প্রগতিশীল-অসাম্প্রদায়িক এবং সমাজতন্ত্রের দিকে সবসময় ঝুঁকে থাকা মানিক চৌধুরী শেখ মুজিবর রহমানের সঙ্গে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি হয়েছিলেন। পাকিস্তান আমলের সেই অগ্নিগর্ভ সময়ে বারবার কারাবণ করা মানিক চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য ভূমিকা রেখেছিলেন।
মৃত্যুর ৩৬ বছর পরও স্বাধীনতা আন্দোলনে অবদানের রাষ্ট্রীয় কোন স্বীকৃতি পাননি মানিক চৌধুরী। যে আওয়ামী লীগের জন্য মানিক চৌধুরীর এত অবদান, বঙ্গবন্ধুর এই ঘনিষ্ঠ সহচরের অবদান প্রকাশ্যে তুলে ধরতে দলটির ন্যুনতম কোন ভূমিকাও চোখে পড়ে না। বরং এখন যারা আওয়ামী লীগের পতাকা উড়াচ্ছেন, তাদের মধ্যে কয়জন মানিক চৌধুরীকে চিনেন-জানেন, সেই প্রশ্ন মানিক সুহৃদদের।
মৃত্যুর ৩৬ বছর পর এসে প্রশ্ন উঠেছে স্বাধীনতা আন্দোলনের এই বীর সেনানিকে বাঙালি কতটুকু মনে রেখেছে ? বিপ্লবতীর্থ চট্টগ্রাম কি মনে রেখেছে তার সন্তানকে ?
মানিক চৌধুরীকে বিস্মৃতির অতল গহ্বর থেকে তুলে আনার জন্য সম্প্রতি প্রকাশ হয়েছে ‘মানিক চৌধুরী : স্বাধীনতা সংগ্রামের বিস্মৃত নায়ক’ শিরোনামে একটি গ্রন্থ।
সাংবাদিক নাসিরুদ্দিন চৌধুরী সম্পাদিত সেই গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছেন ইতিহাসবিদ মুনতানীর মামুন। ভূমিকার শেষ অংশে তিনি লিখেছেন, এ দেশের মুক্তিসংগ্রাম যে কতজনের রক্ত, অশ্রু দিয়ে গড়া আমরা কতজন তার খবর রাখি। ...স্বাধীনতা শুধু চার অক্ষরের শব্দ মাত্র নয়।
সম্পাদকীয়তে নাসিরুদ্দিন চৌধুরী ক্ষোভ প্রকাশ করে লিখেছেন, মানিক চৌধুরীর প্রয়াণের ৩০ বছর পর তাঁরই আত্মজ (ছেলে) দীপংকর চৌধুরী কাজল। কিন্তু এই কাজটা তো জাতীয়ভাবে উদ্যোগ নিয়ে করা উচিৎ ছিল। কাজল মানিক চৌধুরীর প্রত্যক্ষ উত্তরাধিকার বহন করছে একথা অবশ্যই সত্য, কিন্তু সেটা তো জৈবিক উত্তরাধিকারীত্ব মাত্র। মানিক চৌধুরীর যেটা প্রকৃত উত্তরাধিকার, যাকে আমি বলতে চাই আদর্শিক তথা রাজনৈতিক উত্তরাধিকারীত্ব, সেটা তো আমরা সকলেই বহন করছি। তাহলে দায় কার-মানিকাত্মজের, না বাংলাদেশের তথা বাঙালি জাতির ?
মানিক চৌধুরী ১৯৩০ সালের ১৬ ডিসেম্বর পটিয়া উপজেলার হাবিলাসদ্বীপ গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবারে জন্ম নেন। বাবা ধীরেন্দ্র লাল চৌধুরী এবং মা যশোদা বালা চৌধুরী। পারিবারিক ব্যবসার সূত্রে চট্টগ্রাম শহরের খাতুনগঞ্জের রামজয় মহাজন লেইনে তাদের বাস।
মিউনিসিপ্যাল স্কুল থেকে মেট্রিক পাস করে কোলকাতায় যান পড়াশোনা করতে। বঙ্গবাসী কলেজে পড়া অবস্থায় যোগ দেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে। সেখান থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশের পর বাবার মৃত্যুতে চলে আসতে হয় চট্টগ্রামে। তবে ব্যবসার মধ্যে নিজেকে বেশিদিন রাখতে পারেননি মানিক চৌধুরী। বারবার হেঁটেছেন রাজনীতির পথে।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর মানিক চৌধুরী মওলানা ভাসানীর সান্নিধ্যে আসেন এবং মুসলিম লীগ বিরোধী অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে যোগ দেন।
চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে একজন মানিক চৌধুরী ছিলেন চট্টগ্রামের এম এ আজিজ ও জহুর আহমদ চৌধুরী উভয়ের ঘনিষ্ঠ। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে কাজ করতে গিয়ে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা হয় শেখ মুজিবর রহমানের সঙ্গে। তাকে করা হয় চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের অর্থ সম্পাদক।
বাষট্টির আন্দোলনসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল আন্দোলন, বিশেষ করে ছয় দফা আন্দোলনে ছিলেন সামনের কাতারে। ১৯৬৬ সালের ২০ মে রাতে পাকিস্তান প্রতিরক্ষা আইনে মানিক চৌধুরীকে গ্রেফতার করা হয় এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িয়ে তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনা হয়। কারাগারে চলে অমানুষিক নির্যাতন।
এসময় কারাগারে থাকা আওয়ামী লীগ নেতা ডা.ছৈয়দুর রহমান নির্যাতনে অতীষ্ঠ হয়ে রাজসাক্ষী হতে রাজি হলেও মানিক চৌধুরী ছিলেন ব্যতিক্রম। সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হয়েও সেদিন তিনি মুখ খোলেননি। আদালতে আইনজীবীর তৈরি করা যে জবানবন্দি তিনি উপস্থাপন করেন, তাতে তিনি সরকারপক্ষের সব অভিযোগই অস্বীকার করেছিলেন।
৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি গণঅভ্যুত্থানে মুক্ত হন মানিক চৌধুরী। ২৩ ফেব্রুয়ারি ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে ঢাকায় বঙ্গবন্ধু, মানিক চৌধুরীসহ মুক্তি পাওয়া আগরতলা মামলার সব আসামিকে সংবর্ধনা দেয়া হয়। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই আবারও মানিক চৌধুরীকে গ্রেফতার করা হয়। ছাড়া পান সত্তরের শেষদিকে। ঝাঁপিয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে।
কিন্তু দেশ স্বাধীনের পর মানিক চৌধুরীর অভিজ্ঞতা সুখকর ছিল না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। এমনকি মানিক চৌধুরীকে জেলেও যেতে হয়েছিল।
তাঁকে নিয়ে লেখা গ্রন্থে বিষয়টি উল্লেখ করেছেন মানবতাবিরোধী আর্ন্তজাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত। তিনি লিখেছেন, তাঁর (মানিক চৌধুরী) কাছ থেকে এই ব্যাপারে (বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি) জানার চেষ্টা করেছি। মানিকদা বলেছিলেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাজউদ্দিনের দূরত্ব এবং মোশতাক আহমেদের নৈকট্য তিনি মেনে নিতে পারেননি। বারবার বঙ্গবন্ধুকে সজাগ করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তা সহজভাবে গ্রহণ করেননি।
এমনই এক পর্যাযে মানিক চৌধুরী কৃষক নেতা হাজী মোহাম্মদ দানেশসহ কয়েকজন বামপন্থীকে নিয়ে গঠন করেছিলেন একটি রাজনৈতিক দল-জাতীয় গণমুক্তি ইউনিয়ন। ১৯৭৪ সালের ৩০ মার্চ চট্টগ্রামের লালদীঘির মাঠে এই দলের প্রথম জনসভা হয়। এর পরদিনই বিশেষ ক্ষমতা আইনের মামলায় মানিক চৌধুরীকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠানো হয়।
এক বছরেরও বেশি সময় জেলে থাকার পর ১৯৭৫ সালের মে মাসে হাইকোর্টের এক রিট মামলায় তিনি মুক্তি পেলেও তাকে আবারও আটকাদেশ দেয়া হয়েছিল। জুন মাসে তিনি আটকাদেশ থেকে মুক্ত হন। দেশে তখন বাকশাল নিয়ে তোড়জোড়।
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ছয়দিন পর ২১ আগস্ট ঢাকা বিমানবন্দর থেকে মানিক চৌধুরীকে গ্রেফতার করা হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নিতে সশস্ত্র সংগ্রামে অবতীর্ণ হক তখনকার যুবলীগ নেতা মৌলভী সৈয়দ ও এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। জেল থেকে মানিক চৌধুরী ভারতের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি দিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদকারীদের সহযোগিতার আহ্বান জানান।
মানিক চৌধুরীর সন্তান কাজল তার বাবাকে নিয়ে প্রকাশিত গ্রন্থে লিখেছেন, ১৯৭৭ সালে প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান চট্টগ্রাম কারাগার পরিদর্শনে যান। এসময় মন্ত্রী করমর্দন করতে চাইলে মানিক চৌধুরী হাত সরিয়ে নেন।
জেনারেল জিয়া জাগদল গঠনের সময় সিলেটের এমপি মেসবাহ উদ্দিন সেই দলে যোগদানের প্রস্তাব নিয়ে মানিক চৌধুরীর সঙ্গে হাসপাতালে গিয়ে দেখা করেছিলেন। এসময় মানিক চৌধুরী রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে তাকে বলেন, এটা ক্যান্টনমেন্টের দল। আমি সারাজীবন গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছি। এখন যারা ক্যু করে গণতন্ত্রকে হত্যা করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছে তাদের সঙ্গে কিসের দল, কিসের রাজনীতি ?
পরে ডিজিএফআইর চিফ মেজর জেনারেল নূরুল ইসলাম শিশু দুজনকে একই প্রস্তাব দিয়ে মানিক চৌধুরীর মায়ের কাছে পাঠিয়েছিলেন। রাজি হলে তাকে কারাগার থেকে ছেড়ে দেয়ার কথা বলেছিলেন তারা। মানিক চৌধুরীর মা জেলে গিয়ে দেখা করেন। কিন্তু সন্তানস্নেহে অন্ধ মায়ের প্রস্তাবও সেদিন ফিরিয়ে দিয়েছিলেন মানিক চৌধুরী।
১৯৮০ সালের ১৮ মার্চ জেল থেকে মুক্তি পান মানিক চৌধুরী। ২৯ জুন ভারতের কোলকাতায় চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় মারা যান তিনি।
চলে গেছেন মানিক চৌধুরী আর তাঁর চলে যাওয়ার পরের পরিস্থিতিটুকু হৃদয়গ্রাহী করে বর্ণনা করেছেন অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত।
‘কোলকাতায় সেই যে গেলেন আর ফিরে এলেন না। এলো তাঁর মৃত্যুসংবাদ। মানিকদার সন্তান দীপংকরের কাছ থেকে সংবাদ পেয়ে তার নিজে সংবাদ আকারে লিখে সংবাদপত্রে পাঠালাম। রাজনৈতিক দলের অনেক নেতার কাছে খবরও দিলাম। পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হলো ঠিকই কিন্তু কোন রাজনৈতিক দলের শোক বিবৃতি পত্রিকায় এলো না, মুদ্রিত হলো না-কেবল তাঁরই ঘনিষ্ঠজন (পরবর্তীকালে জাতীয় পার্টির সাংসদ) অ্যাডভোকেট এ কে এম শামসুল হুদা ছাড়া। ’
‘আজীবন ত্যাগী, সংগ্রামী মানিক দার মতো এমন এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের ক্ষেত্রে এ এক নির্মম ট্র্যাজেডি। ’ লিখেছেন রানা দাশগুপ্ত
বাংলাদেশ সময়: ১২৫৭ ঘণ্টা, মার্চ ৩১, ২০১৭
আরডিজি/টিসি