ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

দিনে ১৮ ঘণ্টা ব্যয় করেছি আজাদীর পেছনে: এমএ মালেক

আল রাহমান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭২২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৫, ২০১৬
দিনে ১৮ ঘণ্টা ব্যয় করেছি আজাদীর পেছনে: এমএ মালেক ছবি: সোহেল সরওয়ার-বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

চট্টগ্রাম: এ নগরেই ছিল আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের সদর দপ্তর, ঢাকায় চলে গেছে। মাল্টিন্যাশনাল সব প্রতিষ্ঠান রাতারাতি ঢাকায় গেল।

এভাবে একে একে আমাদের সবই গেছে। চাইলে দু-তিন মাসের মধ্যে ঢাকা থেকে আজাদী ছাপানো শুরু করতে পারি।
কিন্তু করছি না। কারণ বাবা কাগজটি চট্টগ্রামবাসীর জন্যই বের করেছিলেন। আমার জীবদ্দশায় আজাদী ঢাকা থেকে বেরোবে না। এটি চট্টগ্রামেরই থাকবে। এ জনপদের সুখ-দুঃখ, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমস্যা-সম্ভাবনা, অবহেলা ও বঞ্চনার কথা তুলে ধরবে।

‘স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম দৈনিক’ আজাদীর ৫৭ বছরে পদার্পণ উপলক্ষে বাংলানিউজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আজাদী সম্পাদক এমএ মালেক এসব কথা বলেন।

নগরের ‘সিনিয়র সিটিজেন’ এমএ মালেকের স্মৃতিপটে ষাটের দশকের অধ্যায়টা এখনো ঝলমলে, রঙিন। যদিও তখন কাগজটা বেরোতে সাদাকালো, সাদামাটা। বললেন, ১৯৬০ সালে কাগজ বের করার পর বাবা দুবছরের মতো চালাতে পেরেছিলেন। প্রথম দিকে এত উৎসাহী ছিলাম যে কলেজে যাওয়ার সাইকেলে আত্মীয়-স্বজন ও পরিচিতদের বাসায় কাগজ পৌঁছে দিতাম, সঙ্গে থাকত ভাগিনা মরহুম ডা. আলী রেজা। এভাবে দু-এক মাস পত্রিকা বিলি করেছি। তখন তো আর হকার ছিল না। ১৯৬২ সালে বাবা ইন্তেকাল করলেন। এরপর আজাদীর জন্য দৈনিক ১৮ ঘণ্টা পরিশ্রম করেছি। বিশেষ করে যখন আন্দরকিল্লা কোহিনূর প্রেসের ওপরে তিন তলায় বাসা ছিল। ঘাটফরহাদবেগের বর্তমান বাসায় উঠি ১৯৭৪ সালে।

যাই হোক পুরোনো কথাই বলি, দোতলায় ছিল আজাদী কার্যালয়। তখন রিপোর্টার কম ছিল, নিজেই রিপোর্ট লিখতাম, ছবি তুলতাম, আমি এপিপি’র ফটোগ্রাফার ছিলাম। রাতে নিচতলায় প্রেসে কাগজ ছাপার কাজ দেখতাম। তারপর ঘণ্টা কয়েক ঘুমিয়ে নিতাম। ভোর চারটা থেকে সকাল আটটা পর্যন্ত হকারদের কাগজ দিতাম, এভাবে কেটেছে ৪০ বছর। নতুন একটি দিনের শুরু হতো। এত পরিশ্রম করেছি শুধু একটি কারণে। সেটি হলো যদি আজাদী নিয়মিত বের করতে না পারতাম তবে লোকে বলত, আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার কাগজটি বের করে ভালো একটি কাজ করেছিলেন, তার ছেলে তা-ও ধরে রাখতে পারল না। এ উপলব্ধিই ছিল আমার চালিকাশক্তি।

এখনো আজাদীর জন্যে দিনের গুরুত্বপূর্ণ সময় বরাদ্দ রাখছেন এমএ মালেক। বললেন, ‘তিনবার যাই আজাদী কার্যালয়ে। বেলা ১১টা থেকে দেড়টা, রাত সাড়ে আটটা থেকে ১০টা এবং রাত সাড়ে ১১টা থেকে সাড়ে ১২টা। ’ মাঝখানে সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দেন, ক্লাবে সময় দেন। এমএ মালেক চিটাগাং ক্লাব লিমিটেড, জামালখান সিনিয়রস ক্লাব ও চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি। লায়ন্স ক্লাব, চক্ষু হাসপাতালসহ অনেক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত আছেন তিনি।  

আজাদী টিকে থাকার পেছনে চট্টগ্রামের মানুষের ভালোবাসা, পাঠকপ্রিয়তার পাশাপাশি প্রতিষ্ঠাতা আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার ও হজরতুল আল্লামা ছিরিকোটি শাহের (রা.) দোয়ার কথাই বললেন এমএ মালেক। বললেন, কেন ৫ সেপ্টেম্বর প্রকাশ করা হয়েছিল আজাদী? কারণ ওই দিন ছিল ঈদে মিলাদুন্নবী (দ.)। ছিরিকোটি শাহের (রা.) খলিফা ছিলেন বাবা। বাবার কবরটিও জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া মাদ্রাসা এলাকায়।

একটি কথা বেশ প্রচলিত ‘চট্টগ্রামের আজাদী, আজাদীর চট্টগ্রাম’। ৫৭ বছরের একটি ঐতিহ্যবাহী কাগজের সম্পাদক হিসেবে এমএ মালেক চট্টগ্রাম নিয়ে উদ্বিগ্ন। বললেন, ব্রিটিশ আমলে চট্টগ্রাম ছিল চিটাগাং। পাকিস্তান আমলে ছিল চিটাগাং। স্বাধীনের পর চট্টগ্রামকে সবাই মিলে গ্রাম বানিয়ে রাখার আয়োজন দেখলাম। ক্রমে রাজধানী ঢাকা পুরো দেশকে ঢেকে ফেলেছে। সেই ঢাকনা সরাতে হবে। বিকেন্দ্রীকরণের কথা উঠেছে। আমরা দেখলাম, চট্টগ্রাম থেকে ব্যবসা-বাণিজ্য-শিল্পসহ সব সদরদপ্তর, সব ক্ষমতা ঢাকায় বিকেন্দ্রীকরণ করা হলো!  

সাম্প্রতিক চট্টগ্রাম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, একটা সময় ছিল আন্দরকিল্লা, কলেজ রোড, চকবাজার এসব এলাকায় যানজট ছিল নিত্যসঙ্গী। সরু সড়কগুলোতে বিশৃঙ্খলভাবে যানবাহন চলত। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) সড়কগুলো সম্প্রসারণ করে বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছে। তারা দৃশ্যমান অনেক উন্নয়নকাজ করেছে। চট্টগ্রামে টানেল হবে, বন্দরের উন্নয়ন ও বে টার্মিনাল হবে, আউটার রিং রোড হবে, চন্দনপুরা থেকে শাহ আমানত সেতু পর্যন্ত চার লেনের সংযোগ সড়ক, বিমানবন্দর থেকে শাহ আমানত সেতু পর্যন্ত ফ্লাইওভারসহ অনেক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে। দেওয়ানহাট ওভারপাসটা দারুণ কাজে আসছে। আগে মোড়টাতে নিয়মিত দুর্ঘটনা ঘটত। জলাবদ্ধতা নিরসনের লক্ষ্যে মদুনাঘাট থেকে নেভাল পর্যন্ত কর্ণফুলীর পাড়ে বেড়িবাঁধ ও খালগুলোর মুখে স্লুইসগেট দেওয়া হবে। আমি নেদারল্যান্ডসে দেখেছি, হল্যান্ড সমুদ্রপৃষ্ঠের নিচের একটি শহর। তারা সমুদ্রশাসন করছে। আমাদের সেখান থেকে এক্সপার্ট আনা উচিত জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্যে।   

রাশিয়া, নিউজিল্যান্ডসহ বিশ্বের হাতেগোনা কয়েকটি দেশ বাদে প্রায় সব দেশেই ভ্রমণের অভিজ্ঞতা এমএ মালেকের রয়েছে। ১৯৭৬ সালে আমেরিকার ২০০ বছর পূর্তিতে বিশ্বের ২৯টি সংবাদপত্রের পরিবারকে সপরিবারে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল দেশটি। বাংলাদেশ থেকে সুযোগ পেয়েছিলেন এমএ মালেক। তখনকার মজার একটি অভিজ্ঞতা বললেন বাংলানিউজকে, ‘সেবার সানফ্রান্সিসকো থেকে ওয়াশিংটন মোবাইল হুপ (ক্যারাভ্যান) নিয়ে গিয়েছিলাম ৩৬ দিনে। নিজে ২৮ ফুট লম্বা মোবাইল হুপটি গাড়ি চালিয়ে টেনে নিয়ে গেছি। অসাধারণ অভিজ্ঞতা হয়েছিল সেবার। ’

দেশ-বিদেশ ঘুরে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন এমএ মালেক। স্বপ্ন দেখেন আজাদীকে ঘিরে, চট্টগ্রামকে ঘিরে। বললেন, ভবিষ্যতের ভিশন একটিই বিশ্বজুড়ে তথ্যপ্রযুক্তিগত যে পরিবর্তন তা ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করা। এটিই এগিয়ে যাওয়ার বড় সাফল্য। লেটার প্রেস থেকে অফসেট প্রেস। টাইপ রাইটার থেকে কম্পিউটার। টেলিগ্রাম থেকে ইন্টারনেট। ১৯৯০ সালে এক কোটি টাকা ব্যয়ে এনেছিলাম ফটো টাইপ মেশিন। এভাবে পৃথিবীতে যত টেকনোলজি এসেছে সব কিছু ধারণ করতে চাই। আজাদীর প্রিন্ট সংস্করণের পাশাপাশি অনলাইনে দুটি সংস্করণ রয়েছে। যা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থানরত চট্টগ্রামের মানুষ, আজাদীর পাঠকরা নিয়মিত ব্রাউজ করেন।

এপিজে আবদুল কালামের বাণী দিয়েই শেষ করলেন আলাপচারিতা। বললেন, ঘুমিয়ে দেখা স্বপ্ন, স্বপ্ন নয়, যে স্বপ্ন ঘুমুতে দেয় না সেটিই সত্যিকারের স্বপ্ন। আজাদী নিয়ে দেখা স্বপ্ন আমাকে ঘুমোতে দেয়নি, ঘুমোতে দিচ্ছে না।

বাংলাদেশ সময়: ১৭২২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৫, ২০১৬

এআর/আইএসএ/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
welcome-ad