ঢাকা, শনিবার, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

সিদ্ধান্ত ও একাগ্রতাই ছিলো মূল শক্তি: সাঈদ আল নোমান

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩২৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ২, ২০২০
সিদ্ধান্ত ও একাগ্রতাই ছিলো মূল শক্তি: সাঈদ আল নোমান ইডিইউ’র প্রতিষ্ঠাতা ভাইস চেয়ারম্যান সাঈদ আল নোমান।

চট্টগ্রাম: কভিড-১৯ এর সংক্রমণ ঠেকাতে সরকারের নির্দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থী আগমন বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এ ঘোষণার প্রেক্ষিতে অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয় কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ করে দেয় এবং বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বিনা পরীক্ষায় মিডটার্মের ফলাফলের ভিত্তিতে ফাইনালের রেজাল্ট দিয়ে সেমিস্টার শেষ করার সিদ্ধান্ত নেয়।

কিন্তু একমাত্র ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটি (ইডিইউ) বন্ধ ঘোষণার পরবর্তী কার্যদিবস থেকেই লাইভ ব্রডকাস্টিংয়ে ক্লাস পরিচালনা শুরু করে। এতো অল্প সময়ের মধ্যে কিভাবে এই প্রস্তুতি ইডিইউ নিতে পেরেছে, তা জানতে বাংলানিউজের সঙ্গে কথা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ভাইস চেয়ারম্যান সাঈদ আল নোমানের।

সাঈদ আল নোমান বলেন, এ প্রস্তুতি হঠাৎ করে নেওয়া কোনো বিচ্ছিন্ন উদ্যোগ নয়। শুরু থেকে ই-লার্নিং ও ডিজিটাল প্লাটফর্মের শক্তিকে কাজে লাগানোর যে ভিশন আমাদের ছিলো, আজকের বাস্তবতা তারই ফসল।

আমাদের অভিজ্ঞতা ছিলো, প্রযুক্তি ছিলো, আর ছিলো উদ্যম। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিলো সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও একাগ্রতা। এ কারণেই আমরা পেরেছি। সঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে উৎসাহ প্রদানের জন্য ধন্যবাদ জানাতেই হয়।

তিনি বলেন, ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই অনলাইন সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার ব্যাপারে সচেষ্ট ছিলো। যার ফলশ্রুতিতে এক যুগ আগেই ব্ল্যাকবক্স নামের একটি ভার্চুয়াল প্লাটফর্মকে যুক্ত করা হয়। এটি একটি স্টুডেন্ট ইনফরমেশন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি, ট্রান্সক্রিপ্ট, অ্যাসাইনমেন্ট- এ সবকিছু অনলাইনে নিয়ে আসা হয়। ফলে শিক্ষার্থীরাও তাদের একাডেমিক তথ্য যেকোনো সময় জেনে নিতে পারছেন।

ইডিইউতে ভার্চুয়াল ক্লাস। ‘এরপর ২০১৪-১৫ সালের হরতাল-অবরোধ ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় যখন শিক্ষার্থীদের ক্লাসে নিয়মিত যোগ দেওয়া দুরূহ হয়ে উঠেছিলো, তখনই অনলাইনে ক্লাস কার্যক্রম পরিচালনার উদ্যোগ নেওয়া হয়। আগে থেকে লেকচারগুলো রেকর্ড করে ওয়েবসাইটে দেওয়া হতো। তারই প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রতিটি কোর্সের সিলেবাসে ৬ ঘণ্টার অনলাইন টিচিং কম্পোনেন্ট পরীক্ষামূলকভাবে অন্তর্ভুক্ত করি। এই বিশেষ ব্যবস্থাকে ‘কোর্সওয়্যার’ নামকরণ করা হয়’।

তিনি বলেন, এভাবেই আমাদের ডিজিটাল যাত্রা শুরু। আমরা এই চর্চাটা ধরে রেখেছিলাম। বিভিন্ন কালচারাল, সাইকোলজিক্যাল, টেকনিক্যাল এবং রেগুলেটরি সীমাবদ্ধতার কারণে ই-লার্নিং এর ব্যাপক বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরেই ধাপে ধাপে আমরা অগ্রসর হয়েছি। বর্তমান প্রেক্ষাপটে লাইভ, অনলাইন ভিডিও ব্রডকাস্টিংয়ের মাধ্যমে ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটির প্রত্যেক শিক্ষার্থী (যা ৩৫ জনের ঊর্ধ্বে নয়) তার বাসা কিংবা স্বীয় অবস্থান থেকে নিজ নিজ ক্লাসে অংশগ্রহণ করছে। এই ব্যবস্থায় শিক্ষকসহ সকল শিক্ষার্থী যেমন একে-অপরকে দেখতে পারছে, কথা বলতে পারছে, উপরন্তু ‘Real Time Data File’ আদান প্রদান করতে পারছে।

করোনাভাইরাসের মহামারীর এ সময়ে নতুন করে প্রস্তুতি নিতে হয়েছে কিনা-এমন প্রশ্নে সাঈদ আল নোমান বলেন, কিছু প্রস্তুতি নিশ্চয়ই নিতে হয়েছে। ফেব্রুয়ারি জুড়ে বিশ্ব পরিস্থিতি দেখে আমরা বুঝতে পারছিলাম যেকোনো সময় বাংলাদেশ এই মহামারীতে আক্রান্ত হতে পারে এবং লকডাউনের মতো সিদ্ধান্ত আসাও অস্বাভাবিক নয়। সেক্ষেত্রে আমাদের করণীয় কী হবে তা নিয়ে আমরা আলোচনা করি। ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটি পরিবারের সকলকে কভিড-১৯ থেকে নিরাপদ রাখার প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদানের লক্ষ্যে অনলাইন ভিডিও কনফারেন্সে ক্লাস নেওয়ার সিদ্ধান্তে একমত হই।

‘আমাদের চিন্তা ছিলো শিক্ষার্থীরা ঘরে বসেই যাতে তাদের একাডেমিক কার্যক্রমে অংশ নিতে পারে। প্রথমত, আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি ক্লাসরুমকে ভার্চুয়াল ক্লাসরুমে পরিণত করি, সর্বাধুনিক প্রযুক্তির সন্নিবেশ ঘটিয়ে এই ভার্চুয়াল লার্নিং রিয়েলিটির ব্যবস্থা করেছি, যাতে শিক্ষার্থীরা পরিচিত পরিবেশের অনুভূতিটাই পায় এবং যে ক্লাস যে কক্ষে হওয়ার কথা তাতেই নেওয়া হয়, যাতে ক্লাসরুম সংকটে নিয়মিত রুটিনের কোনো ব্যত্যয় না ঘটে’ যোগ করেন তিনি।

ইডিইউ অ্যাকাডেমিক ভবন। সাঈদ আল নোমান বলেন, ১৬ মার্চ সরকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণা দিলে এর পরবর্তী কার্যদিবস ১৮ মার্চই আমরা পুরোদমে ভার্চুয়াল ক্লাসে শিফট করি, যা বাংলাদেশে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বলে আমাদের সাধুবাদ জানিয়েছেন অনেকেই। এর মধ্যেই কয়েকজন ফ্যাকাল্টি মেম্বার পরীক্ষামূলকভাবে নিজের বাসায় থেকে ক্লাস পরিচালনা করে দেখেন, যাতে আমরা বুঝতে পারি এ ধরনের পরিস্থিতি ভবিষ্যতে এলে আমাদের করণীয় কী হতে পারে। একইসঙ্গে আমরা কর্মরত ফ্যাকাল্টি ও অ্যাডমিন মেম্বারদের মধ্যে একটি জরিপও চালাই, যার উদ্দেশ্য ছিলো আনুষঙ্গিক ডিভাইসের প্রয়োজনীয়তা কার আছে তা খুঁজে বের করা।

‘কালবিলম্ব না করেই তা ক্রয় করি এবং সার্বিকভাবে বলতে গেলে, কভিড-১৯ এর কারণে আমাদের ক্লাস কার্যক্রম একদিনের জন্যেও বন্ধ হয়নি। আমরা চাইনি শিক্ষার্থীদের একাডেমিক জীবনে কোনো গ্যাপ সৃষ্টি হোক এবং পরীক্ষা ছাড়াই সেমিস্টার শেষ হোক, বরং চেয়েছি সকলকে নিরাপদে রেখে জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। জীবন থেমে থাকে না, এবং গত হওয়া সময় ফিরে পাওয়া যায় না। কিন্তু না পড়িয়ে সেমিস্টার শেষ করার অথবা অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রেখে পরবর্তী কোনো সময়ে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরামর্শ আমাদের কাছে আসতে থাকে বিভিন্ন জায়গা থেকে। শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে লাইভ ব্রডকাস্টিংয়ের মাধ্যমে ক্লাস কার্যক্রম চালিয়ে যাবার সিদ্ধান্তে আমরা অনড় ছিলাম। এখন অন্যান্য সকল প্রতিষ্ঠানও কিন্তু হোম-অফিস ও অনলাইন ক্লাসের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে প্রস্তুতি নিচ্ছে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে ক্লাস পরিচালনার। এইক্ষেত্রে পথপ্রদর্শক হিসেবে ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটি সর্বমহলে প্রশংসিত হয়েছে’।

কি কি প্রযুক্তির সহায়তা নেওয়া হয়েছে- জানতে চাইলে সাঈদ আল নোমান বলেন, অ্যাকাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য পৃথিবীতে বহুলভাবে স্বীকৃত ও ব্যবহৃত কিছু প্ল্যাটফর্ম আছে। যেমন: জুম, গুগল ক্লাসরুম, জি-সুইট, মাইক্রোসফট টিম ইত্যাদি। এগুলোর পাশাপাশি স্কিল ডেভলপমেন্টের জন্য বিশ্বখ্যাত অনলাইনভিত্তিক প্ল্যাটফর্ম ‘Coursera’ এর সঙ্গে ইডিইউ চুক্তিবদ্ধ হয়েছে, যাতে নিজেকে সমৃদ্ধ করতে বহুমাত্রিক ও আন্তর্জাতিক কোর্সে বিনা-খরচে রেজিস্ট্রেশন করতে পারে শিক্ষার্থীরা। গত বছর ইডিইউর ঝুলিতে যুক্ত হয় বিশ্বব্যাপী সমাদৃত অনলাইন প্লেজারিজম ডিটেকশন সফটওয়্যার ‘Turnitin’। এর মাধ্যমে যাবতীয় অ্যাসাইনমেন্ট ও গবেষণাপত্র নিজ নিজ সুপারভাইজারের কাছে জমা দেয় শিক্ষার্থীরা।

তিনি বলেন, আমাদের দেশের জন্য এটি একটি নতুন বাস্তবতা। ই-লার্নিং ইকোসিস্টেম এখনও স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, ফলে নানা চড়াই-উতরাই পার করতে হচ্ছে। কিন্তু প্রচেষ্টা থাকলে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বর্তমান অভিজ্ঞতাকে আরো কিভাবে উন্নত করা যায়, নতুন কি কি ফিচার যুক্ত করা যায়, সেসব নিয়ে আমাদের আইটি অ্যান্ড ইনোভেশন্স টিম কাজ করছে। আমরা আরো উন্নততর ডিজিটাল ইকোসিস্টেমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু শিক্ষার্থীদের ই-লার্নিং অভিজ্ঞতাকে সফল করতে হলে দেশের সামগ্রিক অবকাঠামো উন্নত করতে হবে। বিশেষত, দ্রুতগতির ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং উপযুক্ত যন্ত্রাদি (কম্পিউটার, ল্যাপটপ, উন্নত স্মার্টফোন) প্রয়োজন। যেহেতু আমাদের জনসংখ্যার মূল অংশ বিত্তবান নয়, তাই এসব সুবিধা সকলের আয় ক্ষমতার ভেতরে নিয়ে আসা জরুরি। সরকারের প্রতিশ্রুত ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়ন ত্বরাণ্বিত করতে শিক্ষার সঙ্গে সম্পর্কিত এই বিষয়গুলোতে আরো জোর দেওয়া উচিত।

বাংলাদেশ সময়: ১৩০০ ঘণ্টা, এপ্রিল ০২, ২০২০
এসি/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।