‘আজ আমি বাড়ি ফিরে যাচ্ছি। এই মানুষগুলোর কোমলতা আমাকে একটি প্রতিজ্ঞা করিয়েছে, তা হলো- যদি আমি কখনো কোন অজ্ঞাত অসহায় রোগীর খোঁজ পাই, তবে আমি তার সেবা সেভাবে করবো, যেভাবে এই মানুষগুলো আমার সেবা করেছেন।
অজ্ঞাত রোগীর বন্ধু হিসেবে পরিচিত ফেনীর ছাগলনাইয়ার সাইফুল ইসলাম নেসার সহ তার সহযোদ্ধারা দিচ্ছেন এই ‘প্রতিজ্ঞা পত্র’।
সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে অজ্ঞাত রোগী হিসেবে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন নগরে নিরাপত্তা রক্ষীর চাকরি করা বেলাল হোসেন (৫০)।
এ প্রসঙ্গে সাইফুল ইসলাম নেসার বাংলানিউজকে বলেন, সুস্থ হয়ে একজন অজ্ঞাত রোগী যখন পরিবারের সান্নিধ্যে ফিরে যায়, তখন অন্য একজন অজ্ঞাত রোগীর পাশে দাঁড়ানোর জন্য আমরা তাদের উদ্বুদ্ধ করতে এই ‘প্রতিজ্ঞা পত্র’ দিচ্ছি। এখন থেকে নিয়মিত এ কার্যক্রম চলবে। আমাদের দেখানো পথে তারাও পথ চলবে বলে প্রত্যাশা করছি। ’
চমেক হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালে ৯৩ জন অজ্ঞাত রোগী পাওয়া যায়। এদের মধ্যে ২৬ জনের স্বজন পাওয়া যায়, মারা যায় ১৭ জন। ২০১৭ সালে ৫৭ জন অজ্ঞাত রোগীর মধ্যে ১৬ জনের স্বজন পাওয়া যায় এবং মারা যায় ৯ জন। ২০১৮ সালে ৬৩ জন অজ্ঞাত রোগী পাওয়া যায়। এদের মধ্যে ৯ জন মারা যায় এবং ২৪ জনের স্বজন পাওয়া গেছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত ২৩ জন অজ্ঞাত রোগী পাওয়া গেছে। অভিভাবক হিসেবে তাদের সেবা দিয়েছেন সাইফুল ইসলাম নেসার ও তার বন্ধুরা। এদের মধ্যে ১১ জন স্বজনের কাছে ফিরে গেছে।
২০০৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন হাসপাতালে ৮শ’ জনের অধিক অজ্ঞাত রোগীকে চিকিৎসা পূর্ব ও পরবর্তী সেবা দিয়েছেন নেসার। পোর্টল্যান্ড গ্রুপের টেকনিক্যাল অফিসার হিসেবে কর্মরত নেসারকে মানবসেবার স্বীকৃতি হিসেবে সাবেক জেলা প্রশাসক মেজবাহ উদ্দিন ও বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সম্মাননা দিয়েছে।
দুটি কিডনি অকেজো হয়ে ২০০৭ সালে সাইফুল ইসলাম নেসারের বাবা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান। তিনি তখন ফেনী পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটে ১ম বর্ষের ছাত্র। ভাইদের সামান্য বেতনের টাকা দিয়ে ওষুধ কিনতে হতো বাবার জন্য। দুঃসময়ে চাচাতো ভাই ইব্রাহিম নাজির ছাড়া কেউই পাশে দাঁড়ায়নি। সেই কষ্ট এখনও বয়ে বেড়াচ্ছেন নেসার।
সে সময় থেকেই ফেনী সদর হাসপাতালে গরীব, অসহায় রোগীদের রক্ত সংগ্রহ করে দিতেন নেসার। কর্মসূত্রে চট্টগ্রামে এসে অজ্ঞাত রোগীর প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। যাদের গায়ে দুর্গন্ধের কারণে হাসপাতালের আয়া-নার্সরা কাছে ঘেঁষতেন না, তাদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার দায়িত্ব নেন তিনি। কখনো নিজ উদ্যোগে, কখনো বন্ধুদের সহায়তায় এ ধরনের রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছেন। হাসপাতালে নেওয়ার পর কখন জ্ঞান ফেরে সে অপেক্ষায় বারান্দায় রাতযাপন করেছেন। যা আয় করেন তা অসহায় মানুষের জন্য খরচ করেন। এজন্য পরিবারের সঙ্গে দীর্ঘ দেড় বছর যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন ছিল।
নেসার বলেন, বর্তমানে প্রাপ্তবয়ষ্ক সকলেরই বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সিম নিবন্ধন করা আছে। এতে ফিংগার প্রিন্টসহ জাতীয় পরিচয় পত্রের তথ্য রয়েছে। দেশের সরকারি হাসপাতাল কিংবা হাসপাতাল সংশ্লিষ্ট থানাগুলোতে যদি বায়োমেট্রিক যন্ত্র রাখা হয় তাহলে অজ্ঞাত রোগীদের শনাক্ত করা সহজ হবে।
এদিকে চমেক হাসপাতালে চিকিৎসার পাশাপাশি এখন থেকে স্বজনহীন অজ্ঞাত রোগীরা পাচ্ছেন ওষুধও। মিলছে অস্ত্রোপচারের জন্য সার্জিক্যাল আইটেম, নতুন পোশাক ও বিশুদ্ধ পানি। সাইফুল ইসলাম নেসারের হাত ধরেই দেশে প্রথমবারের মতো অজ্ঞাত রোগীদের চিকিৎসার জন্য ‘অজ্ঞাত রোগী সেল’ চালু করা হয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরোসার্জারি ওয়ার্ডে।
চমেক হাসপাতালের মতো ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালেও অজ্ঞাত রোগীদের জন্য বিশেষ সেল চালু করার ইচ্ছের কথা জানান প্রকৌশলী সাইফুল ইসলাম নেসার। তিনি বলেন, যদি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও দানশীল ব্যক্তিরা এগিয়ে আসেন, তাহলে আমরা ঢামেক হাসপাতালেও এই কাজটি শুরু করবো।
বাংলাদেশ সময়: ১৬১৫ ঘণ্টা, জুন ১৪, ২০১৯
এসি/টিসি