ঢাকা, শুক্রবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

করোনাকালে নীরব যোদ্ধা নেসার

নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১১১ ঘণ্টা, জুন ৪, ২০২০
করোনাকালে নীরব যোদ্ধা নেসার নীরব যোদ্ধা সাইফুল ইসলাম নেসার

চট্টগ্রাম: ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে জীবনের অন্তিম মুহূর্তে অক্সিজেন পায়নি তার বাবা। পাশে দাঁড়িয়ে তাঁর কষ্ট পাওয়ায় দৃশ্য দেখা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না। ওয়ার্ডের চারিদিকে ছুটোছুটি করেও লাভ হয়নি।

অজ্ঞাত রোগীর বন্ধু হিসেবে পরিচিত ফেনীর ছাগলনাইয়ার সাইফুল ইসলাম নেসার জানিয়েছেন এই কষ্টের কথা।

দুটি কিডনি অকেজো হয়ে ২০০৭ সালে নেসারের বাবা মারা যান।

তিনি তখন ফেনী পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটে ১ম বর্ষের ছাত্র। ভাইদের সামান্য বেতনের টাকা দিয়ে ওষুধ কিনতে হতো বাবার জন্য।
সেই কষ্ট এখনও বয়ে বেড়াচ্ছেন নেসার। পোর্টল্যান্ড গ্রুপের টেকনিক্যাল অফিসার হিসেবে কর্মরত নেসার পেয়েছেন মানবসেবার স্বীকৃতিও।

তিনি বলেন, একজন ডাক্তার অক্সিজেন সিলিন্ডার সংগ্রহের জন্য অনেক অনেক চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু পাননি। চোখ বড় বড় করে বাবার দীর্ঘশ্বাস নেওয়ার যে কষ্ট, তা  এখনও আমার চোখে ভাসে। অক্সিজেন সঠিক সময়ে পেলে বাবা হয়তো বেঁচে যেতেন।

বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে অজ্ঞাত রোগীদের সেবা দিতে শুরু করেন নেসার। ইতোমধ্যে নানান সেবামূলক কাজ করে গণমাধ্যমে আলোচিত হয়েছেন তিনি।

করোনাকালেও থেমে নেই সাইফুল ইসলাম নেসারের মানবসেবা। নীরব যোদ্ধা হিসেবে তিনি দাঁড়াচ্ছেন সবার পাশে। চট্টগ্রামে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, ফিল্ড হাসপাতাল, রেলওয়ে হাসপাতাল ও হলিক্রিসেন্ট হাসপাতালে করোনার চিকিৎসায় প্রতিবন্ধকতা দূর করতে সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।

কোথাও নেই পর্যাপ্ত আইসিইউ ও ভেন্টিলেটর সাপোর্ট, কোথাও ডাক্তার-নার্সদের নেই পর্যাপ্ত পিপিই-মাস্ক-গ্লাভস, গগলস, অক্সিমিটার, বিপি মেশিনসহ অনেক কিছুই। এই কঠিন পরিস্থিতিতে বিত্তশালীদের দ্বারস্থ হয়ে সেসব উপকরণ সংগ্রহ করে পৌঁছে দিচ্ছেন নেসার। করোনা থেকে সুস্থ হওয়া ব্যক্তির প্লাজমা চেয়ে জানাচ্ছেন আবেদন। অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস সংক্রান্ত তথ্য জানিয়ে দিচ্ছেন রোগীর অভিভাবকদের।

জানা গেছে, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের ল্যাবে করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষা চলছে। ল্যাবটিতে একটনের একটি এসি ছিল। কিন্তু ল্যাবের রুমকে ২০ ডিগ্রি তাপমাত্রার মধ্যে রাখতে ও নমুনা ঠিক রাখতে আরেকটি এসির দরকার ছিল। ল্যাবে কর্মরত জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিশেষজ্ঞ ডা. শুভ দাশের মাধ্যমে জানতে পেরে পরিচিত এক বড় ভাইকে বিষয়টি অবহিত করেন নেসার। তার সহায়তায় দুই টনের একটি এসি এনে দেন তিনি।

পাশাপাশি চমেক হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডের জন্য ৩টি অক্সিজেন সিলিন্ডার, ৩০ জন নার্সের জন এন-৯৫ মাস্ক, ডিজিটাল প্রেশার মেশিন ও জীবাণুনাশক স্প্রে দেওয়া হয় নেসারের উদ্যোগে।

চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডে স্যাম্পল সংগ্রহের জন্য আসা রোগীদের চিৎকার করে ডাকতে হতো। ভিড়ের মধ্যে  অনেকে তা শুনতো না। এতে রোগী ও ডাক্তার-নার্সদের সমস্যা হতো। এ সমস্যা দেখে নেসার একজন দানশীল ব্যক্তির সহায়তায় সেখানে সাউন্ড সিস্টেম প্রদান করেন।

নেসারের প্রচেষ্টায় চট্টগ্রাম ফিল্ড হাসপাতালে হ্যান্ড গ্লাভস, পিপিই, এন-৯৫ মাস্ক প্রদান করা হয়েছে। চট্টগ্রাম রেলওয়ে হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য অক্সিজেন সিলিন্ডার, জীবাণুনাশক স্প্রে মেশিন ডাক্তার-নার্সদের জন্য এন-৯৫ মাস্ক, ডিজিটাল প্রেশার মেশিন, ফেস শিল্ড, অক্সিমিটার দেওয়া হয়েছে। হলি ক্রিসেন্টে হাসপাতালেও করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য দেওয়া হয়েছে মেডিক্যাল সামগ্রী। তবে নেসারকে এসব সামগ্রী দিয়ে যারা সহযোগিতা করছেন, তাদের নাম প্রকাশ করতে চাননি তিনি।

সাইফুল ইসলাম নেসার বাংলানিউজকে বলেন, করোনায় আমি-আপনি যে কেউ আক্রান্ত হতে পারি। যিনি এই ভাইরাসে আক্রান্ত, তাকে অবহেলার চোখে দেখাটা অমানবিক। অনেকে করোনা আক্রান্ত হলে অথবা মারা গেলে গোপন রাখার চেষ্টা করছেন। কিন্তু তিনি তো অপরাধী নন। করোনা আক্রান্ত হওয়া ব্যক্তি পরিবারকে জানালে আশপাশের সবাই সচেতন হবেন। তাদের খোঁজখবর নেওয়া আমাদের সামাজিক দায়িত্ব।

তিনি বলেন, করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসায় চট্টগ্রামের যেসব হাসপাতাল ব্যবহৃত হচ্ছে, সেখানে অনেক প্রতিবন্ধকতাও রয়েছে। সমাজের দানশীল ব্যক্তিদের সহায়তা নিয়ে আমি বাহক হিসেবে এসব প্রতিবন্ধকতা দূর করার জন্য যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছি।

বাংলাদেশ সময়: ১১০০ ঘণ্টা, জুন ০৪, ২০২০
এসি/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।