ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

‘খালি হাতে এসেছিলাম, খালি হাতেই ফিরে যাবো’

নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭১১ ঘণ্টা, নভেম্বর ৭, ২০১৯
‘খালি হাতে এসেছিলাম, খালি হাতেই ফিরে যাবো’ মঈন উদ্দিন খান বাদল।

চট্টগ্রাম: ডিসেম্বরের মধ্যে কালুরঘাট রেল কাম সড়ক সেতু নির্মাণ না হলে সংসদ থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছিলেন চট্টগ্রাম-৮ আসনের সংসদ সদস্য মঈন উদ্দিন খান বাদল। তাকে আর সে সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়নি।

বৃহস্পতিবার (৭ নভেম্বর) বাংলাদেশ সময় সকাল ৭টা ৪৫মিনিটে ভারতের বেঙ্গালুরুর নারায়ণ হৃদরোগ রিসার্চ ইনস্টিটিউট অ্যান্ড হসপিটালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বোয়ালখালীর সারোয়াতলী গ্রামে জন্ম মঈন উদ্দিন খান বাদলের।

তার বাবা আহমদ উল্লাহ খান ও মা যতুমা খাতুন। স্ত্রী সেলিনা খান।
 তিন ছেলে ও এক মেয়ের জনক তিনি, বয়স হয়েছিল ৬৭ বছর।

চট্টগ্রাম-৮ (বোয়ালখালী-চাঁন্দগাও) আসন থেকে মঈন উদ্দিন খান বাদল তিনবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ছিলেন একাদশ জাতীয় সংসদের ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সদস্য। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) একাংশের কার্যকরী সভাপতির দায়িত্বও পালন করেছেন।

ছাত্রজীবনে বাদল ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৭১ সালে অংশ নেন মুক্তিযুদ্ধে। তাদের মুজিব বাহিনী ভারতের জেনারেল সুজন সিংহবান এর অধীনে প্রশিক্ষণ নিয়েছিল। চট্টগ্রাম বন্দরে সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাসের সময় তিনি ছিলেন প্রতিরোধ যোদ্ধা।

মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে তিনি জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলে যোগ দেন। এরপর যোগ দেন বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দল গঠন করা হলে তিনি এতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন।

সংসদ ও সংসদের বাইরে কথা বলে তিনি বার বার গণমাধ্যমে আলোচনায় আসেন। গত ১০ আগস্ট নগরে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় তিনি বলেন, ‌‌‘আমি সরকারি জোটের এমপি। ব্রিজের জন্য যদি আমাকে আওয়ামী লীগ করতে হয়, প্রয়োজনে সেটাও করতে রাজি’।

২০১৮ সালের ১৯ ডিসেম্বর ধানমন্ডির সুধাসদন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে নগরের লালদীঘি মাঠে চট্টগ্রামের ১৬টি আসনের আওয়ামী লীগ ও মহাজোট প্রার্থীদের জনতার সঙ্গে পরিচয় প্রদান অনুষ্ঠানে মঈন উদ্দিন খান বাদল প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আপনি চাটগাঁইয়া ভাষা বুঝতে পারবেন না। এ ভাষায় একটা কথা বলতে চাই। ’

তার বক্তব্যের মাঝেই প্রধানমন্ত্রী স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বলেন, ‘আমি চাটগাঁইয়া ভাষা বুঝি। ’

পরে মঈন উদ্দিন খান বাদল বাংলা ভাষাতেই বলেন, ‘ঢাকা থেকে আপনি যে আমাদের সঙ্গে কথা বলছেন এটাই ডিজিটাল বাংলাদেশ। কখনও কল্পনা করি নাই এটা সম্ভব হতে পারে৷ ১০ বছর আগে আমরা ছিলাম ফকিন্নির পুত, ১০ বছর পরে আমরা এখন রাজপুত। ’

মঈন উদ্দিন খান বাদল। গত ২৫ জুন সন্ধ্যায় জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনে বক্তব্য দিতে গিয়ে চট্টগ্রামের প্রবীণ এ সংসদ সদস্য কালুরঘাট নতুন সেতু নির্মাণ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।  তিনি বলেন, দেশে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ আছেন। তার মধ্যে আমি হচ্ছি বলাউল্লাহ। কালুরঘাট নতুন সেতু নিয়ে বারবার শুধু বলেই যাচ্ছি, কোনো কাজ হচ্ছে না।  

বাদল বলেছিলেন, ২০১২ সাল থেকে কালুরঘাট নতুন সেতুটি নিয়ে এ পর্যন্ত চারটি দেশের বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠান সমীক্ষা চালিয়েছে। প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ১৬৪ কোটি ৯৮ লাখ ৮৯ হাজার টাকা। যার মধ্যে ১ হাজার ১৪৬ কোটি টাকার দক্ষিণ কোরিয়ার ইকোনমিক ডেভলপমেন্ট কো-অপারেশন ফান্ড। বাকি টাকার যোগান দেবে বাংলাদেশ সরকার।

‘কালুরঘাট নতুন সেতুটির জন্য আমি এলাকায় মুখ দেখাতে পারি না। মানুষ আমার মরা মা তুলে গালি দেন। আমি এটা আর সহ্য করবো না। যদি আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে কালুরঘাট সেতুর কোনো সুরাহা না হয়, তাহলে আমি এ সংসদ থেকে পদত্যাগ করবো’।

জীবদ্দশায় বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপকালে মঈন উদ্দিন খান বাদল বলেন, অসাম্প্রদায়িক বোয়ালখালী গড়ে তুলতে আমি কাজ করছি। গত ১০ বছরে আমার সংসদীয় আসনে সাম্প্রদায়িক কোনও সংঘাত ঘটেনি। বোয়ালখালীতে প্রায় ২১৩ কিলোমিটার রাস্তা পাকাকরণ করা হয়েছে। প্রায় ৫০টির মতো প্রাইমারি স্কুল পাকা করা হয়েছে। বোয়ালখালীতে প্রথমবারের মতো ৮০ কোটি টাকা ব্যয়ে কর্ণফুলী সংলগ্ন এলাকার ভাঙন রোধে বাঁধ নির্মাণ হয়েছে। অগ্নিদুর্ঘটনা রোধে বোয়ালখালীতে ফায়ার স্টেশন হয়েছে। এলাকার প্রত্যেকটি হাইস্কুলে পাকা ভবন করা হয়েছে।

তিনি বলেছিলেন, একসময় বোয়ালখালীর মানুষকে হাঁটুসমান কাদা মাড়িয়ে পথ চলতে হতো। আজ বঙ্গবন্ধু কন্যার আমলে মানুষকে কাদা পথ মাড়িয়ে যেতে হয় না। আমার সংসদীয় আসনের আংশিক শহরাঞ্চলে আশেকানে আউলিয়া ডিগ্রি কলেজ সরকারিকরণ করা, ষোলশহরে টেক্সটাইল অ্যান্ড জুট ইনস্টিটিউট করা, মোহরায় ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা ব্যয়ে বঙ্গবন্ধু মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ শুরু হয়। চান্দগাঁওতে ১ হাজার কর্মজীবী নারীর বাসস্থান নির্মাণ ও অত্যাধুনিক সরকারি গুদাম নির্মাণ হয়েছে।  মসজিদ, মন্দির, মাদ্রাসায় দেওয়া হয়েছে অনুদান।

তিনি আরও বলেন, শেখ হাসিনা অনেক দূরদর্শী মানুষ। তিনি এখন সেই লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছেন। আমরা মুক্তিযুদ্ধ থেকে দেশকে আজকে এই পর্যায়ে এনে দিয়েছি। একসময় আমরা খড়ম পড়তাম। এখন এই জাতি স্যান্ডেল পড়ে। একসময় আমের পাতা, জামের পাতা, কয়লা দিয়ে দাঁত মাজতাম। এখন টুথপেস্ট আর ব্রাশ ব্যবহার করছি। একসময় আমরা বিদেশ থেকে আমদানি করা পুরানো গাঁটের কাপড় পড়তাম। এখন ব্র্যান্ডের কাপড় পড়ছি। এখন আমাদের দেশের নারীরাও হিমালয়ে উঠছে।

তিনি বলেছেন, ‘আমার জীবনের এই সত্তরের কাছাকাছি বয়সে এসে অপ্রাপ্তি বলে আর কিছু নেই। আমি আমার মায়ের সম্ভ্রমের জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেছি। আমি ভাগ্যবান। আমি সব গণতান্ত্রিক লড়াইয়ে অংশ নিয়েছি। যখন অসুস্থ ছিলাম, এলাকার মানুষ আমার জন্য কেঁদেছে। আমি এখন মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত। খালি হাতে এসেছিলাম, খালি হাতেই ফিরে যাবো’।

বাংলাদেশ সময়: ১২০০ ঘণ্টা, নভেম্বর ৭, ২০১৯
এসি/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
welcome-ad