ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

জালিয়াতি করে ডাক্তার হওয়ার চেষ্টা!

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১০১ ঘণ্টা, অক্টোবর ৮, ২০১৮
জালিয়াতি করে ডাক্তার হওয়ার চেষ্টা!

চট্টগ্রাম: বিজিসি ট্রাস্ট মেডিকেল কলেজ। চট্টগ্রামের চন্দনাইশে ২০০২ সালে এটি প্রতিষ্ঠা করেন ইঞ্জিনিয়ার আফসার উদ্দিন আহমেদ। শুরুতে বেশ সুনাম কুড়ালেও শিক্ষার্থী ভর্তিতে অনিয়মের কারণে আলোচনায় এসেছে প্রতিষ্ঠানটি।

সমন্বিত এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে যারা উত্তীর্ণ হন, তাদের মধ্যে আগ্রহী অনেক শিক্ষার্থী এখানে আবেদন করেও ভর্তি হতে পারেন না। টাকার অঙ্কে পিছিয়ে থাকা এসব শিক্ষার্থীর পরিবর্তে ভর্তি হতে পারে যোগ্যতাহীনরা।

এক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের যোগসাজশে নেওয়া হয় বিশেষ কৌশল। উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীর ছবির স্থলে অনুত্তীর্ণ শিক্ষার্থীর ছবি, নাম ও স্বাক্ষর বসিয়ে দেওয়া হয়।

শুধু রাখা হয় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীর রোল নম্বর, মেধাক্রম ও প্রাপ্ত স্কোর।

ন্যূনতম পাস নম্বর ৪০ না পেলেও এভাবে অযোগ্যদের ভর্তি করানো হচ্ছে লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে। মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষের এমন অনিয়মের ঘটনা ফাঁস হয়েছে সম্প্রতি। জালিয়াতি করে ডাক্তার হওয়ার এ চেষ্টায় মদদ দিচ্ছে একশ্রেণির অভিভাবকরা।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ৯টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের মধ্যে বিজিসি ট্রাস্ট মেডিকেল কলেজও একটি। কলেজটিতে ২০০২-০৩ শিক্ষাবর্ষে ৫০টি আসন নিয়ে এমবিবিএস কোর্স শুরু হয়। এরপর ২০১৬ সালে ১২৫টি আসন বাড়ানো হয়। কিন্তু ভর্তিতে নানা অনিয়ম পাওয়ায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ৩৫টি আসন কমিয়ে ৯০টিতে রাখে।

মন্ত্রণালয়ের এমন সিদ্ধান্তের পরও দুর্নীতি ও অনিয়ম বন্ধ হয়নি কলেজটিতে। ২০১২-১৩ ও ২০১৩-১৪ সেশনের ৫১জন শিক্ষার্থীকে ভর্তি করা হয়েছে জালিয়াতির মাধ্যমে। এর মধ্যে ২০১২-১৩ সেশনের আছেন ১২জন আর ২০১৩-১৪ সেশনের ৩৯জন। এছাড়া কম স্কোর পেয়ে আরও ৯ শিক্ষার্থীকেও ভর্তি করা হয় ২০১২-১৩ সেশনে। সব মিলিয়ে ৬০জন শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে ভর্তিতে অনিয়মের ঘটনা ধরা পড়েছে।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) এ অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে। যার প্রেক্ষিতে ৪ অক্টোবর বিএমডিসির রেজিস্ট্রার স্বাক্ষরিত ১৮ পৃষ্ঠার একটি নথি বিজিসি ট্রাস্ট মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষের কাছে পাঠানো হয়। যেখানে ওই কলেজে ভর্তি হওয়া এসব শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ আনা হয়। পরে এর অনুলিপি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা অনুষদের ডিন, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ও রেজিস্ট্রারের কাছেও পাঠানো হয়।

এর প্রেক্ষিতে ঘটনা তদন্তে রোববার (০৭ অক্টোবর) একটি কমিটিও গঠন করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

সূত্র জানায়, শুধু ২০১২-১৩ ও ২০১৩-১৪ সেশন নয়, ২০০৮ সাল থেকেই এমন দুর্নীতি ও জালিয়াতি করে আসছে কলেজ কর্তৃপক্ষ। এরকম জালিয়াতির মাধ্যমে ভর্তি হয়ে অনেকে এমবিবিএস পাস করে বেরও হয়ে গেছেন।

যে ৬০ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে বিএমডিসি অনিয়ম পেয়েছে তারা পঞ্চম বর্ষে অধ্যয়নরত। কলেজটির দুর্নীতির সুযোগের কবলে পড়ে তাদের শিক্ষাজীবন এখন হুমকির মুখে।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ও চবি চিকিৎসা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. সেলিম মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর বাংলানিউজকে বলেন, বিএমডিসি থেকে যে চিঠি পেয়েছি সেখানে ওই কলেজের ৫১ শিক্ষার্থীকে জালিয়াতির মাধ্যমে এবং কম স্কোর পাওয়া ৯ জনকে ভর্তি করা হয়েছে। তারা উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীর ছবির স্থলে অনুত্তীর্ণ শিক্ষার্থীর ছবি, স্বাক্ষর ব্যবহার করে এ জালিয়াতি করেছে।

বিজিসি ট্রাস্ট মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. এসএম তারেক বাংলানিউজকে বলেন, ৬০ জন শিক্ষার্থীর দুর্নীতির ব্যাপারে আমি জানি না। তবে কিছু গরমিল পেয়েছি। যদি এসব শিক্ষার্থীর ভর্তিতে গরমিল পাওয়া যায়, তাদের ছাত্রত্ব বাতিল করা হবে।

চবি অধিভুক্ত ৯টি কলেজকে ১০দিনের সময়

বিজিসি ট্রাস্ট মেডিকেল কলেজে ভর্তিতে জালিয়াতি ও দুর্নীতির অভিযোগ আসার পর আন্তর্জাতিক ইসলামিক মেডিকেল কলেজ, ইউনাইটেড কেয়ার ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল টেকনোলজি, ইস্টার্ন মেডিকেল কলেজ, বিজিসি ট্রাস্ট মেডিকেল কলেজ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া মেডিকেল কলেজ, ময়নামতি মেডিকেল কলেজ, মেরিন সিটি মেডিকেল কলেজ, সাউদার্ন মেডিকেল কলেজ ও সেন্ট্রাল মেডিকেল কলেজকে ১০ দিন সময় দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এসব কলেজের সব শিক্ষার্থীর জন্য বিএমডিসির রেজিস্ট্রেশন আনতে হবে এ সময়ের মধ্যে।

ডা. সেলিম মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর বাংলানিউজকে বলেন, যারা এ সময়ের মধ্যে বিএমডিসির রেজিস্ট্রেশন পাবে না তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেশনাল পরীক্ষায় অংশ নিতে দেওয়া হবে না।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী বলেন, বিজিসি ট্রাস্ট মেডিকেল কলেজের দুর্নীতি তদন্তে কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্তে যাদের নাম আসবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বিএমডিসির ওপর ক্ষোভ শিক্ষকদের

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক শিক্ষক বাংলানিউজকে জানান, বিএমডিসি থেকে মেডিকেল কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ভেরিফিকেশন প্রয়োজন হয়। একজন শিক্ষার্থী ভর্তি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিএমডিসি থেকে রেজিস্ট্রেশন নিয়ে আসতে হয়। একে বলে স্টুডেন্ট লাইসেন্স।

যদি কোনো শিক্ষার্থীর বিএমডিসির লাইসেন্স না থাকে তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম প্রফেশনাল পরীক্ষাও দিতে পারে না। প্রথম পেশাগত পরীক্ষা দেওয়ার আগেই বিএমডিসি প্রত্যেক শিক্ষার্থীর লাইসেন্স দেয়। পরে ওই শিক্ষার্থী পঞ্চম বর্ষের পরীক্ষা দিয়ে এমবিবিএস সনদ পায়। ইন্টার্নশিপ করার পর দেওয়া হয় স্থায়ী রেজিস্ট্রেশন নম্বর।

কিন্তু ব্যবসায়িক স্বার্থে এসব নিয়ম না মেনে ইচ্ছেমতো শিক্ষার্থী ভর্তি করা হচ্ছে। পঞ্চম বর্ষের আগে রেজিস্ট্রেশনের জন্য আবেদন করতে গিয়ে এ অনিয়ম ধরা পড়ছে।

বিএমডিসির তদারকি না থাকায় বিজিসি ট্রাস্ট মেডিকেল কলেজের ৬০ শিক্ষার্থী পঞ্চম বর্ষ পর্যন্ত পড়তে পেরেছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৫৪০ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৮, ২০১৮
জেইউ/এসি/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।