ঢাকা, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

চাক্তাই খালের ‘পাকা তলা’ ভাঙার সুপারিশ তরুণ স্থপতিদের

আল রাহমান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১০২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৯, ২০১৮
চাক্তাই খালের ‘পাকা তলা’ ভাঙার সুপারিশ তরুণ স্থপতিদের চাক্তাই খালের ‘পাকা তলা’ ভাঙার সুপারিশ করেছেন প্রিমিয়‍ার বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ স্থপতিরা। ছবি: বাংলানিউজ

চট্টগ্রাম: চাক্তাই খালের দখল, দূষণ আর জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তির জন্য খালের পাকা তলা ভাঙার সুপারিশ করেছেন প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের একদল শিক্ষার্থী। তিন মাস সরেজমিন গবেষণার পর তারা এ সিদ্ধান্তে আসেন।

প্রিমিয়ারের ডিজাইন স্টুডিও গাইড স্থপতি কুহেলী চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে ‘নহর’ শীর্ষক এ গবেষণাকাজে অংশ নেন তানভীরুল হাকিম, যুনায়েদ সাইফ, পায়েল সেনগুপ্তা, জর্জিনা ফারাহ, পুনম দাশ ও সোহানুর ইসলাম সজীব।

তানভীরুল হাকিম বাংলানিউজকে বলেন, পাকা তলা করার সুবিধার চেয়ে অসুবিধাই বেশি।

তাই সী-লেবেল থেকে খালটির গভীরতা ১০ ফুট বেশি রাখার কথা বলেছি। খালের তলা পাকা হওয়ায় এখন আধুনিক প্রযুক্তিতে ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কারে অসুবিধা হচ্ছে, খনন করা যাচ্ছে না, আবর্জনা-পলি-পাহাড়ি বালু জমে ক্রমে ভরাট হয়ে যাচ্ছে, খালের পানি শোষণ ক্ষমতা হারিয়ে গেছে তাই দুই পাশে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে।
এলাকাবাসীকে বৃষ্টির সময় বালতি দিয়ে পানি সংগ্রহ করতে দেখেছি। এ বিষয়ে আমরা নগর পরিকল্পনাবিদ ও পরিবেশবিদদের সঙ্গে কথা বলেছি, তারা স্ট্যান্ডার্ড, লজিক দেখে সিদ্ধান্ত নিতে বলেন।

কুহেলী চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, প্রিমিয়ারের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থীদের আর্বান স্টুডিও থেকে চাক্তাই খাল নিয়ে প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। নগরীর প্রধান সমস্যাগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করি আমরা। শিক্ষার্থীরা অনেক দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে চাক্তাই খাল সরেজমিন পরিদর্শন করেছে। তাদের মতামত তুলে ধরেছে। এক্ষেত্রে আমরা যারা পেশাদার আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতা থাকে। কিন্তু একজন শিক্ষার্থী স্ট্যান্ডার্ড কী, আদর্শ শহর গড়ে তুলতে কী কী করা উচিত তা নির্মোহভাবে তুলে ধরে। চাক্তাই খালকে গবেষণার বিষয় নির্ধারণ করার কারণ হচ্ছে নগরীর প্রধান সমস্যা জলাবদ্ধতা। জলাবদ্ধতার অনেক কারণ আছে। নগরীর খালপথে ব্যবসা-বাণিজ্য হতো, এখন সেটি হচ্ছে না। খাল দখল হচ্ছে। খালের ওপর বিভিন্ন স্থাপনা করা হচ্ছে। খাপছাড়া দ্রুত নগরায়ণের ফলাফল এটা। শিক্ষার্থীদের এক্ষেত্রে চিন্তাভাবনা কী তা জানতেই এ প্রকল্প।

তিনি মনে করেন, খালের পাকা তলা ভাঙার যে সুপারিশ শিক্ষার্থীরা দিয়েছেন তা যুক্তিযুক্ত। তাদের সুপারিশ বাস্তবায়ন হলে চাক্তাই খালের বহুমুখী ব্যবহার যেমন নিশ্চিত হবে তেমনি নগরীর পরিবেশ-প্রতিবেশও উন্নত হবে।  

খালপাড়ের বাসিন্দা ও এক্স-কাউন্সিলর ফোরামের সদস্যসচিব মুহাম্মদ জামাল হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, ২০০৩-০৪ সালে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন কয়েক ধাপে বহদ্দারহাট থেকে মিয়াখাননগর ম্যাচফ্যাক্টরি খালের মুখ পর্যন্ত তলা পাকা করেছিল। এ সময় খালের একপাশের মাটি সরিয়ে আরেকপাশ পাকা করা হয়। সেই মাটি আর তোলা হয়নি। খালের তলা কত নিচুতে হবে সেটিও মানা হয়নি। পাকা করার পর একবারও সব মাটি তোলা হয়নি। এখনো পাকা তলার ওপর ছয়-সাত ফুট মাটি রয়েছে।

সরেজমিন গবেষণার সময় কী কী সমস্যা দেখতে পেয়েছেন জানতে চাইলে তানভীরুল বলেন, আমরা খালের দুপাশের ব্যবসায়িক স্থাপনা লাল রং। আবাসিক স্থাপনা হলুদ রং। ব্যবসায়িক ও আবাসিকের মিশ্র স্থাপনা কমলা রং দিয়ে চিহ্নিত করেছি। সমস্যার মধ্যে সবার আগে ঐতিহ্য নষ্ট হচ্ছে। নৌপথে ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। নতুন চাঁদ ও পূর্ণ চাঁদ পূর্ণিমায় পানি উঠে। রাত একটায়ও জোয়ারের পানি ঢুকছে বাসা-বাড়িতে। ‍ বাসা-বাড়ির লেবেল থেকে রাস্তা উঁচু করার প্রবণতা বাড়ছে। ড্রেনেজ সিস্টেম না থাকায় খালের পানি ও পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। অনেক বাসা-বাড়ির সুয়্যারেজ লাইন সরাসরি খালে সংযুক্ত করা হয়েছে। খালের পানি শোষণক্ষমতা হারিয়ে ফেলায় পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। জোয়ারের সময় খালের মুখে নিচু সেতু থাকায় এবং ভাটার সময় পানির অভাবে খালে ঢুকতে পারছে না। উভয় সংকট দেখা দিয়েছে। এত বড় খাল থাকার পরও সড়কের ওপর চাপ পড়ছে। অথচ খালটিতে পর্যাপ্ত পানি রাখা গেলে ওয়াটার বাস চালু করা যায়। বহদ্দারহাট থেকে চাক্তাই পর্যন্ত কম সময় ও খরচে সহজ যাতায়াত করতে পারবে। এ ছাড়া প্রতিবছর খাল খননে যে কোটি কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে তা সাশ্রয় হবে।   

তিনি বলেন, পায়ে হেঁটে গুরুত্বপূর্ণ খালটি পরিদর্শনের সুযোগ নেই। দুর্গম জায়গা। বাঁধ, পিলার দিয়ে খালের ওপর স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে। অননুমোদিত স্থাপনার বেশিরভাগই সেমিপাকা। কিছু প্রভাবশালীর অবৈধ পাকা স্থাপনাও আছে।         

গবেষণা প্রকল্পের অন্য সুপারিশগুলো জানতে চাইলে তিনি বলেন, চাক্তাই খাল ছিল নগরীর আশীর্বাদ। অযত্ন-অবহেলায় সেটি এখন অভিশাপে পরিণত হয়েছে। আমরা খালের দুই পাড়ে ১৯৯৫ সালের মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী ২০ ফুট জায়গা ছেড়ে দিতে বলেছি। সেখানে পথচারীদের জন্য ৭ ফুটের রাস্তা, ৪ ফুটের সবুজ বাগান ও বসার জায়গা, ড্রেনেজ সিস্টেম করার সুপারিশ করেছি। খালে পানি পড়ার আগে আমরা ট্রিটমেন্ট ও পর্যাপ্ত সিলট্রেপ স্থাপনের কথা বলেছি। ৬ মাইল লম্বা খালটিতে যে পরিমাণ বৃষ্টির পানি আসে তার মূল্য ওয়াসার হিসাবে ২০০ কোটি টাকা। এটি নগরীর বেসিন এলাকা। সব পানি এ খালে এসে পড়ে। প্রস্তাবিত মেরিন ড্রাইভ রোড ও কল্পলোক আবাসিকের পেছনে আমরা দুটি ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপনের প্রস্তাব করেছি। আমরা একটি রিজার্ভার করার প্রস্তাব করেছি, যেখানে ১০ লাখ মানুষের জন্য পানি জমা থাকবে।  

স্লুইসগেট দিলে নৌকা স্বাভাবিকভাবে আসতে পারবে না। তাই আমরা একটি অটো সিস্টেমে (মোস) ১২ ফুট পানির লেবেল নিশ্চিত করার কথা বলেছি। চাক্তাই খালের মুখে। লো হাইড ব্রিজগুলো উঁচু করার কথা বলেছি। খাসজমিতে একটি ক্যানেল পোর্ট করার কথা বলেছি। যাতে ওয়াটার বাস, ওয়াটার ট্যাক্সি, নৌকা-সাম্পানের সাহায্যে নৌপথে সহজ যাতায়াত ও বিজনেস প্রতিষ্ঠা করা যায়। আমাদের অনুমান, যদি বৈজ্ঞানিক ভিত্তি ও দূরদর্শী পরিকল্পনা গ্রহণ করা না হয় তবে ২০৮৯ সালে চাক্তাই খাল ও নিম্নাঞ্চল শুধু নয়, দুই নম্বর গেট ও প্রবর্তক মোড়ে নিয়মিত জোয়ার-ভাটার পানি উঠবে।  

বাংলাদেশ সময়: ১৭০০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৯, ২০১৮

এআর/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।