আটক ছাত্রদল নেতা হল নগর ছাত্রদলের চকবাজার থানা শাখার সভাপতি নুরুল আলম শিপু (৩২)। ২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি চকবাজার থানা ছাত্রদলের কমিটির অনুমোদন দিয়েছিলেন নগর ছাত্রদলের সভাপতি গাজি মোহাম্মদ সিরাজ উল্ল্যাহ।
শিপুর বড় ভাই নূর মোস্তফা টিনু নিজেকে যুবলীগ নেতা হিসেবে পরিচয় দেন। নগরীর চকবাজার এলাকায় ছাত্রলীগ-যুবলীগ নামধারী একটি অংশের নিয়ন্ত্রক টিনু।
শিপুকে ছাড়াতে টিনুর নেতৃত্বে তার ছত্রছায়ায় থাকা যুবলীগ-ছাত্রলীগের একদল নেতাকর্মী শনিবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) রাতে প্রায় দুই ঘণ্টা পাঁচলাইশ থানার সামনে অবস্থান নিয়েছিল। টিনু তার ভাইকে ছেড়ে দিতে পুলিশের উপর চাপ প্রয়োগ করে। তবে পুলিশ অনড় অবস্থান নিয়ে এক পর্যায়ে লাঠিচার্জ করে তাদের থানার সামনে থেকে সরিয়ে দেয়।
ছিনতাই মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে শিপুকে সাতদিনের রিমান্ডে নেয়ার জন্য আদালতে আবেদন জানানো হচ্ছে বলে বাংলানিউজকে জানিয়েছেন পাঁচলাইশ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) ওয়ালি উদ্দিন আকবর।
‘ভাই হিসেবে ভাইকে থানায় দেখতে আসতেই পারে। কিন্তু ছাড়ানোর জন্য পুলিশকে তো কেউ চাপ প্রয়োগ করতে পারে না। টিনু সেভাবে আমাদের ডিস্টার্ব করেনি। আর চাপ দিলেও পুলিশের কিছু করার নেই। আমরা তো কোন অন্যায় করিনি। তদন্তে যদি কারও নাম আসে, আমাদের তো তাকে গ্রেফতার করতেই হবে। ’ বলেন ওয়ালি
টিনুর সঙ্গে শনিবার রাতে পাঁচলাইশ থানার সামনে অবস্থান নিয়েছিলেন তার অনুসারী নগর ছাত্রলীগের সহ সভাপতি আবু মোহাম্মদ আরিফও। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, আমি অনুরোধ ফেলতে পারিনি। সেজন্য ঘটনা কি দেখতে গিয়েছিলাম। আমি কোন অপরাধীর পক্ষে যাইনি।
গত ১৫ ফেব্রুয়ারি বেলা ৩টায় নগরীর কাতালগঞ্জ বৌদ্ধ মন্দিরের সামনে থেকে পাঁচ লাখ টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। ছিনতাইয়ের শিকার হাটহাজারী উপজেলার ছিপাতলি গ্রামের সিরাজুল হাকের ছেলে নুর উদ্দিন ইসলাম বাদি হয়ে পাঁচলাইশ থানায় একটি মামলা দায়ের করেন।
মামলার এজাহারে বলা হয়, উত্তরা ব্যাংক খাতুনগঞ্জ শাখা থেকে পাঁচ লাখ টাকা তুলে টেম্পোতে করে যাবার সময় কাতালগঞ্জ নবপন্ডিত বিহারের সামনে ৩-৪ জন যুবক টেম্পোর গতিরোধ করে। এদের মধ্যে একজন ছিনতাইকারী নুর উদ্দিনের শার্টের কলার ধরে টেম্পো থেকে জোর করে নামিয়ে ফেলে। অন্য দুই যুবক নুরকে মারধর করে হাতে থাকা টাকাভর্তি ব্যাগ ও মোবাইল সেট কেড়ে নিয়ে কাতালগঞ্জ চার নম্বর রোডের দিকে পালিয়ে যায়। ঘটনাস্থলের ভিডিও ফুটেজ দেখে পুলিশ অহিদুল ইসলাম ওরফে আরিফ ও চান মিয়া ওরফে মামুন নামে দুই যুবককে গ্রেপ্তার করে।
পুলিশ সূত্রমতে, আরিফ ও মামুনের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী ছিনতাইয়ের মূল হোতা হিসেবে নুরুল আলম শিপুকে শনিবার রাতে নগরীর চকবাজারের মক্কি মসজিদের সামনে থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
শিপুকে ছাড়িয়ে নিতে রাত ১০টার দিকে অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী নিয়ে পাঁচলাইশ থানার সামনে ভিড় করে টিনুর অনুসারীরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নগর পুলিশের এক কর্মকর্তা বাংলানিউজকে বলেন, শিপু ছাত্রদল নেতা। আবার ছিনতাইকারী দলেরও নেতা। সুনির্দিষ্ট মামলায় তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অথচ যুবলীগ নেতা টিনু এসে যেভাবে পুলিশকে হুমকিধমকি দিয়েছে তাতে আমরা বিস্মিত হয়েছি। রাতের বেলা থানা ঘেরাও করে আসামি ছেড়ে দেয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করার মতো সাহস টিনু কিভাবে পায় ?
গত দেড় বছরে নগরীতে বিভিন্ন আইন ভঙ্গের ঘটনায় নূর মোস্তফা টিনুর নাম গণমাধ্যমে উঠে আসে। ২০১৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর শিবির অধ্যুষিত চট্টগ্রাম কলেজ ও সরকারি মহসিন কলেজ দখলে নেয় নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নূরুল আজিম রণির অনুসারীরা।
এরপর দুই কলেজ ক্যাম্পাসে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে রণির অনুসারীদের সঙ্গে দফায় দফায় সংঘাতে জড়ায় টিনু অনুসারী হিসেবে পরিচিত একটি অংশ। এদের মধ্যে অধিকাংশই অছাত্র এবং ছিঁচকে সন্ত্রাসী বলে অভিযোগ রণির অনুসারীদের।
নিজেকে যুবলীগ নেতা পরিচয় দেয়া টিনু চকবাজার এলাকায় ছাত্রলীগ-যুবলীগ নামধারী যে অংশের নিয়ন্ত্রক তাদের মধ্যেও ছিনতাইকারী-সন্ত্রাসী এবং শিবির কর্মীরা আছে বলে অভিযোগ রণির অনুসারীদের।
জানতে চাইলে নূরুল আজিম রণি বাংলানিউজকে বলেন, চট্টগ্রামের দুইটা বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সারা বছর তার (টিনু) নির্দেশে বহিরাগতরা হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। এতে আহত হচ্ছে সাধারণ ছাত্ররা। তার সঙ্গে যারা আছে প্রায় সবাই শিবির-ছাত্রদল থেকে আসা। ছাত্রলীগের ব্যানারে তারাই সাধারণ শিক্ষার্থীদের মারধর করছে। অথচ পুলিশ তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
‘সাংগঠনিকভাবেও টিনুর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। তার (টিনু) পেছনের শক্তি যোগানদাতারা তাকে দিয়ে দলের ক্ষতি ছাড়া লাভ কি খুঁজে পেয়েছেন, তারাই ভাল বলতে পারবেন। তবে আমরা বিব্রত হই, আহত হই। ’ বলেন রণি
নগরীর চকাবাজার এলাকায় নিজেকে যুবলীগ নেতা এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী নূরুল ইসলাম বিএসসির অনুসারী হিসেবে পরিচয় দেয় টিনু।
তবে টিনু যুবলীগের কোন পদে নেই উল্লেখ করে নগর যুবলীগের আহ্বায়ক মহিউদ্দিন বাচ্চু বাংলানিউজকে বলেন, সে (টিনু) যুবলীগের কোন পদ-পদবিতে নেই। এখন যুবলীগের নাম ভাঙিয়ে সে যদি থানায় কোন ছিনতাইকারীকে ছাড়াতে যায় বা অপরাধ করে, পুলিশের তো উচিৎ আইনগত ব্যবস্থা নেয়া। পুলিশ কেন কোন ব্যবস্থা নিল না। একজন ছাত্রদল নেতাকে ছাড়ানোর জন্য কেউ যুবলীগ-ছাত্রলীগের নাম ব্যবহার করবে, এটা তো আমাদের জন্য বিব্রতকর।
কেন্দ্রীয় যুবলীগের উপ-অর্থ সম্পাদক হেলাল আকবর চৌধুরীর বাবরের গ্রুপে সম্প্রতি যোগ দিয়েছেন। বাবরের সঙ্গে মিলে টিনু নগরীতে বেশ কয়েকটি সমাবেশেও অংশ নিয়েছেন।
এই বিষয়ে বক্তব্য জানার জন্য বেশ কয়েকবার বাবর ও টিনুর মোবাইলে বারবার চেষ্টা করেও সাড়া মেলেনি।
সন্ধ্যায় টিনুর ফোন
দুপুরে সংবাদ প্রকাশের পর সন্ধ্যা ৬টা ৪২ মিনিটে ফিরতি ফোন করেন নূর মোস্তফা টিনু। তিনি দাবি করেছেন, উপরমহলের চাপে তার ভাইকে অন্যায়ভাবে মামলায় জড়ানো হয়েছে। শনিবার রাতে তাকে মলিন মুখে থানায় যেতে দেখে অনুসারীরা থানার সামনে জড়ো হয়েছিলেন বলেও দাবি তার।
তিনি বলেন, আমার ভাই ছাত্রদল করে, আমি তো অস্বীকার করি না। তারপরও সে আমার ভাই তো। তাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে, সেজন্য আমি থানায় গিয়েছিলাম। আমার মুখ কালো ছিল। সেটা দেখে আমার সঙ্গে ছেলেরাও গেছে। আামাদের পুলিশ লাঠিচার্জ করেনি।
টিনু বলেন, আমি যদি যুবলীগের কেউ না হয়, তাহলে আমি যুবলীগের পেছনে এত টাকা খরচ করি কেন ?
বাংলাদেশ সময়: ১৪২৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০১৭
আরডিজি/টিসি