ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

আস্কর আলী পণ্ডিত: একটি বিলুপ্ত অধ্যায়

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১২১ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৯, ২০১৮
আস্কর আলী পণ্ডিত: একটি বিলুপ্ত অধ্যায় বইয়ের কভার।

বাউল বলতে আমরা যে ধরনের সংসারত্যাগী সাধনমার্গী বুঝে থাকি, আস্কর আলী পণ্ডিত তেমনটি ছিলেন না। সংসার তিনি ত্যাগ করেননি। যেমনটি সংসার ত্যাগ করেননি জালাল উদ্দিন খাঁ। তবে কামনা-বাসনা-ভোগ-লালসার বস্তুগত সম্পর্কে বাস করেও কারো কারো অন্তরে হঠাৎ ‘বৈরাগীর লাউয়া’ বেজে ওঠে। যেমন বেজে উঠেছিল হাসন রাজার মর্মে। 

অথচ হাসন রাজা মানুষটি ছিলেন জাগতিক অর্থে রাজসিক। ‘দেশে দেশে বিয়া’ করে বেড়াতেন।

নারীদের শিকার আর কুড়া পাখি শিকারের ব্যসনে তিনি থাকতেন সদা মত্ত ও ভ্রমণশীল। জালাল খাঁও অনেকগুলো বিয়ে করেছিলেন।
তার স্ত্রীর সংখ্যা দেড় ডজনের কম নয়! কিন্তু অচিন পাখি যেমন দেহখাঁচার ভেতরে কী রহস্যে আসে আর যায় তেমনই কোনো অন্তর্গোপন কান্না যে ভরা থাকে ভোগীকায়ার অভ্যন্তরে তা কে জানে?

চন্দনাইশের উত্তর সীমান্তে পটিয়া থানার শোভনদণ্ডি গ্রামের আস্কর আলী পণ্ডিত ভোগী হিসেবে তেমনটি না থাকলেও ছিলেন সম্পন্ন গেরস্থ। ছিল জমি-জিরাত, দোতলা বাড়ি। দুই স্ত্রী ছিলেন মিছরি জান ও আতর জান, ছিল পাঁচ সন্তান।  

সন্তানদের সঙ্গভোগ্য মানুষ করে তোলার পিতৃসুলভ যাবতীয় কর্তব্য পালন করেছিলেন তিনি যথাযথভাবে। ১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণকারী আস্কর আলী পণ্ডিত নিজের অজ্ঞাতসারেই হয়তো গবেষকদের সহায়ক হিসেবে জ্ঞান চৌতিসা গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করে গেছেন নিজের পূর্বপুরুষ ও অধস্তন পুরুষদের কথা, নিজের সাংসারিক জীবনের কথা, সচ্ছলতার কথাও : 
পুত্র কন্যা আদি যত নাহি কোন ঊন 
আল্লায় দিলেক তানে সেকান্দরি গুণ
ধনে মানে ঊনা কিছু নাহিক তাঁহার।
দোতালা তেতালা বাড়ি করিল উহার

এহেন গৃহীর জীবনের অন্তস্থলে বসত করেছিল বাউলিয়ানা। সংসারে থেকেও বাউলত্ব লালন করে গেছেন আজীবন। লালনের মতো কোনো সাধনমার্গ বা তরিকার সৃষ্টি করেননি বটে, কিন্তু শিষ্য তৈরি হয়েছিল অনেকই। সেই শিষ্যদের নিয়ে গীত রচনা, গানের আসর এসবও চলত। তার গানের আসর নিয়ে এলাকার শরিয়তপন্থী মানুষদের সঙ্গে দ্বন্দ্বও হয়েছে।  

গ্রামের লোক তাকে গান-বাজনা থেকে বিরত রাখার উদ্দেশ্যে মির্জারখিল দরবার শরিফের জাহাঙ্গীরিয়া তরিকার পীর এবং রৌশনহাটের ছুফিয়া দরবার শরিফের পীরকে নিয়ে সালিস বসিয়েছিলেন।  

অনেক বাহাসের পর পীরদ্বয় সিদ্ধান্ত দেন যে আস্কর আলী পণ্ডিতের গান-বাজনা চলতে দেওয়া উচিত। গ্রামে একই রাতে আমিনুল্লাহ শাহের ওয়াজ ও আস্কর আলী পণ্ডিতের গানের আসর বসেছিল। গান-বাজনার শব্দে ওয়াজ মাহফিলে কথা শোনা যাচ্ছিল না। মুসল্লিরা আস্কর আলী পণ্ডিতকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার উদ্যোগ নিলে আমিনুল্লাহ শাহ নিজেই তাদের নিবৃত্ত করেন এই বলে যে, ‘ওয়াজত আঁই যা হইয়ি, আস্কর আলীও গানত তা হইয়েদে। আঁই হইয়ি ভাবত, তে হইয়ে রঙ্গত। ’ (ওয়াজ-এ আমি যা বলেছি, আস্কর আলীও গানে তা বলেছে। আমি বলেছি ভাবে, সে বলেছে রঙ্গে। ) 

. চট্টগ্রামে একটি সাহিত্যানুষ্ঠান শেষে লেখকের সঙ্গে আড্ডা।  মাইজভাণ্ডারী তরিকার হজরত আহমদুল্লাহ মাইজভাণ্ডারীর  খলিফা ফজল রহমানকে  দীক্ষাগুরু হিসেবে মান্য করতেন আস্কর আলী। শোনা যায় ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন আস্কর আলী। মৃত্যুকালে তার মুখ ‘হা’ হয়েছিল। লোকবিশ্বাস এই যে, মৃত্যুকালে অসৎ ও পাপী ব্যক্তিদের মুখ ‘হা’ হয়ে থাকে। তার বিরোধীরা এটি নিয়ে যখন শোরগোল করছিল, তখনই নাকি জোরে একটা শব্দ করে তার ওই ‘হা’ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সেই সঙ্গে বন্ধ হয়েছিল তার বিরোধী পক্ষের প্রচারণাও।

তারপরেও বাংলাদেশের অনেক বাউল ও লোককবির মতো আস্কর আলী পণ্ডিতেরও লোকবিস্মৃতির আশংকা দেখা দিয়েছিল। এ বিষয়ে জীবৎকালে নিজের উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন ক্রমশ বাংলাদেশের বিবেক হয়ে ওঠা আহমদ ছফা।  

তিনি চট্টগ্রামের বিভিন্ন সংগঠক, লেখক ও গুণীজনদের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছিলেন আস্কর আলী পণ্ডিতের রচনা ও সঙ্গীতের আবাদ জারি রাখার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করতে। কিন্তু তার আবেদনে প্রতিষ্ঠিত কেউ এগিয়ে আসেননি। এগিয়ে এসেছেন তরুণ কবি ও স্বউদ্যোগী-স্বনিয়োজিত গবেষক শামসুল আরেফীন।  

দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টার ফসল হিসেবে তিনি সংগ্রহ করতে পেরেছেন আস্কর আলী পণ্ডিতের আংশিক জীবনী ও ২৫৪টি গান। আস্কর আলী পণ্ডিতের জীবদ্দশায় প্রকাশিত কোনো গীতিগ্রন্থই অখণ্ড অবস্থায় উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। পঞ্চসতী প্যারজান, জ্ঞান চৌতিসা, বর্গসাস্ত্র, হাফেজ বাহাদুর, নন্দবিলাস প্রভৃতি গ্রন্থের বিভিন্ন ছিন্ন অংশ এবং স্থানীয় মানুষের স্মৃতি থেকে সংগৃহীত গানগুলোর সঙ্গে আস্কর আলী পণ্ডিতের সংক্ষিপ্ত জীবনকাল নিয়ে শামসুল আরেফীন প্রকাশ করেছেন ‘আস্কর আলী পণ্ডিত: একটি বিলুপ্ত অধ্যায়’ গ্রন্থটি।  

চট্টগ্রামের বলাকা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ১১২ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থটিই এক বিস্মৃতপ্রায় লোককবিকে বিস্মৃতির অতল থেকে ফিরিয়ে আনার এখনো পর্যন্ত একমাত্র উদ্যোগ-স্মারক।

০২
আস্কর আলী পণ্ডিতের কবিতা ও সঙ্গীতকে বিস্মৃতির পলিরেখা সরিয়ে সামনে তুলে আনার তাৎপর্য দ্বিবিধ। প্রথমত, তার সৃষ্টির সৌন্দর্যের সঙ্গে বাঙালির জীবনের যোগ অক্ষুণ্ন রাখা। দ্বিতীয়ত, ধর্মের প্রাতিষ্ঠানিক মৌলবাদ-অভিমুখী ধারার বিরুদ্ধে এই লৌকিক অসাম্প্রদায়িক ধর্মচেতনাকে প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানো। সর্বধর্ম সমন্বয়ের এক সহজিয়া লৌকিক ধর্মের ধারা আমাদের দেশে আর্য-আগ্রাসনের সময় থেকেই বহমান। লৌকিক ধর্মমতের মতোই গড়ে উঠেছিল লৌকিক সাধনতত্ত্ব। গড়ে উঠেছিল তার পরিভাষা ও সাংকেতিক ভাষা।

আরশিনগর, পড়শি, আয়নামহল, বাহান্নবাজার, তিপ্পান্ন গলি, ছয় বোম্বেটে, নবদ্বার, আটকুঠুরি, চৌদ্দপোয়া, চার রং, ত্রিবেণীর ঘাট, অনাদি নিরঞ্জন, সত্যপীর-সত্যনারায়ণ, হর-পার্বতী, গোসাই, মীননাঙ্গ-এসব শব্দ আলাদা আলাদা তাৎপর্য বহন করে অসাম্প্রদায়িক সর্বধর্ম সমন্বয়বাদী লোককবিদের কাছে। প্রদান করে গুহ্য সাধন-ইঙ্গিত।  

আস্কর আলী পণ্ডিতের লেখাতে ধ্বনিত হয় সেই তাৎপর্য, সঙ্গে দাবি করা হয় যে কোরান-কেতাবে নষ্ট সব প্রশ্নের উত্তর। উত্তর আছে খোদ ভজনায়। যেমন-
আগমেতে লেখীয়াছে শুনীবারে পাই।
কি মতে করিল সৃষ্টি ত্রিজগত গোসাই।
কোথাতে সৃজন হৈল অগ্নিবায়ু জল।
কোথা হন্তে রবি শশী নক্ষত্র নির্ম্মল।
কোথা হন্তে জম্মি আছে খাকের পতন।

লৌকিক সর্বধর্মসমন্বয়বাদী বাউল-লোককবিরা সচরাচর সমাজে দ্বৈত জীবনযাপন করেন। এঁরা নিজেদের সম্প্রদায়ের মধ্যে বিশেষ বিশেষ লৌকিক ধর্মের নিজস্ব আচার-অনুষ্ঠান বা ধর্মীয় সাধন পদ্ধতির অনুসরণ করে থাকেন, কিন্তু সম্প্রদায়ের বাইরে বৃহত্তর জনমণ্ডলীতে তারা সাধারণভাবে প্রচলিত আচার নীতিই মান্য করে চলেন-বাইরের লোকের কাছে নিজেদের চিন্তাভাবনা ও আচার-অনুষ্ঠানের বিষয় সহজে প্রকাশ করেন না।

যতীন সরকারের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, এত সাবধানতার পরেও এঁরা প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের ধ্বজাধারীদের সঙ্গে সংঘাত এড়িয়ে যেতে পারেন না সব সময়। সুধীর চক্রবর্তীর লেখা থেকে জানা যায়, ‘হিসাব নিলে দেখা যাবে শেষ আঠারো শতকে পূর্ব ও উত্তরবঙ্গের বিপুল পরিমাণ শূদ্র ও গরিব মুসলমান বাউল বা ফকিরী ধর্মে দীক্ষা নিয়ে বৃহত্তর হিন্দু ও মুসলিম সমাজ ত্যাগ করতে থাকে। ’

দেখা যায়, বাউল ফকিরদের মধ্যে মুসলমান ধর্মত্যাগীদের সংখ্যা ছিল খুব বেশি। লালন শাহ থেকে আরম্ভ করে বহুসংখ্যক উদাসীন ধর্মগুরু তাদের সৎ জীবনযাপন, অসাম্প্রদায়িক আদর্শ প্রচার এবং সমন্বয়বাদী চিন্তাধারায় বহু সাধারণ মানুষকে আকর্ষণ করে নেন তাদের উপধর্মে। এতে বৃহত্তর হিন্দু-মুসলমান ধর্ম, বিশেষ করে নৈষ্ঠিক বৈষ্ণব-সমাজ এবং কট্টর ইসলামী সমাজ খুব বড় রকমের অর্থনীতিক ও সামাজিক ধাক্কা খায়। স্বভাবত প্রতিবাদ ও প্রতিক্রিয়া জাগে।

কেবল গালমন্দ বা ব্যঙ্গবিদ্রুপ নয়, উনিশ শতকে বাউল-ফকিরদের সঙ্গে সক্রিয় বিরোধিতায় নেমে পড়ে রক্ষণশীল মুসলমানদের একটি গোষ্ঠী। গানই হচ্ছে বাউল-ফকিরদের শাস্ত্র ও মন্ত্র। শরিয়তপন্থীদের পক্ষ থেকে প্রচার করা হয় যে, গান গাওয়া ইসলামে নাজায়েজ। তাই শুরু হয় বাউলদের গানের আসরে হামলা, কেটে নেওয়া শুরু হয় তাদের ঝুঁটি।  

ব্যাপকভাবে প্রচারিত হতে থাকে রংপুরের মৌলানা রেয়াজউদ্দিন আহমদের লেখা ‘বাউল ধ্বংস হওয়া’ বইটি। সে সময় অবিভক্ত বাংলায় ষাট-সত্তর লাখ বাউল ছিল। কিন্তু অত্যাচার-নিপীড়নে এদের সংখ্যা কমতে থাকে। এমনকি ১৩৫৩ সালে মওলানা আফছার উদ্দীনের নেতৃত্বে মৌলবাদীরা আক্রমণ চালিয়ে কুষ্টিয়ার ছেউরিয়া আশ্রমে সমবেত লালনপন্থী সমস্ত বাউলদের চুলের ঝুঁটি কেটে নেয়। বাউলদের পক্ষ থেকেও পুস্তিকা প্রকাশ করা হয় শান্তির আবেদন জানিয়ে।  

০৩ 
প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মীয় মৌলবাদের প্রতিরোধে এই লৌকিক সর্বধর্ম সমন্বয়কারী সহজিয়া জীবন পদ্ধতি কতখানি সাফল্য লাভ করেছে, তার সমাজতাত্ত্বিক পরিমাপ করা হয়নি। মৌলবাদ প্রতিরোধে এই হাতিয়ার কতখানি কার্যকর, তা নিয়ে এখনো সন্দেহের অবকাশ রয়েছে।  

যদিও প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের সঙ্গে প্রতিকল্পনায় লৌকিক ধর্মের আপেক্ষিক প্রগতিশীলতার বিষয়টি ধরা পড়ে, তবু তার অর্থ এই নয় যে, শাস্ত্রীয় ধর্মের বদলে সকলে লৌকিক ধর্ম অবলম্বন করলেই আমরা একটি প্রগতিশীল সমাজ পেয়ে যাব।  

তারপরও এসব বাউল-ফকিরই মূল্যবান এই কারণে যে, সচরাচর এর অনুসারীরা হয়ে থাকেন স্থিতধী, তাদের ব্যক্তিত্বে থাকে মাধুর্য ও সহনশীলতা, তারা ধর্মের নামে সব ধরনের হানাহানি থেকে অবস্থান করেন অনেক দূরে এবং সম্প্রদায়গত জীবনে কঠোরভাবে পালন করেন সৌভ্রাতৃত্বের শপথ।  

সেই সঙ্গে বাংলার মাটি-জলের ঐতিহ্য থেকে উঠে আসা নিজস্ব দর্শন ও সংস্কৃতির প্রকাশ হিসেবে আস্কর আলী পণ্ডিতদের রচনার পঠন-পাঠন-অনুশীলন প্রয়োজন। কেননা সমাজমানসে তা কিছু ইতিবাচকতার উপাদান সংযোজনে সাহায্য করে। তার অর্থ, শামসুল আরেফীনের এই স্ব-নিয়োজিত গবেষণা অবশ্যই সাধুবাদের যোগ্য।  

লেখক: বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত সাহিত্যিক

বাংলাদেশ সময়: ১৭১৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৯, ২০১৯
এমএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।