ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

‘না জেনেই’ হিযবুত তাহরীরের ফাঁদে পা!

সরওয়ার কামাল, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১২৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৬, ২০১৯
‘না জেনেই’ হিযবুত তাহরীরের ফাঁদে পা! গ্রেফতার হিযবুত তাহরীরের সদস্যরা। ফাইল ছবি

চট্টগ্রাম: চলতি বছরের মে মাসে নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন হিযবুত তাহরীর উলাই’য়াহ বাংলাদেশে যোগ দেন মোহাম্মদ আজিমুল হুদা (২৪)। একটি মসজিদে ইফতার মাহফিলে পরিচয়ের সূত্র ধরে হিযুবত তাহরীরের নেতা তাহমিদ সুফিয়ানের মাধ্যমে এ সংগঠনে যুক্ত হন। শুরুতে তাকে ‘ইসলামিক কথাবার্তার’ মাধ্যমে মোটিভেট করা হয়। যখন সংগঠনে যুক্ত হন তখনও তিনি হিযবুত তাহরীর সম্পর্কে কিছু জানতেন না। যুক্ত হওয়ার পর জানতে পারলেও তিনি আর সংগঠন থেকে বের হতে পারেননি। না জেনেই হিযবুত তাহরীরের ফাঁদে পা দেন বলে দাবি করেন তিনি।

হিযবুত তাহরীরের সদস্য আজিমুল হুদাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। বৃহস্পতিবার (৫ ডিসেম্বর) বিকেলে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন আজিমুল হুদা।

আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতেও এসব তথ্য জানিয়েছে বলে আদালত সূত্রে জানা গেছে।

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) সিনিয়র সহকারী কমিশনার (প্রসিকিউশন) কাজী শাহাবুদ্দীন আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার জাহানের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন আজিমুল হুদা।

জবানবন্দি গ্রহণ শেষে তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত।

আজিমুল হুদা ছাড়াও হিযবুত তাহরীরের আরও দুই সদস্য মোহাম্মদ নাজমুল হুদা (২৭) ও মো. ইমতিয়াজ ইসমাইলকে (২৫) কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন আদালত। বৃহস্পতিবার তিন দিনের রিমান্ড শেষে তাদের আদালতে উপস্থাপন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শক (এসআই) রাছিব খান।

হিযবুত তাহরীরের সদস্য মোহাম্মদ নাজমুল হুদা আজিমুল হুদার বড় ভাই। ছোট ভাই আজিমুল হুদার মাধ্যমে তিনি হিযবুত তাহরীরে যোগ দেন বলে জানা গেছে।

মামলার সুপারভাইজিং কর্মকর্তা কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মো. মঈনুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, হিযবুত তাহরীরের সদস্য আজিমুল হুদা, নাজমুল হুদা ও ইমতিয়াজ ইসমাইলকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে বেশ কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। সেগুলো আমরা যাচাই-বাছাই করছি।

পুলিশ সূত্রে জানা যায়, জিজ্ঞাসাবাদে আজিমুল হুদা জানিয়েছেন- চলতি বছরের মে মাসে নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন হিযবুত তাহরীর উলাই’য়াহ বাংলাদেশে যোগ দেন তিনি। একটি মসজিদে ইফতার মাহফিলে পরিচয়ের সূত্র ধরে হিযুবত তাহরীরের নেতা তাহমিদ সুফিয়ানের মাধ্যমে এ সংগঠনে যুক্ত হন। শুরুতে তাকে ‘ইসলামিক কথাবার্তার’ মাধ্যমে মোটিভেট করা হয়। যখন সংগঠনে যুক্ত হন তখনও তিনি হিযবুত তাহরীর সম্পর্কে কিছু জানতেন না। যুক্ত হওয়ার পর জানতে পারলেও তিনি আর সংগঠন থেকে বের হতে পারেননি। সংগঠনে তিনি সদস্য সংগ্রহের কাজ করতেন। না জেনেই হিযবুত তাহরীরের ফাঁদে পা দেন বলে দাবি করেন তিনি।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শক (এসআই) রাছিব খান বাংলানিউজকে বলেন, তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আদালতে উপস্থাপন করা হয়েছে। আদালত তাদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন। পর্যায়ক্রমে অন্যদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

গত ২২ নভেম্বর নগরের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১৫ জনকে আটক করে পুলিশ। তাদের কাছ থেকে সংগঠনের ২ লাখ ৮২ হাজার টাকা, হিযবুত তাহরীরের তথ্যসহ দুইটি ল্যাপটপ ও ডিভাইস, একটি মোটর সাইকেল, হিযবুত তাহরীরের প্রচারপত্র, গঠনতন্ত্র, ট্রেনিং ম্যানুয়েল উদ্ধার করা হয়।

আটক ব্যক্তিরা হলেন- হিযবুত তাহরীরের আঞ্চলিক প্রধান আবুল মোহাম্মদ এরশাদুল আলম (৩৯), আব্দুল্লাহ আল মাহফুজ (৩০), মো. ইমতিয়াজ ইসমাইল (২৫), মো. নাছির উদ্দিন চৌধুরী (২২), মোহাম্মদ নাজমুল হুদা (২৭), মো. লোকমান গনি (২৯), মো. করিম (২৭), আব্দুল্লাহ আল মুনিম (২২), কামরুল হাসান প্রকাশ রানা (২০), মো. আরিফুল ইসলাম (২০), মো. আজিম উদ্দিন (৩১), ফারহান বিন ফরিদ প্রকাশ রাফি (২৩), মো. আজিমুল হুদা (২৪), ওয়ালিদ ইবনে নাজিম (১৫) ও মো. সম্রাট (২২)।

এদের মধ্যে হিযবুত তাহরীরের আঞ্চলিক প্রধান আবুল মোহাম্মদ এরশাদুল আলম চট্টগ্রামের একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুল ও কলেজের শিক্ষক। আবুল মোহাম্মদ এরশাদুল আলম বাঁশখালী উপজেলার কালিপুর ইউনিয়নের গুনাগরী এলাকার আবুল কাশেমের ছেলে। তিনি বায়েজিদ চক্রেসো কানন আবাসিক এলাকায় বসবাস করতেন।

পুলিশ জানিয়েছে- আব্দুল্লাহ আল মাহফুজ সাতকানিয়া উপজেলার চর খাগরিয়া এলাকার নজরুল ইসলামের ছেলে। তিনি নোভারটিস ফার্মাসিটিক্যালস এর চট্টগ্রাম টেরিটোরি ম্যানেজার। মো. নাছির উদ্দিন চৌধুরী ফাহিম ট্রাভেলস নামে একটি প্রতিষ্ঠানের সাবেক কর্মকর্তা। মোহাম্মদ নাজমুল হুদা ড্যাফোডিল ইনস্টিটিউট থেকে ডিপ্লোমা পাস করা সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। মো. লোকমান গনি মহসিন কলেজের মাস্টার্সের ছাত্র। মো. আরিফুল ইসলাম চট্টগ্রাম সরকারি মডেল কলেজের এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র এবং ওয়ালিদ ইবনে নাজিম ইস্পাহানী পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র।

অভিযানের সময় হিযবুত তাহরীরের আরও দুই সদস্য আফজাল হোসেন আতিক প্রকাশ আকাশ (৩৫) ও তাহমিদ সুফিয়ান (৩৫) পালিয়ে যায় বলে জানায় পুলিশ। আফজাল হোসেন আতিক প্রকাশ আকাশ একটি স্কুলের খণ্ডকালীন শিক্ষক ও তাহমিদ সুফিয়ান একটি ডিজিটাল স্কুলের পরিচালক বলে জানিয়েছে পুলিশ।

গ্রেফতার হওয়া হিযবুত তাহরীরের সদস্যদের কাছ থেকে আরও ১০ জনের নাম পাওয়া যায়। পরে ২৩ নভেম্বর কোতোয়ালী থানায় ২৫ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা দায়ের করে পুলিশ।

গত ৩০ নভেম্বর কোচিংয়ে যাওয়ার নামে বাসা থেকে বের হয়ে আর ফেরেননি রিদওয়ান আহমেদ সিয়াম (১৮) নামে মহসিন কলেজের একাদশ শ্রেণির এক ছাত্র। এ ঘটনায় তার পরিবার চকবাজার থানায় একটি নিখোঁজ ডায়েরি করেন। জিডি তদন্ত করতে গিয়ে পু্লিশ জানতে পারে নিখোঁজ রিদওয়ান আহমেদ সিয়াম একজন হিযবুত তাহরীর সংগঠক। গত ২৩ নভেম্বর হিযবুত তাহরীরের সদস্যদের নামে কোতোয়ালী থানায় দায়ের হওয়া মামলার ১৮ নম্বর এজাহারনামীয় আসামি রিদওয়ান আহমেদ সিয়াম।

মামলা দায়েরের পর থেকে রিদওয়ান আহমেদ সিয়ামকে নজরদারিতে রেখেছিল পুলিশ। তাকে গ্রেফতারের চেষ্টার মধ্যেই পুলিশ জানতে পারে সিয়ামের নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টি।

তবে পুলিশ মনে করছে, গ্রেফতার এড়াতে সিয়াম আত্মগোপনে চলে গেছেন। হিযবুত তাহরীর সংগঠনে রিদওয়ান আহমেদ সিয়াম যার (তাহমিদ সুফিয়ান) মাধ্যমে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন তিনিও গত ২৩ তারিখ থেকে পলাতক রয়েছেন।

পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, রিদওয়ান আহমেদ সিয়াম হিযবুত তাহরীরের একজন প্রশিক্ষক ছিলেন। নতুন সদস্যদের সাংগঠনিক প্রশিক্ষণ দিতেন সিয়াম।

হিযবুত তাহরীরের মামলা তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, চট্টগ্রামে মাঠ পর্যায়ে হিযবুত তাহরীর তিনটি সাংগঠনিক উইংয়ে ভাগ হয়ে কাজ করে। এই তিন উইংয়ের দায়িত্বে রয়েছেন আব্দুল্লাহ আল মাহফুজ, আফজাল হোসেন আতিক প্রকাশ আকাশ ও তাহমিদ সুফিয়ান। তিনটি উইং আবুল মোহাম্মদ এরশাদুল আলমের অধীনে কাজ করতো। নিখোঁজ রিদওয়ান আহমেদ সিয়াম তাহমিদ সুফিয়ানের উইংয়ে মাঠ পর্যায়ে কাজ করতেন।

বাংলাদেশ সময়: ২০২৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৫, ২০১৯
এসকে/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।