ঢাকা, শুক্রবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

চট্টগ্রাম মেট্রো আদালতের হাজতখানায় যা হয়

সরওয়ার কামাল, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬০৩ ঘণ্টা, জুলাই ১০, ২০১৯
চট্টগ্রাম মেট্রো আদালতের হাজতখানায় যা হয় চট্টগ্রাম মেট্রো আদালতের হাজতখানা

চট্টগ্রাম: চট্টগ্রাম আদালতের নিচতলায় চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের হাজতখানা। হাজতখানার সামনে আদালতে আনা আসামির স্বজনদের ভিড়। এ ভিড় শুধু হাজতখানার বাইরে নয়, ভেতরেও ছিল একই দৃশ্য।

মঙ্গলবার (৯ জুলাই) দুপুরে নতুন আদালত ভবনের নিচতলার হাজতখানায় এমন চিত্র দেখা যায়। এর আগে আরও কয়েকদিন হাজতখানার সামনে অবস্থান করে ঠিক একই চিত্র দেখা গেছে।

চট্টগ্রাম আদালতের নিচতলায় মেট্রোপলিটন পুলিশের হাজতখানার এমন দৃশ্য শুধু একদিনের নয়, এটি প্রতিদিনের চিত্র।

সিএমপির প্রসিকিউশন শাখার দায়িত্বে রয়েছেন একজন অতিরিক্ত উপ-কমিশনার ও একজন সহকারী কমিশনার।

অভিযোগ রয়েছে- তাদের ‘ম্যানেজ’ করেই হাজতখানায় চলে অনৈতিক কাজ।

আদালত সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মেট্রোপলিটন পুলিশের হাজতখানাকে টাকার মেশিন হিসেবে ব্যবহার করেন হাজতখানায় দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা। আর যতরকম অনিয়ম- সব এখানে এসেই নিয়মে পরিণত হয়।

হাজতখানার ভেতরে ঢুকতে হলে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ কনস্টেবলদের হাতে দিতে হয় জনপ্রতি ন্যূনতম ১০০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত। টাকা নেওয়ার পর ওই কনস্টেবল ‘সিগন্যাল’ দিলেই কেবল ভেতরে যেতে দেওয়া হয়।

মঙ্গলবার (৯ জুলাই) পরিচয় গোপন রেখে ১০০ টাকার বিনিময়ে হাজতখানার ভেতরে ঢুকেন বাংলানিউজের এই প্রতিবেদক।

কম টাকায় গাদাগাদি, চুক্তিতে আরাম

মেট্রোপলিটন পুলিশের হাজতখানায় মোট চারটি কক্ষ রয়েছে। এসব কক্ষের মধ্যে ১ ও ৪ নম্বর কক্ষে যারা টাকা দিতে পারবেন, শুধু তাদেরই রাখা হয়। এসব কক্ষে আরামে থাকা যায়।

১ ও ৪ নম্বর কক্ষে যেসব আসামিদের রাখা হয় তাদের কাছ থেকে আদায় করা হয় ৬ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত।

আর ২ ও ৩ নম্বর কক্ষে যাদের রাখা হয় তাদের কাছ থেকে যা পাওয়া যায় তা-ই হাতিয়ে নেয় হাজতখানার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যরা।

এছাড়া নতুন আদালত ভবনের ৩য় ও ৪র্থ তলায় বিভিন্ন খালি রুমে নিয়ে বসানো হয় ‘ভিআইপি’ আসামিদের। এসব রুমে বসার জন্য গুণতে হয় অতিরিক্ত টাকা। আর তাদের দাবি অনুযায়ী টাকা না দিলে টয়লেটের পাশে নিয়ে বসানো হয় ওই আসামিদের।

নতুন আদালত ভবনের ৩য় ও ৪র্থ তলায় বিভিন্ন খালি রুমে নিয়ে বসানোর জন্য আসামির স্বজনদের সঙ্গে চুক্তি করেন কনস্টেবল হান্নান।

মোবাইলে কথা বলেন আসামিরা

আদালতে হাজিরা দিতে আসা আসামিরা হাজতখানার ভেতরে বসেই মোবাইল ফোনে কথা বলেন বিভিন্নজনের সঙ্গে। আর এর জন্য হাজতখানার দায়িত্বে থাকা পুলিশকে দিতে হয় মোটা অঙ্কের টাকা। আসামির প্রকৃতি ও আর্থিক সামর্থ্য বুঝে টাকার অঙ্কটা হয় ২০ হাজার পর্যন্ত। ক্ষেত্র বিশেষে টাকার অঙ্কটা ছাড়িয়ে যায় ৪০ হাজার পর্যন্ত, যদি হাজিরা দিতে আসা আসামি বড় কোনো ইয়াবা ব্যবসায়ী বা চেক প্রতারণার মামলার আসামি হয়।

হাজতখানার ভেতরে ঢুকে দেখা যায়, ৪ নম্বর কক্ষের ভেতরে বসে মোবাইলে কথা বলছেন দুই আসামি। তবে তাদের নাম-ঠিকানা জানা যায়নি।

একই কায়দায় আদালত কক্ষে বসেও মোবাইলে কথা বলেন আসামিরা। হাজতখানা থেকে আদালতে নিয়ে যাওয়ার পথেও মোবাইলে কথা বলেন আসামিরা। আর সব কিছুই হয় টাকার বিনিময়ে।

ভাত কিনতে ১০০, খাওয়াতে হাজার

হাজতখানায় রাখা আসামির জন্য হোটেল থেকে ভাত কিনতে লাগে ১০০ টাকা। আর স্বজনদের দেওয়া ভাত হাজতখানার ভেতরে আসামির কাছে পর্যন্ত পৌঁছাতে দিতে হয় ৫০০ টাকা থেকে ২ হাজার টাকা।

এসআই শাহজাহান ঘুরে-ফিরে হাজতখানায়

মেট্রোপলিটন পুলিশের হাজতখানার সাবেক ইনচার্জ উপ-পরিদর্শক (এসআই) শাহজাহান। গত কয়েক বছর ধরে মেট্রোপলিটন পুলিশের হাজতখানার নিয়ন্ত্রক হিসেবে আছেন তিনি। বিভিন্ন সময় বদলি হলেও ঘুরে ফিরে হাজতখানায় ফিরে আসেন।

তার কথামতো না চললে প্রসিকিউশন শাখার হাজতখানায় কাজ করতে পারেন না কোনো পুলিশ সদস্য। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আশীর্বাদ থাকায় তার বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পান না কেউ।

এসআই শাহজাহান ২০১৭ সাল থেকে ২০১৮ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত হাজতখানার ইনচার্জের দায়িত্বে ছিলেন। পরে এসআই মোশাররফ হাজতখানার ইনচার্জের দায়িত্ব পান। সবশেষ পরিদর্শক মর্যাদার আহমদ উল্লাহ নামে একজন কর্মকর্তাকে হাজতখানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার দায়িত্ব দেওয়া হয়। গত ফেব্রুয়ারিতে পরিদর্শক আহমদ উল্লাহকে বদলি করা হলেও তিনি বদলি আদেশ বাতিল করিয়ে থেকে যান।

হাজতখানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার দায়িত্ব পরিদর্শক আহমদের কাছে থাকলেও মূলত নিয়ন্ত্রণ রয়েছে এসআই শাহজাহানের কাছে। এসআই শাহজাহান তার সহযোগী কনস্টেবল হান্নান, ফিরোজসহ কয়েকজনকে নিয়ে গড়ে তুলেছেন সিন্ডিকেট। আর এ সিন্ডিকেটের সদস্যরাই ঘুরে-ফিরে থাকেন হাজতখানার দায়িত্বে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, হাজতখানায় কী হয় তা আমাদের সবারই জানা। তবুও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। হাজতখানায় দায়িত্বরতদের অপকর্ম বলে শেষ করা যাবে না। টাকার জন্য আসামিদের অত্যাচার, আসামির স্বজনদের অপমান, মাদক চালান, অপরাধীদের মিটিং সবকিছুই হয় হাজতখানায়।

তিনি বলেন, হাজতখানা চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মহোদয়ের অধীনে। বিচারকরা যদি নিয়মিত মনিটরিং করেন তাহলে এসব অপকর্ম কমে আসবে বলে মনে করি। বিচারকরা কোর্টের ভেতরের পরিবেশ নিয়েই ভাবেন। হাজতখানাও কোর্টের অংশ, তাদের আদেশেই আসামিদের হাজতখানায় নিয়ে আসা হয়। তাই বিচারকদের উচিত হাজতখানার পরিবেশ নিয়ে ভাবা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্ত এসআই শাহজাহান অভিযোগগুলো সত্য নয় বলে দাবি করেন।

এসআই শাহজাহান বাংলানিউজকে বলেন, হাজতখানার দায়িত্বে একজন ইন্সপেক্টর রয়েছেন। তিনি যেভাবে চালান সেভাবেই চলে। হাজতখানায় কোনো টাকা নেওয়া হয় না।

মঙ্গলবার এ প্রতিবেদক টাকা দিয়ে প্রবেশ করেছেন এবং অন্যদের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার বিষয়টি দেখেছেন জানালে এ বিষয়ে কিছু জানেন না বলে দাবি করেন তিনি।

জানতে চাইলে সিএমপির প্রসিকিউশন শাখার দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মো. কামরুজ্জামান বাংলানিউজকে বলেন, এসব অভিযোগ সত্য নয়। হাজতখানায় কোনো আসামির কাছ থেকে টাকা নেওয়া হয় না।

পরে ব্যস্ততা দেখিয়ে মোবাইল ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মো. কামরুজ্জামান।

হাজতখানার অপকর্মের ব্যাপারে অবহিত করলে বিষ্ময় প্রকাশ করেন সিএমপি কমিশনার মো. মাহাবুবর রহমান।

তিনি বাংলানিউজকে বলেন, হাজতখানার ভেতরের এসব বিষয়ে জানা ছিল না। খোঁজ নিচ্ছি। ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১২০০ ঘণ্টা, জুলাই ১০, ২০১৯
এসকে/এসি/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।