ঢাকা, শনিবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

‘ওপারে ভালো থেকো রমাদি’

মিজানুর রহমান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৪২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৪, ২০১৮
‘ওপারে ভালো থেকো রমাদি’ রমা চৌধুরী এ বসতভিটায় অনাথ আশ্রম গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। ছবি: বাংলানিউজ

বোয়ালখালী থেকে ফিরে: বীরাঙ্গনা রমা চৌধুরীর মরদেহ তখনও নিজ গ্রাম পোপাদিয়ায় এসে পৌঁছায়নি। এর আগেই তার বাড়িতে ভিড় করতে শুরু করেন প্রতিবেশীসহ আশপাশের বিভিন্ন গ্রামের মানুষ।

তাদের কেউ রমা চৌধুরীকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করছিলেন। কেউ নীরবে চোখের জল ফেলছিলেন।

আবার কেউবা মুক্তিযুদ্ধের সময় তার ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন করা রাজাকারদের এলাকায় স্বদর্পে চলাফেরা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছিলেন।

আরও খবর>>
** 
চির নিদ্রায় শায়িত রমা চৌধুরী

তবে সব কিছু ছাপিয়ে রমা চৌধুরীর জন্য একজন অশীতিপর বৃদ্ধার বিলাপ চোখে পড়ছিল সবার।

যিনি শরীরের সব শক্তি দিয়ে কিছুক্ষণ পরপর বলার চেষ্টা করছিলেন, রমাদি (রমা চৌধুরী) বড় অভিমান নিয়ে তুমি চলে গেলে। জীবনের এপারে তোমার সুখ কেড়ে নেওয়া হলো। প্রার্থনা একটাই, পরপারে ভালো থেকো দিদি।

বিমলা চৌধুরী নামের ওই বৃদ্ধা রমা চৌধুরীর জেঠাতো ভাইয়ের স্ত্রী। বিকেলে রমা চৌধুরীর মরদেহ যখন সমাহিত করার কাজ চলছে, শ্মশানের পাশেই পি‍ঁড়িতে বসে চুপচাপ বসেছিলেন তিনি। এ সময় তার সঙ্গে কথা হয় বাংলানিউজের।

বিমলা চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধে সব হারিয়ে দিদি একেবারে নিঃস্ব হয়ে পড়েন। আত্মীয়-স্বজনদের অনেকে তাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করেন। তবে তিনি কারও কাছে হাত পাতেননি। ছোট হননি। এক বেলা পান্তা ভাত আর কাঁচামরিচ দিয়ে তার কত দিন যে কেটেছে তা সৃষ্টিকর্তা ছাড়া বলা মুশকিল।

তিনি বলেন, এতো অভাব-অনটনের মধ্যেও প্রতিবেশীদের প্রতি দিদির দরদ ছিল সীমাহীন। তিনি গরুর দুধ খেতে খুব পছন্দ করতেন। এ কারণে রোজ আধা সের গরুর দুধ নিতেন। কিন্তু পাশের বাড়ির এক বৃদ্ধা অসুস্থ হয়ে পড়লে তার নেওয়া আধা সের গরুর দুধ থেকে রোজ অর্ধেক তাকে দিয়ে দিতেন। প্রতিবেশীর প্রতি দিদির এরকম দরদের কথা বলে শেষ করা যাবে না।

বিমলা চৌধুরী বলেন, পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে সম্ভ্রম হারানোর পরেও দিদির মনোবল ভেঙে পড়েনি। প্রতিবেশীদের অনেকে এ নিয়ে তাকে কটাক্ষ করলেও তিনি এসবে পাত্তা দিতেন না। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক হানাদার বাহিনীর নির্মম নির্যাতনের কথা তিনি তরুণ প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে চাইতেন। দিদির ইচ্ছে ছিল, লেখালেখির পাশাপাশি এলাকায় একটি অনাথ আশ্রাম গড়ে তোলার। কিন্তু তার স্বপ্নের বাস্তব রূপ দিয়ে যেতে পারেননি দিদি।

মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী কঠিন দিনগুলোতে দিদির সঙ্গে থাকার নানা স্মৃতি নাড়া দিচ্ছে। বড় কষ্ট পাচ্ছি। শেষ সময়ে দিদি শহরে চলে গেলেও আমাদের হৃদ্যতা কমেনি। গ্রামে এলেই পরম মমতায় জড়িযে ধরতেন। দিদি আবার এলেন- কিন্তু আর জড়িয়ে ধরলেন না। মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন না। বলতে বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন বিমলা চৌধুরী।

১৯৩৬ সালের ১৪ অক্টোবর চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার পোপাদিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ‘একাত্তরের জননী’ খ্যাত রমা চৌধুরী। সোমবার (০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮) ভোর সাড়ে ৪টার দিকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।

বিকেলেই নিজ গ্রাম বোয়ালখালী উপজেলার পোপাদিয়া গ্রামে ছেলে দীপংকর টুনুর সমাধির পাশে তাকে সমাহিত করা হয়।

বাংলাদেশ সময়: ১৫৩০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৪, ২০১৮
এমআর/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।