নগরীতে তালাকের ঘটনা বেড়ে যাওয়ার কারণ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট (যুগ্ম জেলা জজ) জাহানারা ফেরদৌস বাংলানিউজকে এভাবেই বলছিলেন।
তিনি মনে করেন, মাদক ও স্মার্টফোনে আসক্তি, স্ত্রীকে সময় না দেওয়া, সংসারের প্রতি দায়িত্ববোধ না থাকা, পরকীয়া, বউ-শাশুড়ির দ্বন্দ্ব, পরকীয়া, প্রবাসীদের উদাসীনতা, বাবা-মা-ভাই-বোনের প্রতি অন্ধবিশ্বাস, সন্তানের প্রতি ভালোবাসার অভাব, যৌথ পরিবার কমে যাওয়া, নিউক্লিয়ার (একক) ফ্যামিলির সংখ্যা বাড়া, টনটনে আত্মসম্মান বোধ, যৌতুক, তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ ইত্যাদি কারণে তালাকের ঘটনা বাড়ছে।
আলাপচারিতার একপর্যায়ে তিনি বলেন, নগরীর একটি কমিউনিটি সেন্টারে বিয়ের খাবার মজা না হওয়ার মতো তুচ্ছ ঘটনায় একটি বিয়ের আসর থেকে চলে যায় বরপক্ষ। ছেলেটি ব্যবসায়ী, মেয়েটি শিক্ষক।
চসিক সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এক বছরে চসিকের ১৬টি থানায় ৮৪৯টি তালাক কার্যকর হয়েছিল। নতুন-পুরোনো মিলে মোট তালাক নোটিশ জমা পড়েছিল ৪ হাজার ৯৪৯টি। ২০১৭ সালে তালাক কার্যকর হয় ১ হাজার ২৭টি। আবেদন জমা পড়েছিল ৪ হাজার ৮২৫টি। এর মধ্যে প্রত্যাহার হয়েছে ১২১টি, খারিজ হয়েছে ৩৮৪টি, অর্থাৎ নিষ্পত্তি হয়েছে ১ হাজার ৫৩২টি। ২০১৬ সালে নিষ্পত্তির এ সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৩৫০টি, প্রত্যাহার হয় ১১৫টি, খারিজ হয় ৩৯৬টি। ৯০ দিন অতিক্রান্ত সূত্রে বিচারাধীন মামলা ছিল ২ হাজার ৫৪৪টি।
সালিসি মামলা পরিচালনার জন্য চসিকের থানাগুলোকে দুই ভাগ করা হয়েছে। ‘আদালত ১’র অধীন হচ্ছে ডবলমুরিং, বন্দর, পতেঙ্গা, ইপিজেড, হালিশহর, পাহাড়তলি, খুলশী ও আকবর শাহ। এর মধ্যে বেশি তালাকের নোটিশ আসে পতেঙ্গা-ইপিজেড এলাকা থেকে। ‘আদালত-২’র অধীন থানাগুলো হচ্ছে কোতোয়ালি, সদরঘাট, চান্দগাঁও, পাঁচলাইশ, চকবাজার, বাকলিয়া, বায়েজিদ ও কর্ণফুলী। এর মধ্যে বায়েজিদ এলাকাতেই তালাকের ঘটনা বেশি।
উচ্চবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণিতে সাংসারিক বাঁধন শীতল হয়ে পড়ছে উল্লেখ করে জাহানারা ফেরদৌস বলেন, তারা সন্তানের ভবিষ্যৎ চিন্তা করছে না। ব্রোকেন ফ্যামিলির সন্তানদের যে স্টিকার লেগে যাচ্ছে সে ব্যাপারে বাবা-মা উদাসীন। সন্তানের ভালো চেয়ে, নিজেরা একটু ত্যাগ স্বীকার করবে সেই মানসিকতা নেই। মানবিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ, বয়োজ্যেষ্ঠ স্বজনদের শাসন কমে যাচ্ছে। বাচ্চার সামনে স্বামী যদি স্ত্রীর গায়ে হাত তোলে তবে বাচ্চা ট্রমার মধ্যে বড় হয়।
তিনি মনে করেন ৫ শতাংশ ক্ষেত্রে তালাক প্রয়োজন। ডিভোর্স তাদের জন্য রাইট। ৯৫ ভাগ ক্ষেত্রে আপসরফা করা সম্ভব। এক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায় কনে পক্ষের দূরদর্শিতার অভাব। তারা অনেক সময় মামলা করে স্বামী, বৃদ্ধ শ্বশুর-শাশুড়ি-ননদ-দেবরকে বিচারের কাঠগড়ায় তোলেন, কারাগারে পাঠান। এক্ষেত্রে ওই স্বামী পক্ষ তালাক কার্যকরে অনড় থাকে। তাই আইনজীবীদের উচিত উভয়পক্ষকে ডেকে কাউন্সেলিং করা।
আইনজীবী মুরশীদা বেগম বেবীও মনে করেন, মোবাইল ফোনে এসএমএস পাঠানো, ফোন এনগেজ পাওয়া থেকে শুরু করে তরকারিতে লবণ কম হওয়ার মতো তুচ্ছ বিষয় নিয়েও তালাক নোটিশ ইস্যু হচ্ছে। খুঁটিনাটি বিষয়, খুনসুঁটি থেকেও তালাকের মতো চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হচ্ছেন অনেক স্বামী-স্ত্রী। তবে আমি চেষ্টা করি প্রথম দিকেই যেন সমঝোতা করে দিতে পারি।
তিনি মনে করেন, কাবিনের টাকা বেশি ধরাটাও বিচ্ছেদে আগ্রহ সৃষ্টি করছে অনেক নবদম্পতিকে।
বাংলাদেশ সময়: ২২১০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০১৮
এআর/টিসি