শুক্রবার (০৭ ডিসেম্বর) দুপুরে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের বঙ্গবন্ধু হলে বাতিঘর আয়োজিত আলাপচারিতা অনুষ্ঠানে তিনি এ ইচ্ছের কথা জানান। অনুষ্ঠানে শত শত তরুণ-তরুণী দাঁড়িয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো সমরেশ মজুমদারের কথা শোনেন।
আরও খবর>>
** আড়াই বছর আগে ঈশ্বর নিয়ে যেতে চেয়েছিল: সমরেশ
সমরেশ মজুমদার বলেন, এ দেশের রাজনীতি ও মানুষের সংগ্রামের কথা অনেকে লিখেছেন। কিন্তু এ দেশের মানুষের ব্যাপক পরিবর্তন ১৯৪৭ সালের আগস্ট থেকে শুরু হয়েছে।
`যেমন ধরুন সে সময় মুসলিম লীগের নেতা, অতি ধনী ব্যক্তিদের পরিবারের বেশিরভাগ মহিলার সঙ্গে বাংলাদেশের বেশিরভাগ মেয়েদের চেহারার কোনো মিল নেই। গায়ের রঙেও মিল নেই। বেশির ভাগ মেয়েরা শ্যামলা, উজ্জ্বল শ্যামলা। তাদের ধবধবে গায়ের রং, মোমের মতো গায়ের রং। একাত্তর থেকে পরিবর্তন শুরু হলো। এ সময়টা নিয়ে আমার উপন্যাস লেখার খুব ইচ্ছে। ’
কবিতা মেয়েরা খুব পছন্দ করে উল্লেখ করে সমরেশ বলেন, কবিতা লেখার ক্ষমতা অর্জন করতে হয়। জীবনানন্দ বলেছিলেন, সকলে কবিতা লেখে, কেউ কেউ কবি। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও কবিতা লিখতে পারিনি। তাই গদ্য লিখেছি।
তিনি বলেন, ভালোবাসলে মন পুড়ে। এখন মন পুড়ে না বলে অনেকে প্রতারিত হয়। আগে আঙুল লাগলে শরীরে বিদ্যুৎ চমকাতো। চোখে চোখ পড়লে পৃথিবী বদলে যেত। এখন তেমন হয় না।
জনপ্রিয় সাহিত্য দীর্ঘজীবী না হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ৫০ বছর পেরিয়ে গেলে চিরকালের সাহিত্য বলা হয়, কালোত্তীর্ণ উপন্যাস বলা হয়। ‘পথের পাঁচালী’র নখের যোগ্যতাও আমার নেই। ‘দেবদাস’কে এখনকার ছেলেমেয়েরা বড় মাপের উপন্যাস মনে করে না! ‘চিলেকোঠার সেপাই’ উচ্চমানের উপন্যাস কিন্তু জনপ্রিয় কী?
তিনি বলেন, রবীন্দ্রনাথের কবিতা, গানগুলো আমার কাছে মন্ত্রের মতো। ঈশ্বরের সঙ্গে আমার যোগাযোগ নেই। কিন্তু আমার মনে দুঃখ পেলেই আমি রবীন্দ্রনাথের গান শুনি। আমার মন ভালো হলেও রবীন্দ্রনাথের গান শুনি, মন আরও ভালো হয়ে যায়।
‘যখনই আমি ঢাকায় আসতাম হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে কথা হতো। সন্ধ্যা সাতটা থেকে রাত একটা পর্যন্ত একত্রে থাকতাম। রাত ১২টার পর ওর অন্য সঙ্গীদের চলে যেতে বলতো। তারপর শুধু আমার সঙ্গে কথা বলতো। তার বাসায়, নুহাশ পল্লীতে, আমেরিকার বিভিন্ন শহরে আমরা কথার পর কথাই বলে গেছি। সে প্রায়ই বলতো, সমরেশ দা-যে মানুষ ১৫ থেকে ১৬ তে পা দিয়ে হুমায়ূন আহমেদ পড়েনি সে পাঠক না। আর যে ২৫ এ পড়ার পর হুমায়ূন আহমেদ পড়ে-সে পাঠক না। এটা বলার ক্ষমতা সব লেখকের হয় না। আমি তো মিসির আলী পড়েছি, পরিণত বয়সে। ৪৫-৪৬ বছরে। আমি কি পাঠক নই! সে বলে, আপনার বয়স এখন ৫-৬!’ স্মৃতিচারণ করে বলেন সমরেশ।
চা-বাগানের স্মৃতি তুলে ধরে তিনি বলেন, বছরে দু'বার চা-বাগানে না গেলে দম বন্ধ হয়ে আসে। ৭-৮ বছর বয়সে চা-বাগানে জাম্বুরা দিয়ে ফুটবল খেলতাম। তখন একটি ৮ বছরের মেয়েকে দেখতাম। ভাইকে পিঠে নিয়ে খেলা দেখত। ৬৫ বছর পর সেই মেয়ের সঙ্গে দেখা, সে আমার ডাক নাম বললো। আমি চমকে উঠলাম। সে আমাকে হাড়িয়া খাওয়ালো, এটি আমার জীবনে অনেক বড় পুরস্কার।
সমরেশ 'দেশ' পত্রিকায় প্রথম গল্প ছাপানোর স্মৃতি, বাবার বিশ্বাস না হওয়া, ১৫ টাকা সম্মানী পেয়ে বন্ধুদের কফি হাউসে খাওয়ানো, ‘উত্তরাধিকার’, ‘কালবেলা’, ‘কালপুরুষ’ রচনা শিবরাম চক্রবর্তীর দৈনন্দিন রুটিন ইত্যাদি নানা প্রসঙ্গ উঠে আসে আলাপচারিতায়।
পাঠকের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ঢাকায় প্রথম আসি ১৯৮৭ সালে। তখন কোনো কলেজের ছাত্রীকে হেঁটে যেতে দেখিনি, গল্প করতে দেখিনি। রিকশায় চলাফেরা করতো। আমি এমনও দেখেছি, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে রিকশা দাঁড়িয়ে থাকতো। ছাত্রীরা সেই রিকশায় উঠে পড়তো। ক্যাম্পাসে তারা ছেলেদের সঙ্গে কথা বলতো।
‘আজ বেইলি রোডের ফুটপাতে মেয়েরা ছেলেদের সঙ্গে গল্প করছে, আড্ডা মারছে। মেয়েরা বিভিন্ন চাকরিতে গেছে। নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে। ছেলেদের সঙ্গে সমান তালে লড়াই করছে। মেয়েরা অনেক দূর এগিয়েছে। সাতকাহনের দীপাবলির মতো এগিয়েছে। একটি দেশ এত অল্প সময়ের মধ্যে নিজেকে পরিবর্তন করেছে। ’
অপর প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমার ছায়াতে অনিমেষকে তৈরি করেছি। আমি আর অনিমেষ এক নই।
জয়িতা নামের এক তরুণীর প্রশ্নের জবাবে সমরেশ বলেন, ‘গর্ভধারিণী’ বের হওয়ার বছর দুয়েক পর ঢাকায় আসি। শেখ হাসিনা আমাকে দাওয়াত দিয়েছেন। দেখা করতে গেলাম। তখন তিনি বিরোধী দলের নেত্রী। বললেন, ‘এটা আপনি কী করেছেন সমরেশ দা। এটা আমি আপনার কাছে এসপেক্ট করিনি। ’ আমি একটু আতঙ্কিত হলাম। বললাম, আমি কী অন্যায় করেছি। তখন তিনি বোনকে ডাকলেন। বললেন, তুমি বলো কী হয়েছে।
তখন শুনলাম, এক সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার ১৭-১৮ বছরের মেয়ে জয়িতা হতে চাইল। সে নাকি বাড়িতে না বলে, কাউকে না জানিয়ে ঢাকা থেকে আপনাদের শহরে (চট্টগ্রাম) এলো। এরপর বান্দরবানের পাহাড়ে চলে গেল। যা জয়িতা করেছিল তা করতে গেল। এরপর অনেক কষ্ট করে ওকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হলো। এরপর সে নিজে ঘর থেকে বের হতো না। শুয়ে থাকে। দরজা বন্ধ করে রাখতো। জানালা দিয়ে খাবার দেওয়া হতো।
শেখ হাসিনা আমাকে বললেন, ‘এটা আপনি ঠিক করে দেন। এটা আপনার দায়িত্ব। ’ আমি গেলাম ওই বাড়িতে। মেয়েটির মা আমাকে বললেন, ‘এসব কেন লেখেন!’ অনেক ডাকাডাকির পর মেয়েটি আমাকে অনেক্ষণ তাকিয়ে দেখে বললো, ‘ধ্যাৎ আপনি সমরেশ মজুমদার!’ তারপর বইয়ের প্রচ্ছদের ছবি দেখিয়ে বললো, ‘এ ছবি কি আপনার হতে পারে!’
আলাপচারিতায় সঞ্চালক ছিলেন কবি বিশ্বজিৎ চৌধুরী। স্বাগত বক্তব্য দেন বাতিঘরের সত্বাধিকারী দীপঙ্কর দাশ।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৩০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৭, ২০১৮
এআর/এসি/টিসি