ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

ভালোবাসার মানুষ বৃদ্ধাশ্রমে

নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯০৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১৯
ভালোবাসার মানুষ বৃদ্ধাশ্রমে আমেনা-বশর বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্র

চট্টগ্রাম: সবার জায়গা হয়, হয় না শুধু মা-বাবার। ভালোবাসা জাগে না তাদের জন্য, নিষ্ঠুর হদয় পাঠিয়ে দেয় বৃদ্ধাশ্রমে। দক্ষিণ রাউজানের নোয়াপাড়ায় আমেনা-বশর বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছে এমন অসহায় মানুষগুলোর ঠিকানা।

২০১৪ সালের ১ মে চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়ক সংলগ্ন এলাকাজুড়ে আমেনা-বশর বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রের যাত্রা শুরু হয়। ব্যবসায়ী মো. শামসুল আলম মা-বাবার নামে এ বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন।

চারতলা বৃদ্ধাশ্রমটিতে বর্তমানে আছেন ১৭ জন প্রবীণ। এদের মধ্যে ১১ জন পুরুষ, ৬ জন মহিলা।

ব্যবস্থাপক হিসেবে আছেন মো. ফারুক। আশ্রিতদের দেখভাল করেন সনজিত দে, প্রদীপ দে, মানু দে, লুৎফুর রহমান ও লুৎফা আকতার। তাদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে আসছেন ডা. সালাউদ্দিন মুরাদ।

‘ভালোবাসার মানুষগুলো’র অবহেলায় এখানে যাদের আশ্রয় হয়েছে, তারা হলেন- নজরুল ইসলাম (৭২), আবু আহমদ (৭০), শোভা রানী দে (৭০), কাঞ্চনা কর্মকার (৭১), বাহার উল্লাহ (৬৫), মুবিনুল হক (৭০), দুলাল দাশ (৮৫), পেয়ার আহমদ (৭৪), তপন দাশ (৮০), নুরুল আমিন (৯৬), যতীন্দ্র ত্রিপুরা (৮০), হুগিলা পুদি চাকমা (৮০), রেণু লতা চাকমা (৮১), মেনু দাশ (৭০), নাছিমা আকতার (৬২), প্রতিবন্ধী জাহাঙ্গীর আলম (৪৫) ও মো. শফি (৬৫)। তাদের জীবনের গল্প শুনতে আসে না পরিবার-পরিজন। সন্তানদের মানুষ করতে জীবনটাই যারা শেষ করে দিয়েছেন, জীবনের শেষপ্রান্তে এসে সেই অমানুষদের কাছেই বোঝা হয়ে গেছেন তারা। ফলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও থাকতে হচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমে। আমেনা-বশর বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্ররাঙ্গুনিয়ার মরিয়ম নগরের নজরুল ইসলামের ছেলে আরিফুল ইসলাম আবুধাবীতে ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত। আরেক ছেলে মিজানুল ইসলাম দেশেই আছে। মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। পরিবারের বোঝা এই মানুষটার ঠাঁই হয়েছে বৃদ্ধাশ্রমে। একই ভাগ্য পেয়ার মোহাম্মদের। তার দুই ছেলে বিদেশে থাকে, বাবার খোঁজ নেয়ার সময় তাদের নেই।

ফেনীর সোনাপুর গ্রামের পেয়ার আহমদের ভাগ্যটা বেশ খারাপই। প্রায় ৪ কোটি টাকার সম্পত্তি কিনেছিলেন স্ত্রীর নামে। ৭ বছর আগে সেই স্ত্রী তাকে তালাক দিয়ে চলে যান। তার দুই ছেলে মো. সেলিম ও শাহ আলম থাকেন আবুধাবীতে। তাই তার আশ্রয় মিলেছে এই বৃদ্ধাশ্রমে।

পাঁচ বছর ধরে প্রবীণ নিবাসের বাসিন্দা শোভা রানী দে-এর দুই ছেলে যেন থেকেও নেই। এক ছেলে ওমানে, আরেক ছেলে চায়ের দোকানী। মাঝেমধ্যে বিবাহিত ৫ মেয়ে এসে দেখে যান বৃদ্ধ মাকে। স্বামীর মৃত্যুর পর বৃদ্ধা কাঞ্চনা কর্মকারের ১ ছেলে ও ৩ মেয়ে আর তার খবর রাখে না। তাই এখন কান্নাই সম্বল এই মায়ের। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর দর্জি দুলাল দাশকে এই বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানো হলেও খবর নেয় না ১ ছেলে। তবে ৪ মেয়ে বাবার খবর নেয় এখনও।

নোয়াপাড়ার ঘাটকূল এলাকার আবু আহমদ যৌবনে ব্যবসা করতেন মধ্যপ্রাচ্যে। নিজের টাকায় নগরে বেশকিছু জমি কিনেছেন। শেরশাহ কলোনীতে সাড়ে ৬ গন্ডা জমি কিনেন স্ত্রী-সন্তানের  নামে। মেহেদীবাগ ও আমিরবাগে কিনেছেন ফ্ল্যাট। কিন্তু কোথাও তার জায়গা হয়নি, হয়েছে আমেনা বশর বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে। আমেনা-বশর বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্ররাঙামাটির যতীন্দ্র ত্রিপুরা, খাগড়াছড়ির হুগিলা পুদি চাকমা ও রেণু লতা চাকমা, কুমিল্লার মুবিনুল হক, নাছিমা আকতার, রাউজানের  নুরুল আমিন, জাহাঙ্গীর আলম, আনোয়ারার মেনু দাশ, তপন দাশ, বোয়ালখালীর মো. শফি ও নগরের খুলশী এলাকার বাহার উল্লাহ’র জীবনের গল্পও প্রায় একই। কারো অভাবের সংসারে আর কারো সংসারে বোঝা হয়ে দাঁড়ানোয় তাদের বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানো হয়েছে।

আমেনা-বশর বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ ফারুক বাংলানিউজকে জানান, মাত্র সাতজন বয়স্ক মানুষকে পুনর্বাসনের মধ্য দিয়ে এ কেন্দ্রের যাত্রা শুরু হয়েছিল। বর্তমানে ১৭ জন আছেন। প্রতি কক্ষে ছয়জন করে থাকার শয্যা আছে। এখানে বাংলাদেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে যেকোনো ধর্মের ষাটোর্ধ নাগরিকরা থাকতে পারেন। থাকা-খাওয়ার জন্য কোনো খরচ দিতে হয় না।  

এই প্রবীণরা অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাংলানিউজের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে কখনো কান্নায় চোখ ভেজালেন, আবার ভালোবাসার কথা শুনে বেশ হাসলেনও। তাদের হাসিতে যে বেদনা লুকিয়ে আছে-সেটা কি কখনো বুঝবে না সন্তানরা?

বাংলাদেশ সময়: ১৪০০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১৯
এসি/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।