ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

রেলওয়ের ১০০ কোটি টাকার জমিতে ওয়াসার প্রকল্প

জমির উদ্দিন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬১২ ঘণ্টা, অক্টোবর ১২, ২০২০
রেলওয়ের ১০০ কোটি টাকার জমিতে ওয়াসার প্রকল্প ছবি: বাংলানিউজ

চট্টগ্রাম: রেলওয়ের ১০০ কোটি টাকা মূল্যের জমি দখল করে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে চট্টগ্রাম ওয়াসা।  

২০১৮ সালে গৃহীত ৩ হাজার কোটি টাকার স্যুয়ারেজ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ অবৈধভাবে রেলওয়ের জমি দখল করেছে বলে রেলওয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

ওই জায়গায় ভবিষ্যতে রেললাইন পুনঃস্থাপন করার পরিকল্পনা রয়েছে রেলওয়ের। তবে ওয়াসার দাবি জায়গাটি তাদের।

জানা গেছে, ২০১৮ সালে ৩ হাজার ৮০৮ কোটি ৫৮ লাখ টাকা ব্যয়ে ৫ বছর মেয়াদি স্যুয়ারেজ প্রকল্প গ্রহণ করে চট্টগ্রাম ওয়াসা। যা ২০২৩ সালের জুন মাসে কাজ শেষ হওয়ার কথা। এই প্রকল্পে সরকার ৩ হাজার ৭৫৮ কোটি ৫৫ লাখ ৭৭ হাজার টাকা এবং ৫০ কোটি টাকা অর্থায়ন করার কথা রয়েছে ওয়াসার।  

মাস্টারপ্ল্যানের সুপারিশ অনুসারে চট্টগ্রাম ওয়াসা ‘চট্টগ্রাম মহানগরীর পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা স্থাপন প্রকল্প (প্রথম পর্যায়)’ শীর্ষক প্রকল্পটি গ্রহণ করে। এ প্রকল্পের আওতায় নগরের হালিশহর এলাকায় প্রতিদিন এক লাখ ঘনমিটার ধারণক্ষমতার পয়ঃশোধনাগার নির্মাণ করা হবে। তবে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বলছে, স্যুয়ারেজ প্রকল্পের কাজে ওয়াসা যে জায়গায় আরসিসি পিলার স্থাপন করছে সেটা রেলওয়ের অধিগ্রহণকৃত জায়গা। অধিগ্রহণ করার পর সেখানে রেললাইনও স্থাপন করা হয়েছিল, যা এখন বিলুপ্ত।

রেলওয়ে সূত্র বলছে, চলতি বছরের মার্চে রেলওয়ের ভূ-সম্পত্তি বিভাগের আমিন কানুনগোরা ফৌজদারহাট-স্টিল মিল সাইডিং লাইনের উত্তর ও মধ্য হালিশহর মৌজার জায়গাটি সরেজমিন পরিদর্শন করতে গিয়ে দেখেন-চট্টগ্রাম ওয়াসা কর্তৃপক্ষ আরসিসি পিলার দ্বারা দেওয়াল নির্মাণের মাধ্যমে রেললাইন বন্ধ করে দিয়েছে।  

১৯৬৫-৬৬ সালে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের এল এ শাখার ৯৯ নম্বর মামলা মূলে উত্তর হালিশহর সিট নম্বর ০৮, জে এল নম্বর ০৯, বিএস দাগ নম্বর ৬৫০১, ৬৫০২ ও ৬৫০৩ খতিয়ান নম্বর ০২ জায়গাটি রেলওয়ে অধিগ্রহণ করে। তবে ওই জমির পাশে চট্টগ্রাম ওয়াসার কিছু নিজস্ব জমিওও রয়েছে। তাদের নিজস্ব জমিতে ওয়াটার ট্রিটমেন্ট এর স্যুয়ারেজ প্রকল্প স্থাপন করার নামে পাশে থাকা রেলওয়ের সাড়ে ৪ একর জমিও ওয়াসা অবৈধভাবে দখল নিয়েছে।  

রেলওয়ের ভূ-সম্পত্তি বিভাগ জানায়, সেখানে বর্তমানে শতকপ্রতি বাজার মূল্য ২০-২৫ লাখ টাকা। ৪০০ শতক বা ৪ একর জমির মূল্য প্রায় একশ কোটি টাকা।  

রেলওয়ের অধিগ্রহণকৃত মোট ৪১ দশমিক ৭৫২ একর ভূমির মধ্যে চট্টগ্রাম ওয়াসা থেকে ৮ দশমিক ৬৫৬ একর ভূমি রেলওয়ের জন্য অধিগ্রহণ করা হয়। সেখানে এসব ভূমির ওপর গ্যাং কোয়ার্টার নির্মাণ এবং রেললাইন স্থাপন করে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করা হয়।  

তৎকালীন পাকিস্তান ইস্টার্ন রেলওয়ের অনুকূলে এল এ কেইস নম্বর ৯৯/৬৫-৬৬ মূলে উত্তর, মধ্য ও দক্ষিণ হালিশহর মৌজার আরএস জরিপ অনুযায়ী উত্তর হালিশহর মৌজায় এলএডিসি/চট্টগ্রাম হতে ৪ দশমিক ১৭৫ একর ও ওয়াসা হতে ০ দশমিক ৪০৪ একর, মধ্য হালিশহর মৌজায় ওয়াসা হতে ৮ দশমিক ২৫২ একর ও এলএডিসি/ চট্টগ্রাম ১১ দশমিক ৫৯৭ একর, দক্ষিণ হালিশহর মৌজায় এলএডিসি/চট্টগ্রাম হতে ১৭ দশমিক ১৯৮ একর এবং এমইএস হতে ০ দশমিক ১২৫ একরসহ মোট ৪১ দশমিক ৭৫২ একর জমি রেলওয়ের নামে অধিগ্রহণ করা হয়।  

এই ভূমির মধ্যে উত্তর ও মধ্য হালিশহর মৌজার বিএস খতিয়ান নম্বর ০২, বিএস দাগ নম্বর ৬৪৫৫, ৬৪৫৬, ৬৫০১, ৬৫০২, ৬৫০৩, ৫৩৩৩, ৫৩৩৪, ৩৯২৫, ৩৫৬১, ৩৯২৬, ৩০১/৩৯৩৫, ৭০৩৮, ৭০৩৯, ৭০৫৫, ৭০৫৬, ৭০৫৭, ৭০৫৮, ২৩৬৫, ২৩৬৭, ১০৯/৯৭৯, ৪২১৭, ৪২১৮, ৪২২০, ৯২৬৬, ৯২৬৭, ৯২৬৮, ৯২৬৯, ৯২৭০, ৯২৭১, ৯২৭২, ৯১৭৩, ৯২৭৪, ৯২৭৫, ৯২৭৬ যা বাংলাদেশ রেলওয়ের নামে খতিয়ানে লিপিবদ্ধ রয়েছে।

এদিকে চট্টগ্রাম ওয়াসার সার্ভেয়ার, কানুনগো ও অ্যাস্টেট কর্মকর্তারা জানান, বিলুপ্ত রেললাইনসহ আশপাশের ভূমি এলএ কেইস নম্বর ২২৫/৬২-৬৩ এর মাধ্যমে ১৬৩ দশমিক ৮৫৫ একর ভূমি চট্টগ্রাম ওয়াসা অধিগ্রহণ করেছে।

রেলওয়ে সূত্র জানায়, ফৌজদারহাট থেকে স্টিল মিল সাইডিং লাইনের উত্তর ও মধ্য হালিশহর মৌজায় বাংলাদেশ রেলওয়ের অধিগ্রহণকৃত ভূমি রয়েছে। যেহেতু রেলভূমিটি রেলওয়ের, তাই প্রয়োজনে ভবিষ্যতে রেললাইন পুনঃস্থাপনে জমিটি প্রয়োজন হবে। তাছাড়া সমুদ্রপথে বিদেশ হতে আমদানিকৃত খাদ্যশস্য, পণ্য ও মালামাল চট্টগ্রাম বন্দর হতে জাহাজে খালাসে আনলোডিং পরবর্তীতে কনটেইনার ও পণ্যবাহী রেলযোগাযোগ সিজিপিওয়াই ইয়ার্ড এর মাধ্যমে সমগ্র বাংলাদেশ এবং পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব ভারতে পরিবহনের আঞ্চলিক এবং উপ-আঞ্চলিক করিডোর হিসেবেও সমধিক খ্যাত ও গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক করিডোর হিসেবেও বর্তমানে বিবেচনা করা হয়।  

এছাড়া পদ্মা, যমুনা ও মেঘনা অয়েল কোম্পানির তেলের ওয়াগন ঈশা খাঁ নৌ-ঘাঁটির মধ্য দিয়ে চলমান রেললাইন ব্যবহার করা হয়। নৌ-ঘাঁটির অভ্যন্তরে রেললাইনের ওপর নৌবাহিনী কর্তৃপক্ষের নিরাপত্তাজনিত কারণে আপত্তি রয়েছে। তাই বিকল্প হিসেবে স্টিলমিল সাইডিং লাইন (আনন্দবাজার) চালুর বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। এ অবস্থায় রেললাইন চালু হওয়ার কথা থাকায় রেলভূমি সুরক্ষার স্বার্থে রেলওয়ের কোয়ার্টারসহ অধিগ্রহণকৃত সম্পত্তির সীমানা অক্ষুণ্ন রাখতে রেলওয়ে ও চট্টগ্রাম ওয়াসার মধ্যে বেশ কয়েকটি চিঠি আদান-প্রদান হলেও রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ অসহায়। চট্টগ্রাম ওয়াসা ক্ষমতার দাপটে অবৈধভাবে জোরপূর্বক রেল ভূমিতে আরসিসি পিলার দিয়ে দেওয়াল নির্মাণকাজ করছে।  

বাংলাদেশ রেলওয়ের চট্টগ্রামের বিভাগীয় ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা মাহবুবুল করিম বাংলানিউজকে বলেন, ওয়াসা ৪ একর জায়গার ওপর তাদের যে প্রকল্প নির্মাণ করছে তা রেলওয়ের। জেলা প্রশাসকের এলএ শাখা থেকে জানিয়েছে, যাদের থেকে অধিগ্রহণ করেছি তাদেরকে রেলওয়ে টাকাও পরিশোধ করেছে। তবুও তারা দাবি করছে, জায়গাটি ওয়াসার।

তিনি বলেন, ১৯৬৫-৬৬ সাল থেকে জায়গাটি রেলওয়ের দেখলে রয়েছে। সেখানে আমাদের মোট ৪১ একর জায়গা রয়েছে। যেহেতু জায়গাটি আমাদের তাই তাদেরকে কাজ বন্ধ রাখতে চিঠিও দিয়েছি। তবুও তারা সেখানে দালান নির্মাণ করছে। আমরা এটিও বলেছি, মন্ত্রণালয় থেকে নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত কাজ আপাতত বন্ধ রাখতে। কিন্তু তারা সেটিও মানেনি।  

রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) সরদার শাহাদাত আলি বাংলানিউজকে বলেন, জায়গাটি আমাদের। এরপরও চট্টগ্রাম ওয়াসা সেখানে জায়গা দখল করে উন্নয়ন প্রকল্প করছে। এ বিষয়ে রেলওয়ের ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তারা তাদের সঙ্গে বসেছেন। আমরা বলেছি, স্থানীয় মন্ত্রণালয়কে এ সমস্যা সমাধানের জন্য আমরাও চিঠি দিবো-আপনারাও দেন। তারা যে সিদ্ধান্ত দেবে সে সিদ্ধান্ত আমরা মেনে নিবো।

‘তারা এ বিষয়ে একমতও হয়েছেন। কিন্তু এরপরও  রেলের জায়গায় দেওয়াল নির্মাণ করছেন। আমাদের নিরাপত্তাবাহিনী গিয়ে বাধাও দিয়েছে। সোমবারও তারা সেখানে কাজ করতে গেছে। এভাবে চলতে থাকলে দুই সংস্থা মুখোমুখি হবে। যেটি ভালো দেখায় না। ’ 

চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী এ কে এম ফজলুল্লাহ বাংলানিউজকে বলেন, রেলওয়ের কোনো জায়গা নেই সেখানে। আমাদের জায়গায় আমরা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছি। রেলওয়ের যে দাবি, সেটি মিথ্যা। এটি আমাদের জায়গা। আমরা রেলওয়েকে ব্যবহার করতে দিয়েছিলাম।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কাজ কেন বন্ধ রাখবো? জায়গাটি যেহেতু আমাদের-তাই সেখানে কাজ চলমান থাকবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৬০৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ১২, ২০২০
জেইউ/এসি/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।