খাঁচা থেকে মাছগুলো বের করে রাখা হয় বড় বড় হিমাগারে। সেখানে তিন-চার দিন রাখার পর প্রতিদিন সকালে মাছগুলো বের করা হয়।
এর মধ্যে একদল শ্রমিক মাছের বর্জ্য অংশ ফেলে দেন। আরেকদল লবণ মাখিয়ে রোদে শুকানোর জন্য মাচায় রাখেন।
প্রতি কেজি রুপচাঁদার পাইকারি দাম ২ হাজার টাকা। এ ছাড়া ছুরি ৫০০ টাকা, লইট্যা ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা, ফাইস্যা শুঁটকি ১০০ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি হয়।
কালা মিয়া স্টোরের কালা মিয়া জানান, অনেক বিদেশি ব্যবসায়ী রুপচাঁদা, লইট্যা ও ছুরি মাছের শুঁটকি আগে থেকে অর্ডার করে রাখেন। এছাড়া স্থানীয় ব্যবসায়ীরাও এখান থেকে পাইকারি দরে মাছ কিনে নিয়ে যান। শুঁটকি তৈরিতে কোনো প্রকারের রাসায়নিক মেশানো হয় না। একদম বিষমুক্ত শুঁটকি তৈরি করা হয়।
শ্রমিকদের যেন ঈদের মৌসুম
শুঁটকিপল্লির মাছ কাটার কাজে নিয়োজিত মো. নুরন্নবি চৌধুরী, শেখ আহমেদ, আয়েশা খাতুন বাংলানিউজকে জানান, বর্ষাকালে তাদের হাত গুটিয়ে বসে থাকতে হয়। প্রায় চার মাস তারা কোনো কাজ করতে পারেন না। কারণ ওই সময়ে শুঁটকি তৈরির কাজ বন্ধ থাকে। তখন তাদের অনাহারে-অর্ধাহারে থাকতে হয়। অক্টোবর থেকে তাদের টাকা আয়ের মৌসুম শুরু হয়। এ জন্য ছেলে-মেয়ে নিয়ে শুঁটকি পল্লিতে কাজ করেন তারা।
কর্ণফুলীর আছিয়া মোতালেব রেজিয়া নাসরিন উচ্চ বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র সিয়াম হোসেন। প্রতিদিন ভোর ৫টায় ঘুম থেকে ওঠে দুই ঘণ্টা পড়াশুনা করেই মায়ের সঙ্গে বের হয় সে। ইছানগরের শুঁটকি পল্লিতে তিন ঘণ্টা মাছ শুকানোর কাজ করে স্কুলে চলে যায় সিয়াম। আর স্কুল বন্ধের দিনগুলোতে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত কাজ চলে তার।
শুধু সিয়াম নয়, চরপাতা হাইস্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র সজিব হোসেন, লিপা মনি, আরিফ হোসেন ও সৈকতরাও পড়ালেখার পাশাপাশি শুঁটকি পল্লিতে কাজ করছে। এখান থেকে প্রতিদিন আয় তাদের ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। যা দিয়ে পড়ালেখার খরচ মেটায় তারা।
কর্ণফুলীর ইছানগরে এখন চলছে পুরোদমে শুঁটকি তৈরির উৎসব। শীত শুরুর সঙ্গে সঙ্গে শুঁটকি তৈরির তোড়জোড় শুরু হয় এখানে। বাঁশের মাচা বানিয়ে পুরোদমে চলে মাছ শুকানোর কাজ। এখানে ৭টি শুঁটকির মহালে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে তারা। শুঁটকি মহল ঘুরে দেখা গেছে সেখানে কাজ করা বেশিরভাগই শিশু। যাদের বয়স ৮ থেকে ১৪ বছর পর্যন্ত। আবার এদের পাঁচজনে চারজনই স্কুলে ভর্তি আছে।
মহাল মালিকরা জানান, ছুরি মাছ, ছোট চান্দা মাছ, ট্যাংরা মাছ, বাসপাতি, চাপিলা মাছ, ফাইস্যা, হাঙর, পোয়া ও লইট্টা কাঁচা মাছ শুকানো হয় এখানে। শুকানোর প্রক্রিয়াকরণে কয়েকটি ছাড়া বেশিরভাগ কাজে শিশুদের কাজে লাগানো হয়। যেমন- মাচায় মাছ তোলা, মাছ শুকানো, শুকানোর পর শুঁটকি মাছগুলো প্যাকেট করা শিশুদের দিয়ে সহজে করানো যায়। তবে বোট থেকে বড় বড় খাঁচা করে কাঁচা মাছ নিয়ে আসা ও মাছ কাটার ক্ষেত্রে বড়দের কাজে লাগানো হয়।
এছাড়া একজন ১০ থেকে ১৪ বছরের শিশুকে ২৫০-৩০০ টাকার মধ্যে কাজ করানো যায়। কিন্তু বড়দের বেতন দিতে হয় ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা। আয়ের ভারসাম্য রক্ষা করতে তাই শিশুদের কাজে লাগান বলে জানান মহাল মালিকরা।
ছোট চান্দা মাছ শুকানোর কাজে ব্যস্ত অষ্টম শ্রেণির ছাত্র সজিব হোসেন। এখন স্কুল বন্ধ হওয়ায় সকাল ৯টায় মাছ শুকাতে চলে এসেছে সে। সজিব জানায়, স্কুল খোলা থাকলে সকাল ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত আর স্কুলের বন্ধের দিনগুলোতে বিকেল ৫টা পর্যন্ত কাজ করে সে। তিন ঘণ্টা কাজ করলে ১০০ টাকা আর পুরোদিন কাজ করলে ২৫০ টাকা বেতন পায় সে। ওই টাকায় সে পড়ালেখার খরচ জোগায়।
জসিম স্টোরের শুঁটকি ব্যবসায়ী জসিম উদ্দিন বাংলানিউজকে জানান, একেকটি মহাল থেকে প্রতি দুই সপ্তাহে সাড়ে ২৪ টন শুঁটকি তৈরি হয়। এখানে ৭ শুঁটকি মহালে ২১০ শ্রমিক কাজ করেন। নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত চলে শুঁটকি উৎপাদন। তবে বর্ষাকালে কয়েকমাস শুঁটকি তৈরির কাজ বন্ধ থাকে।
তিনি জানান, তার শুঁটকি মহাল থেকে প্রতি তিন দিন পরপর ছুরি, লইট্যা, ফাইস্যা, রুপচাঁদা শুঁটকি মাছ ৪ থেকে ৫ টন সরবরাহ দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ সময়: ০৯২৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১০, ২০১৯
জেইউ/টিসি