ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

পুলিশ ফাঁড়িতে ধরে নিয়ে টাকা আদায়, আতঙ্কে ব্যবসায়ীরা!

374 | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০১০ ঘণ্টা, জুলাই ১১, ২০২০
পুলিশ ফাঁড়িতে ধরে নিয়ে টাকা আদায়, আতঙ্কে ব্যবসায়ীরা! মধ্যম হালিশহর পুলিশ ফাঁড়ি

চট্টগ্রাম: বন্দর থানাধীন মধ্যম হালিশহর পুলিশ ফাঁড়ি। করোনায় চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ নানা মানবিক কর্মকাণ্ডের কারনে যেখানে প্রশংসিত সেখানে এই পুলিশ ফাঁড়ির সদস্যরা স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে হয়ে উঠেছে আতঙ্কের নাম। মানুষকে সেবা দিয়ে যেখানে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের সুনাম বৃদ্ধি করার কথা সেখানে এই পুলিশ ফাঁড়িই হয়ে উঠেছে মানুষের কাছে অভিশাপের নাম।

স্থানীয় মুদি দোকানদার, হোটেল-রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে বিভিন্ন মানুষ মধ্যম হালিশহর পুলিশ ফাঁড়ির সদস্যদের দ্বারা হয়রানির শিকার বলে অভিযোগ রয়েছে।

এদের কেউ ভয়ে মুখ খুলেন না, আবার কেউ সাহস করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানোর পরেও কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় অনেকটা ভয়ের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন এসব মানুষ।

হয়রানির শিকার হয়ে পুলিশের জরুরি সেবা ৯৯৯ এ কল দিয়েও এক ভুক্তভোগী অভিযোগ জানান। ৯৯৯ থেকে ওই ভুক্তভোগীকে বন্দর জোনের উপ-কমিশনারের মোবাইল নাম্বার দেওয়া হয়।

তার কাছে অভিযোগ জানিয়েও ভুক্তভোগী কোনো সুরাহা পাননি বলে অভিযোগ রয়েছে।

বন্দর থানাধীন মধ্যম হালিশহর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. নাছিরের নেতৃত্বে সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) মোরশেদ, এএসআই আনোয়ার ও এএসআই মুশফিকুর এসব অপকর্মের সঙ্গে জড়িত বলে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।  

তাদের সঙ্গে হেলাল নামে এক দালালও কাজ করে। হেলালের কাজ এলাকায় ঘুরে ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করা ও টার্গেট চিহ্নিত করা। পরে টার্গেট করা ব্যবসায়ীকে পুলিশ ফাঁড়িতে ধরে এনে আদায় করা হয় টাকা।  

টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে ভুয়া বাদি সাজিয়ে ওই লোকদের নামে থানায় অভিযোগ দেওয়া হয়। পরে ধরে এনে নির্যাতন করা হয়। এছাড়া নারীদের দিয়েও মামলার ভয় দেখিয়ে আদায় করা হয় টাকা।  

গত এক মাসে এ পুলিশ ফাঁড়িতে এরকম অন্তত ১০টির মতো ঘটনা ঘটেছে বলে দাবি করেছেন স্থানীয়রা। সিএমপিতে কর্মরত সাবেক এক উপ-কমিশনারের পরিচিত একজনের কাছ থেকেও ফাঁড়িতে দুইদিন আটকে রেখে টাকা আদায় করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।  

সম্প্রতি মো. রফিক নামে এক হোটেল ব্যবসায়ীকে ধরে এনে নারী নির্যাতন মামলায় ফাঁসানোর ভয় দেখানো হয়। তাকে দুই দিন ধরে থানায় আটকে রেখে ৪০ হাজার টাকা আদায় করে ছেড়ে দেওয়া হয় বলে বাংলানিউজের কাছে দাবি করেন ওই ভুক্তভোগী।  

মো. রফিক বাংলানিউজকে বলেন, আমাকে এসআই নাছির ফাঁড়িতে ধরে নিয়ে যান। কী কারনে আমাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তা জানতে চাইলে মারধর করেন। পরে ফাঁড়িতে নিয়ে আমাকে বলেন, আমি নাকি কোনো এক মহিলাকে নির্যাতন করেছি। তখন শপথ করি। আকুতি মিনতি করি। পরে ওই নারীকে আমার সামনে হাজির করতে বললে তারা এক নারীকে নিয়ে আসে। অথচ আমি ওই নারীকে কখনও দেখিনি।  

তিনি বলেন, পরে আমাকে বলা হয়-এটা মিমাংসা করতে হলে দেড় লাখ টাকা দিতে হবে। তখন আমি বলি- আমি কোনো অন্যায় করিনি, কেন টাকা দিব। তখন আমাকে ভয় দেখায় এসআই নাছির। পরে আমার কাছে এক লাখ টাকা দাবি করেন তারা। আমি দিতে পারবো না বলো সাফ জানিয়ে দিই। সবশেষ ৪০ হাজার টাকা দিলে আমাকে ছেড়ে দিবে বলে। মারধরের ভয়ে আমি ৪০ হাজার টাকা দিয়ে ফাঁড়ি থেকে বের হয়ে আসি।  ছাড়ার সময় আমার কাছ থেকে খালি স্ট্যাম্পে স্বাক্ষরও নেন তারা।

ওই নারীকে দালাল হেলাল নিয়ে আসে। সাংবাদিক পরিচয় দেওয়া এক লোকও তাদের সঙ্গে ছিল। সাংবাদিক পরিচয় দেওয়া ওই লোক ওই নারীর ভাই পরিচয় দেয়। যোগ করেন তিনি।  

মো. রফিক বলেন, ফাঁড়ি থেকে ছাড়া পেয়ে আমার এক আত্মীয়ের মাধ্যমে ওই নারীর কাছে আমাকে চিনেন কী না জানতে চাইলে তিনি আমাকে চিনেন না বলে জানান। ওই নারী জানান, তাকে ভয় লাগিয়ে ওখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বিনিময়ে তিনি কিছু টাকা পেয়েছেন।  

রেজাউল নামে আরেক ভুক্তভোগী বাংলানিউজকে বলেন, গত ১৫ দিন আমাকে আমাকে এএসআই মোরশেদ ও মুশফিকুর ধরে নিয়ে যান। আমার কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা নিয়ে ছেড়ে দেন। ৮ জুলাই জসিম ও নাসির নামে দুই মুদি দোকানদারকে ফাঁড়িতে ধরে নিয়ে ২০ হাজার টাকা আদায় করেন তারা।

শনিবার (১১ জুলাই) মধ্যম হালিশহর পুলিশ ফাঁড়ির আওতাধীন সল্টগোলা ক্রসিং থেকে ইশান মিস্ত্রিরহাট, টেকের মোড় এলাকার স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলেও নানা অভিযোগ পাওয়া গেছে মধ্যম হালিশহর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই মো. নাছিরসহ অন্য সদস্যদের বিরুদ্ধে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মধ্যম হালিশহর পুলিশ ফাঁড়ি সংলগ্ন এক দোকানদার বাংলানিউজকে বলেন, প্রতিদিন বিকেলে ফাঁড়িতে লোকজনকে নিয়ে আসা হয়। তাদের ছাড়িয়ে নিতে বাইরে স্বজনরা জড়ো হন। এখানে কিছু দালাল আছে তাদের মাধ্যমে মিমাংসা করা হয়। অনেক ব্যবসায়ী আতঙ্কে রয়েছে। ব্যবসা করতে হবে তাই সবাই চুপচাপ সহ্য করে।

তিনি বলেন, তাদের বিরুদ্ধে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে অভিযোগ দিয়েও লাভ হয় না। তারা ম্যানেজ করে ফেলে সব। তাই আমরা মানিয়ে চলি।

মধ্যম হালিশহর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই মো. নাছিরের বিরুদ্ধে পুলিশ সদর দফতরেও চাঁদাবাজির অভিযোগ দিয়েছেন মো. বাদশা তালুকদার নামে এক ব্যক্তি।

মো. বাদশা তালুকদার নামে ওই ব্যক্তি এসআই মো. নাছিরের বিরুদ্ধে অবৈধ টমটম, ইজিবাইক থেকে মাসোহারা আদায়ের অভিযোগ করেন।

জানতে চাইলে মধ্যম হালিশহর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই মো. নাছির অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ফাঁড়িতে কাউকে নিয়ে আসা হয় না। এরকম কোনো বিষয় থাকলে আমার সিনিয়র স্যারদের সঙ্গে কথা বলেন।

এসআই মো. নাছির ফাঁড়িতে কাউকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়না এমন দাবি করলেও ফাড়িতে কর্মরত এএসআই মোরশেদ বাংলানিউজকে বলেন, ৮ জুলাই জসিম ও নাসির নামে দুই মুদি দোকানদারকে ফাঁড়িতে নিয়ে আসা হয়।

তবে সন্ধ্যার পরেও দোকান খুলে রাখার অভিযোগে তাদের ফাঁড়িতে আনা হয় বলে দাবি করেন এএসআই মোরশেদ।

এসআই নাছির গত ১০ মাস আগে মধ্যম হালিশহর পুলিশ ফাঁড়িতে ইনচার্জ হিসেবে যোগ দেন। তিন মাসের মাথায় তার বিরুদ্ধে স্থানীয়রা বিক্ষোভ করে বলে জানা যায়।

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের বন্দর জোনের সাবেক উপ-কমিশনার হামিদুল আলম দায়িত্ব পালনকালে এসআই মো. নাছিরের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ আসে বলে জানা যায়।

তবে স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধির আশির্বাদ থাকার কারনে এসআই নাছিরের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেননি তৎকালীন উপ-কমিশনার।

উপ-কমিশনার হামিদুল আলম বন্দর জোন থেকে বদলী হওয়ার একদিন আগে এসআই নাছিরকে ফের মধ্যম হালিশহর পুলিশ ফাঁড়িতে ইনচার্জ হিসেবে দায়িত্ব দেন (পুনঃবদলী)।

উপ-কমিশনার হামিদুল আলম বাংলানিউজকে বলেন, আমি অনেকদিন দায়িত্বে ছিলাম। এরকম কোনো কিছু আমার মনে নেই।

সিএমপির উপ-কমিশনার (বন্দর) মো. কামরুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, আমি নতুন দায়িত্ব নিয়েছি। এরকম কোনো অভিযোগ নজরে আসলে ব্যবস্থা নিব। ভুক্তভোগীরা আমার কাছে অভিযোগ জানাতে পারেন। আমি বিষয়টি খোঁজ নিচ্ছি।

বাংলাদেশ সময়: ২০০৪ ঘণ্টা, জুলাই ১১, ২০২০
এসকে/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।