ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১, ০৭ মে ২০২৪, ২৭ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

জুপিটার হাউসেই স্বাধীনতা ঘোষণা প্রচারের সিদ্ধান্ত

তপন চক্রবর্তী, ব্যুরো এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪০৫ ঘণ্টা, মার্চ ২৫, ২০১৮
জুপিটার হাউসেই স্বাধীনতা ঘোষণা প্রচারের সিদ্ধান্ত এ মাইক্রোফোন দিয়ে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারিত হয়। ছবি: উজ্জ্বল ধর, বাংলানিউজ

চট্টগ্রাম: একাত্তরের পঁচিশে মার্চ মধ্যরাতে ঢাকা থেকে বঙ্গবন্ধুর ‘স্বাধীনতা ঘোষণা’ প্রথম এসেছিল জহুর আহমদ চৌধুরীর বাসার টেলিফোনে। তার স্ত্রী ডা. নুরুন্নাহার জহুর টেলিফোন রিসিভ করে ইংরেজি ম্যাসেজটি লিখে নেন। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে বেশ কয়েকটি কপি করে বিভিন্ন স্থানে ‍পাঠিয়ে দেন।

জহুর আহমদ চৌধুরীর ছেলে মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী বর্তমানে মহানগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি। তার ওই দিনের স্মৃতিচারণ ছাপানো হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের গবেষক মুহাম্মদ শামসুল হকের ‘স্বাধীনতার বিপ্লবী অধ্যায় বঙ্গবন্ধু ও অন্যান্য ৪৭-৭১’ বইতে।

যাতে তিনি বলেছেন, ‘আমি তখন কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র। বয়স অল্প।
তবুও বাবার সংগ্রামী রাজনৈতিক জীবনের অনেক কিছুই আমার চেতনাকে নাড়া দিত। মার্চের ২৫ তারিখ রাতে দেশের পরিস্থিতি ছিল বারুদের মতো। কী ঘটতে যাচ্ছে বা শেখ সাহেব কী ঘোষণা দিচ্ছেন তাই নিয়ে সবাই চিন্তিত এবং বিচলিত ছিল। বাবা সম্ভবত, ওয়াপদা রেস্ট হাউসে ছিলেন। রাত প্রায় ১১-১২টা হবে। আমাদের টেলিফোনে একটি কল আসল। আম্মা ফোন রিসিভ করে তাড়াতাড়ি ইংরেজিতে কতগুলো কথা লিখে নিলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে বাবাকে জানালেন, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। পাঞ্জাবিরা বাঙালিদের হত্যা শুরু করেছে। ২৫ মার্চ রাতে বাবা ওয়াপদা রেস্ট হাউস থেকে সবদিকে যোগাযোগ করে বিভিন্ন নির্দেশ দেন। আম্মা রাতের বেলা থেকেই স্বাধীনতার ঐতিহাসিক ঘোষণাটি সলিমপুর ওয়্যারলেস স্টেশনে পাঠান এবং বাইরের দুনিয়ায় প্রচার করতে অনুরোধ করেন। ’

একটি কপি দ্রুত তা নিয়ে যাওয়া হয় পাথরঘাটার জুপিটার হাউসে। সেখানে জহুর আহমদ চৌধুরী, এমআর সিদ্দিকী ও আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু বৈঠক করেন। তারা সিদ্ধান্ত নেন ম্যাসেজটি দ্রুত ভারতে পাঠাতে হবে। এর জন্য প্রথমে রামগড় পৌঁছাতে হবে। সেখান থেকে ভারতে সহজেই পৌঁছে যাবে। রাত দুইটায় ম্যাসেজটি রামগড় থানার ওসি আবদুল মান্নান চৌধুরীকে জানিয়ে দেন আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু। তিনি নিজে গিয়ে ওপারের ত্রিপুরা রাজ্যের সাবরুম থানার ওসি মি. মুখার্জির হাতে পৌঁছে দিয়ে রামগড়ে ফিরে আসেন।

মুক্তিযুদ্ধের গবেষক ও ‘মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম শহর’ বইয়ের লেখক জামাল উদ্দিন বাংলানিউজকে জানান, এমএ হান্নান, এমএ মান্নান ও ইদরিস আলম আন্দরকিল্লা আওয়ামী লীগ কার্যালয় বিনোদা ভবনে বসে ম্যাসেজটি অনুবাদ করেন। এ সময় ছাত্রনেতা মোখতার আহমদ, সাবের আহমদ আজগরী প্রমুখ ছিলেন। ২৫ মার্চ রাতে অনুবাদটি সাইক্লোস্টাইলে কপি করে পুরো শহরে বিলি করেন। মাইকে প্রচার করেন এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী, অমল মিত্র, সন্তোষ ধরসহ অনেকে।     

সেই বার্তায় ছিল ‘‘ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী অতর্কিতে পিলখানায় ইপিআর ঘাঁটি, রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রমণ করেছে এবং শহরের লোকদের হত্যা করছে। ঢাকা-চট্টগ্রামের রাস্তায় যুদ্ধ চলছে। আমি বিশ্বের জাতিসমূহের কাছে সাহায্যের আবেদন করছি। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা বীরত্বের সঙ্গে মাতৃভূমি মুক্ত করার জন্য শত্রুদের সাথে যুদ্ধ করছে। সর্বশক্তিমান আল্লাহর নামে আপনাদের কাছে আমার আবেদন ও আদেশ, দেশকে স্বাধীন করার জন্য শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে ‍যান।

আপনাদের পাশে এসে যুদ্ধ করার জন্য পুলিশ, ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও আনসারদের সাহায্য চান। কোনো আপস নেই, জয় আমাদের হবেই। আমাদের পবিত্র মাতৃভূমি থেকে শেষ শত্রুকে বিতাড়িত করুন। সকল আওয়ামী লীগ নেতা, কর্মী এবং অন্যান্য দেশপ্রেমিক ও স্বাধীনতাপ্রিয় লোকদের এই সংবাদ পৌঁছে দিন। আল্লাহ আপনাদের মঙ্গল করুন। –শেখ মুজিবুর রহমান। ’’

ছাব্বিশে মার্চ সকালে জুপিটার হাউসে বেতার চালুর ব্যাপারে সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করেন কবি বেলাল মোহাম্মদ। প্রথমে সিদ্ধান্ত হয় জহুর আহমদ চৌধুরী, অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরী, এমআর সিদ্দিকীসহ চট্টগ্রামের তৎকালীন এমপিদের মধ্যে যারা শহরে আছেন তারা রেডিও স্টেশনে যাবেন এবং নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের পক্ষে জহুর আহমদ চৌধুরী তা বেতারে প্রচার করবেন। প্রথমে আগ্রাবাদ রেডিও স্টেশন থেকে প্রচারের সিদ্ধান্ত নিলেও কর্ণফুলী নদীর কাছে হওয়ায় নিরাপত্তার কারণে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র পছন্দ করা হয়। ছাব্বিশে মার্চ দুপুর ১টা ১০ মিনিটে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রথম অধিবেশন সম্প্রচার হয়। রাখাল চন্দ্র বণিকের পরিচালনায় সংক্ষিপ্ত এ অধিবেশনে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক এমএ হান্নান।

এরপর ৭টা ৪০ মিনিটে, রাত ১০টায়, ২৭ মার্চ সকাল সাড়ে ১০টায় ও সন্ধ্যা ৭টায় আরও চারটি অধিবেশন প্রচারিত হয়। এরপর সন্ধ্যা ৭টা ৪০ মিনিটে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে মেজর জিয়াউর রহমানের কণ্ঠে প্রচারিত হয় ‘আই মেজর জিয়া অন বিহাফ অব আওয়ার গ্রেট ন্যাশনাল লিডার অব বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডু হিয়ারবাই ডিক্লার ইনডিপেনডেন্স অব বাংলাদেশ...জয় বাংলা। ’

স্বাধীনতার ‘ঘোষণা’ যে বেতার কেন্দ্রে সেটি এখন নিঃস্ব!

বাংলাদেশ সময়: ১৯৪১ ঘণ্টা, মার্চ ২৫, ২০১৮

টিসি  

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।