ঢাকা, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

সেই ‘লোভী ডাক্তার’র ভালোবাসার গল্প

আল রাহমান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৫৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১৮
সেই ‘লোভী ডাক্তার’র ভালোবাসার গল্প সেই ‘লোভী ডাক্তার’র ভালোবাসার গল্প

চট্টগ্রাম: নিজেকে ‘লোভী ডাক্তার’ আখ্যা দিয়েছিলেন চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন আজিজুর রহমান সিদ্দিকী। বুধবার (১৪ ফেব্রুয়ারি) ভালোবাসা দিবসে চিরকুমার এ চিকিৎসক বাংলানিউজকে শুনিয়েছেন অন্যরকম এক ভালোবাসার গল্প। তার আগে ‘লোভী ডাক্তার’র আত্মস্বীকৃতিটুকু বলা যাক।

‘‘আমি একজন লোভী (?) ডাক্তার। আমার প্রেমিকা নাই, বৌ নাই, চট্টগ্রাম জেলার সিভিল সার্জন হলেও সরকারি বাসা নাই, বেতন ছাড়া আর কোন ইনকাম নাই, অফিসে কোন উপরি নাই (এসেই বন্ধ করে দিয়েছি), ট্রেনিংয়ের সম্মানীর টাকা ও বেতনের টাকা দিয়া সরকারি প্রটোকলের মেহমানদারী করি, প্রাইভেট প্র্যাকটিস করি না দীর্ঘ বছর, যখন করতাম তখন বিশ রোগী দেখেও পাঁচশ টাকা হত না, জীবনে কোন ক্লিনিক থেকে এক টাকাও কমিশন খাইনি, চব্বিশ বছর কুমিল্লায় বিএমএর নেতা ছিলাম-শত সহস্র ডাক্তারের তদবির করেছি-এক টাকাও নেই নাই, নিজের কোন বাড়ি-গাড়ি নাই, নিজের নামে এ পৃথিবীর এক ইঞ্চি জায়গাও নাই, বৌ-বাচ্চা সংসার নাই, মা নাই-খালার বাসায় খাই, পেনশনের টাকা দিয়া গ্রামের বাড়িতে এতিমখানা করব ভাবছি এবং শেষ জীবনটা এতিম শিশুদের সাথেই কাটাব ভাবছি, বুড়ো বয়সে গ্রামের বাড়িতে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করব এক শর্তে যেন রোগীরা পালা করে এই চিরকুমার কে তিনবেলা খাবার দেয়, আমার মত এত বড় লোডী (?) ডাক্তার বাংলাদেশে নাই? তবে লোভটা আমার মানুষের ভালোবাসার প্রতি-ভালোবাসার জন্যই আমি ‘চিরকুমার’, মায়ের ভালোবাসার লোভেই বঙ্গবন্ধু কন্যাকে মায়ের চোখে দেখি, খালাকে মা জ্ঞান করে সুখে আছি, ভালোবাসার লোভেই ফেসবুকে বিশ্বজুড়ে হাজার হাজার বন্ধু আমার, ভালোবাসার লোভেই আমি এ পৃথিবীতে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে পারি।

মৃত্যুর পর আল্লাহপাক আমার গুনাহ মাফ করলে ইনশাআল্লাহ বলব, আল্লাহ, আমি বেহেশত চাই না, শুধু অনন্তকাল তোমার ভালোবাসা চাই। (আমার মত  লোভী ডাক্তার ইহকালে-পরকালে নাই? আমিন)।
’’

ভালোবাসা প্রসঙ্গ উঠতেই ডা. আজিজ বললেন, আমি মনে করি মানুষকে ভালোবাসার চেয়ে বড় আনন্দ বা ইবাদত আর নেই। মানুষ আছে বলেই পৃথিবী এত সুন্দর হয়েছে। যদি পৃথিবী স্বর্গ হতো এবং সেই স্বর্গে মানুষ না থাকত তবে সেটি এমন সুন্দর হতো না। আমি মেয়েদের নারী হিসেবে না দেখে মানুষ হিসেবে দেখার চেষ্টা করি। তাই মেয়েদের প্রতি আমার কোনো আকর্ষণ-বিকর্ষণ নেই। মনের মতো কাউকে পাইনি বলে বিয়ে করিনি, সামাজিক কারণে বিয়ে করতে চাইনি। আমরা ১১ ভাই-বোনের মধ্যে চার ভাই, এক বোনই ডাক্তার। এক ভাই ইঞ্জিনিয়ার। এক বোন শিক্ষক। বাকি চার বোন সমাজকর্মী ও গৃহিণী।

চট্টগ্রামের পশ্চিম মাদারবাড়িতে জন্ম ডা. আজিজের। প্রথম স্কুলও এখানেই। সেই স্মৃতি তুলে ধরলেন, ‘প্রথম দিন স্কুলে গিয়ে দেখি খাতা না আনায় শিক্ষক সামনের বেঞ্চের ছাত্রদের গরুর মতো পেটাচ্ছেন। ভাবলাম এরপর আমাদের বেঞ্চেও মারধর শুরু করবেন। যেই ভাবনাটি মাথায় এলো অমনি বই-খাতা বুকে চেপে ধরে দিলাম দৌড়। একেবারে বাসায়। তারপর আর ওই স্কুলে যাইনি। ’

সেই বেদনা থেকে শিশুদের জন্য, প্রবীণদের জন্য কিছু করতে চান সিভিল সার্জন। বললেন, ‘আমাদের পৈতৃক বাড়ি ৬ একর জায়গার ওপর। অবসরকালীন যে টাকা পাব তা দিয়ে সেখানে অত্যাধুনিক বৃদ্ধাশ্রম ও এতিমখানা করব। আমি নিজেই সেই বৃদ্ধাশ্রমে থাকব। এতিমরা পড়াশোনা করবে, অবসরে আমাদের সঙ্গে খেলবে। ’

কুমিল্লায় থাকাকালে গড়েছিলেন চিরকুমার সমিতি। একপর্যায়ে সমিতির প্রধান উপদেষ্টাই বিয়ে করে বসলেন। সে প্রসঙ্গে বললেন, ’৩০ বছর পর্যন্ত ঢাকা মেডিকেলে পড়াশোনার চাপে ছিলাম। প্রেম-ভালোবাসার ফুরসত পাইনি। তারপর ৩৫ বছর পর্যন্ত কেটে গেল সংগঠন, সামাজিক অনুষ্ঠান ইত্যাদিতে। পরিবার থেকে বিয়ের চাপ ছিল। আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবার, আর্থিক সংকট মোকাবেলার টানাপোড়নও ছিল। মা চেয়েছিলেন ডাক্তার ছেলেকে বড় ঘরের মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দেবেন। আমি রাজি হইনি। একপর্যায়ে সিদ্ধান্ত নিলাম চিরকুমার থাকব। প্রধান উপদেষ্টার বাসাতেই এক আড্ডায় সমিতি করলাম। প্রথমে সমিতির নাম ছিল কৃষ্ণকলি। সবাই বললেন, এ নামে তো অবিবাহিতদের সমিতি বোঝা যায় না। তখন চিরকুমার সমিতি করলাম। প্রথমে ৩৫ জন সদস্য ছিল। পরে দুইজন বিয়ে করে ফেলল। এরপর নিয়ম করলাম ৪০ বছরের কম বয়সীদের সদস্য পদ দেওয়া যাবে না। পরে দেখলাম প্রধান উপদেষ্টাই বিয়ে করে বসলেন। তারপর বর্ধিত সভা করে সিদ্ধান্ত হলো ১০০ বছরের নিচের কাউকে প্রধান উপদেষ্টা করা যাবে না। পেলাম ১০৪ বছর বয়সী একজনকে। ’

বলতে বলতে চোখ ছলছল করে উঠল ডা. আজিজের। বললেন, ‘আমি প্রকৃতিকে ভালোবাসি। ফুলকে ভালোবাসি। সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি শিশুদের। তাদের আদর করলে, হাসিমুখ দেখলে, সহজ-সরল আচরণ দেখলে মন ভরে যায়। তাইতো রোহিঙ্গা শিশুদের টিকা, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে গহিন অরণ্যে কাদা-পানি পেরিয়ে মাইলের পর মাইল হেঁটে যাই, সীতাকুণ্ডের ত্রিপুরাপল্লি, জেলেপল্লিতে ছুটে যাই। একজীবনে শুধু শিশুদের ভালোবেসেই যেতে চাই। কারণ আমি মনে করি, ভালোবাসা দেওয়ার মধ্যে সুখটা ৯৯ ভাগ, পাওয়ার মধ্যে মাত্র ১ ভাগ। ’

বাংলাদেশ সময়: ১৭৪৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১৮

এআর/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।