। দেশের একমাত্র শুঁটকির আড়ত চট্টগ্রামের আছাদগঞ্জে প্রতি শনিবার বসে শুঁটকির বড় বাজার। এখান থেকেই ব্যবসায়ীরা শুঁটকি কিনে সারাদেশে বিক্রি করেন। রফতানি করেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে।

মেজবানি মাংস

ধোঁয়া ওঠা গরম ভাতের সঙ্গে চনার ডাল, নলার ঝোল আর দেশি গরুর মাংস। ব্যাস! জিভে জল আনার জন্য আর কি লাগে! 

গরুর মাংস সবখানে রান্না হলেও চট্টগ্রামে এর ধরন একটু আলাদা। মসলাও ভিন্ন। শুধু তা-ই নয়, রান্নার পাতিল থেকে শুরু করে চুলা পর্যন্ত সব আলাদা থাকে।

সামাজিক অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে দেওয়া মেজবানে বিশেষ পদ্ধতিতে বাবুর্চিরা এই মাংস রান্না করেন বলে এর নাম হয়েছে মেজবানি মাংস। মাংস রান্নার আলাদা পদ্ধতির কারণেই মেজবানি মাংসের স্বাদ আলাদা। পরিচিতি বিশ্বজুড়ে।

এককালে বাড়ির উঠোনের আয়োজন মেজবানি মাংস এখন শুধু বিয়ে, আকিকা, মৃত্যুবার্ষিকী কিংবা রাজনৈতিক আয়োজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। মেজবানি মাংস চলে এসেছে পাঁচ তারকা হোটেল থেকে শুরু করে নামী-দামি সব রেস্টুরেন্টে।

দুরুস 

চামড়া ছাড়ানো আস্ত মুরগী ঘন ঝোল দিয়ে বিশেষ পদ্ধতিতে রান্না করাকেই চট্টগ্রামের ভাষায় ‘দুরুস কুরা’ বলে। ঝোলের স্বাদ এবং ঘ্রাণের কারণেই দুরুস মুরগী অন্য আইটেমের চেয়ে আলাদা।

জামাই আদর, অতিথি আপ্যায়ন, বিশেষ মেহমানদারিতে চট্টগ্রামে মুরগীর দুরুসের কদর আছে বেশ। অতিথিদের প্রতি সম্মান জানাতে আস্ত মুরগী দিয়ে দুরুস রান্নার প্রথা এই অঞ্চলে চলে আসছে বছরের পর বছর ধরে।

তবে দুরুস এখন আর শুধু আপ্যায়নেই সীমাবদ্ধ নয়। জনপ্রিয়তা বাড়ায় চট্টগ্রামের অভিজাত হোটেলগুলোতেও বাণিজ্যিকভাবে বিক্রি হচ্ছে ‘দুরুস কুরা’। নগরের চট্টমেট্রো, বীর চট্টলা, হাজী বিরিয়ানিসহ বেশ কয়েকটি রেস্টুরেন্টে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকায় দুরুস পাওয়া যায়।

মহেশখালীর পান

চুন, সুপারি, মশলা দিয়ে মহেশখালীর পান মুখে পুরে দিতেই মিষ্টিতে ভরে যায় পুরো মুখ। সিনেমা কিংবা গানে- মহেশখালীর পানের কথা আছে সবখানে। বড় আকার এবং মিষ্টি স্বাদের কারণেই দেশ-বিদেশে খ্যাতি পেয়েছে বৃহত্তর চট্টগ্রামের মহেশখালীর এই পান।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যমতে, মহেশখালীর প্রায় দেড় হাজার হেক্টর জমিতে মিষ্টি পান চাষ হয়। এখানে পানের বরজ সাধারণত দুই ধরনের- পাহাড়ি বরজ এবং বিল বরজ। সব মিলিয়ে প্রায় ১৩ হাজার বরজে পান চাষ হয় মহেশখালীতে।

কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ছাড়াও ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা ও ঢাকায় মহেশখালীর পান সরবরাহ হয়। সৌদি আরব, সিঙ্গাপুর, হংকং, থাইল্যান্ড, আরব আমিরাতসহ বিভিন্ন দেশেও রফতানি হয় মহেশখালীর মিষ্টি পান।  

বেলা বিস্কুট

টিনের ছাউনি দেওয়া কয়েকশ বর্গফুটের একটি দোকান। নাম গণি বেকারি। প্রায় শত বছর আগে চট্টগ্রামের এই বেকারিতেই প্রথম বানানো হয় বেলা বিস্কুট। মচমচে, সুস্বাদু এবং ডাউস সাইজের কারণে অল্পদিনেই জনপ্রিয়তা পায় এই বিস্কুট। চায়ের দোকান থেকে ধনাঢ্যদের ডাইনিং টেবিল- জায়গা করে নেয় সবখানে।

প্রথমে ময়দা, ডালডা, গুঁড়ো দুধ, চিনি, লবণ ও তেল মিশিয়ে তৈরি করা হয় খামির। সঙ্গে দেওয়া হয় বিশেষ ধরনের মাওয়া। মাটির তন্দুরে একদিন রাখার পর প্রথম দফায় দেড়-দুই ঘণ্টা সেঁকা হয়। দ্বিতীয় দফায় আরেকবার সেঁকে তৈরি করা হয় বেলা বিস্কুট। প্রতি পিস বিক্রি হয় সোয়া দুই টাকায়।  

চায়ের সঙ্গে খেতে গণি বেকারির বেলা বিস্কুট শুধু দেশে নয়, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য অস্ট্রেলিয়া, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশেও রফতানি হয় বলে বাংলানিউজকে জানান এর বর্তমান মালিক আবদুল্লাহ এহতেশাম। অনেক প্রবাসীও গণি বেকারি থেকে বেলা বিস্কুট কিনে দেশের বাইরে নিয়ে যায় বলে জানান তিনি।

বাংলাদেশ সময়: ১০১০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৭, ২০২০
এমআর/এসি/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।