চট্টগ্রাম বন্দরের মূল সংকট তিনটি।
এক. অবকাঠামো, দুই. নাব্যতা; তিন. পরিচালন ব্যবস্থাপনা।
এক।
বন্দরে জাহাজজটের মূল কারণ হচ্ছে অবকাঠামো সংকট।
সমুদ্রপথে কনটেইনার পরিবহনের ৯৮ শতাংশ চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে হয়। মাত্র ২ শতাংশ মংলা বন্দর পরিবহন করে। সরকারি খাতে আমদানি করা সার এবং খাদ্যশস্য খালাসেই মংলা ব্যস্ত থাকে। পায়রা বন্দরে কোনো জাহাজ যাচ্ছে না বললেই চলে।
সংকট শুধু জেটির নয়, সংকট ইক্যুইপমেন্টেরও। পণ্য হ্যান্ডেল করার যন্ত্রপাতিও অপর্যাপ্ত। তার উপর গত রোজার ঈদের আগে দুর্ঘটনায় দুটি গ্যান্ট্রি ক্রেন অচল হয়ে পড়ায় নতুন সংকট তৈরি হয়েছে বন্দরে।
চলতি বছরের মে মাস থেকে তীব্র জাহাজজটে বেহাল হয়ে পড়েছে চট্টগ্রাম বন্দর। বন্দরের বহির্নোঙরে এখন গড়ে ১৫টি জাহাজ অপেক্ষায় থাকছে। জেটিতে জাহাজ ভিড়তে সময় লেগে যাচ্ছে কোনো কোনোটির ক্ষেত্রে ১২ দিন পর্যন্ত। এর জন্য আমদানিকারকদের বাড়তি খরচ গুণতে হচ্ছে প্রতি মাসে গড়ে ৮০ কোটি টাকা। বিশ্বের বিভিন্ন বন্দর থেকে চট্টগ্রামমুখী পণ্য পরিবহনের ভাড়াও বাড়িয়ে দিয়েছে জাহাজ কোম্পানিগুলো। স্বাভাবিকভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমদানিকারক ও শিল্প উদ্যোক্তারা। যার প্রভাব পড়ছে ভোক্তার ওপর।
জাহাজজটের কারণে আমদানি করা পণ্য দেরিতে পাওয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তৈরী পোশাক খাত। পোশাক খাতে বাংলাদেশের প্রতিযোগী দেশগুলোতে বন্দরে জাহাজজটের সমস্যা নেই। কাঁচামাল আমদানি ও তৈরী মাল রপ্তানিতে প্রতিযোগীদের তুলনায় দেশীয় উদ্যোক্তারা এখন গড়ে এক থেকে দুই সপ্তাহ পিছিয়ে পড়েছেন।
দুই।
চট্টগ্রাম বন্দরে পানির গভীরতা বা ড্রাফট ৯ মিটার বলা হলেও এখন সব জায়গায় সেই গভীরতা নেই। কোথাও কোথাও এই গভীরতা ৬ বা ৭ মিটারে নেমে এসেছে। ফলে বড় জাহাজ ভিড়তে পারে না। নাব্যতার সংকটে চট্টগ্রাম বন্দর কার্যত লাইটারেজ জাহাজের বন্দরে পরিণত হয়েছে!
নাব্যতা ছাড়াও দীর্ঘ বন্দর চ্যানেলে যেখানে প্রশস্ততা ও পানির গভীরতা কম সেখানে অনেক সময় জাহাজ আটকা পড়ে চলাচলে সমস্যা তৈরি করে। চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙর জেটি ভেদে ৯ থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরে। এই চ্যানেল পেরিয়ে জেটিতে জাহাজ ভিড়ানো হয়। ১৬ কিলোমিটার লম্বা এই চ্যানেলের প্রশস্ততা ২৫০ থেকে ৪০০ মিটার।
অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. মইনুল ইসলামের মতে, বাংলাদেশে এই মুহূর্তে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ সত্যিকারভাবে ‘ফরজ’ হয়ে গেছে। এখন কোনো গভীর সমুদ্র বন্দরের কাজ শুরু হলেও সত্যিকার অর্থে ব্যবহারযোগ্য করতে চার-পাঁচ বছর লেগে যাবে, অথচ আমরা দেরি করেছি। এই বিলম্ব দেশের অর্থনীতিকে ভোগাবে। বন্দর সুবিধার অভাবে আমদানি-রপ্তানি খরচ বেশি হবে।
চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের সুপারিশ করেছে বিশ্বব্যাংকও। তাই অন্যান্য ‘নফল’ বাদ দিয়ে এই ‘ফরজ’ কাজটি সবার আগে শুরু করা দরকার। তবে কোন অজায়গায় নয়, ড. মইনুলের মতে সেটি প্রকৃতিগত সুবিধার কারণে সোনাদিয়াতে হলেই আখেরে লাভ হবে দেশের।
তিন।
বিশ্বে বন্দর পরিচালন ব্যবস্থাপনায় চারটি মডেল অনুসরণ করা হয়। মডেলগুলো হচ্ছে- পাবলিক সার্ভিস পোর্ট, টুল পোর্ট, ল্যান্ড লর্ড পোর্ট এবং প্রাইভেট সার্ভিস পোর্ট।
‘দক্ষিণ এশিয়ার বন্দরগুলোর প্রতিযোগিতার সক্ষমতা’ শীর্ষক এক প্রতিবেদন সম্প্রতি প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক। এ প্রতিবেদনে চট্টগ্রাম বন্দরের ব্যবস্থাপনা দুর্বলতার জন্য দায়ী করা হয়েছে শতভাগ সরকারি ব্যবস্থাপনাকে। দক্ষিণ এশিয়ার আর কোনো বন্দর সম্পূর্ণভাবে সরকারি ব্যবস্থাপনায় চলে না। চট্টগ্রামই দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র বন্দর যেটি ‘টুল পোর্ট’ পদ্ধতিতে পরিচালিত হয়। টুল পোর্ট হলো এমন একটি পদ্ধতি, যেখানে বন্দর পরিচালনার সব গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকে। বিশ্বের সব উন্নত বন্দর এখন ‘ল্যান্ডলর্ড’ মডেলে পরিচালিত হয়। ল্যান্ডলর্ড মডেলে একটি বন্দরের পরিচালনার বেশিরভাগ কাজ বেসরকারি খাতের মাধ্যমে করা হয়, সরকার শুধু নিয়ন্ত্রক সংস্থার ভূমিকা পালন করে।
আশার কথা।
এই তিন সংকট মোচন করা গেলে সম্ভাবনার নতুন দুয়ার খুলে যাবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। বন্দর কর্তৃপক্ষের পরিকল্পনায় আছে বঙ্গোপসাগরের জেগে উঠা ভূমিতে গভীর ড্রাফটের ‘বে-টার্মিনাল’ নির্মাণ প্রকল্প, পুরানো তিনটি জেটি ভেঙে আধুনিক জেটিসহ নতুন কয়েকটি জেটি নির্মাণ প্রকল্প। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সংগ্রহের পরিকল্পনাও আছে। রয়েছে ‘ল্যান্ডলর্ড’ মডেলে নতুন জেটি ও টার্মিনাল পরিচালনার পরিকল্পনা।
সংকটের মধ্যেই আশার জন্ম। বন্দর নিয়ে যে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করা হয়েছে সেখানে সংকট থেকে বেরিয়ে আসার রূপরেখা আছে। আমরা সেই রেখাপথে গন্তব্যে পৌঁছাতে চাই।
সম্পাদক, সুপ্রভাত বাংলাদেশ