ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

বঙ্গবন্ধু হত্যা

চট্টগ্রামে প্রতিরোধ গড়তে চেয়েছিলেন পাঁচ জাসদ কর্মী

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৫০ ঘণ্টা, আগস্ট ৯, ২০১৪
চট্টগ্রামে প্রতিরোধ গড়তে চেয়েছিলেন পাঁচ জাসদ কর্মী ছবি : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

চট্টগ্রাম: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নির্মম হত্যাকান্ডের পর খুনীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য চট্টগ্রামে জাসদের ৫ নেতাকর্মী গোপনে সংঘটিত হয়েছিলেন এবং নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে কারাবরণ করেছিলেন। তারা স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে আলিঙ্গণ করার মত পরিস্থিতিতে অবতীর্ণ হয়েছিলেন।



এছাড়া জাসদের বর্তমান সাংসদ মঈনউদ্দিন খান বাদলের নির্দেশে পটিয়া ও বোয়ালখালীতে দলটির বড় একটি গ্রুপ সংঘটিত হয়ে এ হত্যাকান্ডের প্রতিবাদ শুরু করেছিলেন।

১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ৩৯ তম শাহাদাৎবার্ষিকীকে সামনে রেখে ইতিহাসের অনুচ্চারিত সেই সত্যকে তুলে ধরতে শনিবার আয়োজন করা হয় এক সংবাদ সম্মেলন।
চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে আয়োজিত ওই সংবাদ সম্মেলনে গোপনে সংঘটিত হওয়া আরও চারজনকে পাশে নিয়ে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিক এবং সেই সময়ের তুখোড় জাসদ কর্মী নাসিরুদ্দিন চৌধুরী।

নাসিরুদ্দিন চৌধুরীর বর্ণনায় ইতিহাসের অগ্নিঝরা সেই দিনগুলো চলে আসে চোখের সামনে। তিনি বলেন, পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত জাসদের আক্রমণ ছিল তৎকালীন রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে। কিন্তু ১৫ আগস্টের পর জাসদের আক্রমণের বর্শামুখ ঘুরে যায় সেনা সমর্থনপুষ্ট নব্য শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে।

তিনি জানান, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার প্রতিবাদে প্রথমে তারা জাসদের পক্ষ থেকে প্রচারাভিযান শুরু করেন। এরই অংশ হিসেবে লিফলেট, পোস্টার ও দেয়াল লিখন কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়। এ কর্মসূচীর আওতায় পটিয়ায় কিছু দেয়াল লিখনের পর বোয়ালখালীতে চিকা মারার জন্য যান তারা পাঁচজন। এরা হলেন, নাসিরুদ্দিন চৌধুরী, আবদুন নূর, মিলন সেন, নূরুল আমিন ও হোসেনুজ্জামান।

তিনি জানান, ১৯৭৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর তারা বোয়ালখালীর বেঙ্গুরা রেলস্টেশনে চিকা মারার সময় স্থানীয় দালাল এবং মুসলিম লীগের গুন্ডারা গ্রামবাসীকে ভারতবিরোধী অপপ্রচারের মাধ্যমে উত্তেজিত করে ঘেরাও করে ফেলে। তাদের রেলস্টেশনের একটি কক্ষে আটকে রাখা হয়। পটিয়া থেকে বিডিআর এসে তাদের ‍অকথ্য নির্যাতন করে। পরে বোয়ালখালী থানা পুলিশ থানায় নিয়ে গিয়ে অকথ্য নির্যাতন চালায়।

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী জানান, তাদের প্রথমে পা ওপর দিকে বিমের সঙ্গে বেঁধে মাথা নিচের দিকে ঝুলিয়ে বেদম মারধর করা হয়। এরপর একটি গর্তের মধ্যে পা শিকল দিয়ে আটকিয়ে এলোপাতাড়ি মারধর করা হয়। এরপর ছালার ভেতরে ঢুকিয়ে পুকুরের পানিতে চেপে রাখা হত তাদের। শ্বাস বন্ধ হয়ে ফুসফুস ফেটে যাবার উপক্রম হলে তাদের আবার উপরে টেনে তোলা হত। এছাড়া তক্তাডালা নামে একটি বিশেষ পদ্ধতি ব্যবহার করে অমানুষিক নির্যাতন চালানো হত।

নাসিরুদ্দিন চৌধুরীসহ পাঁচজনকে পরে শহরের লালদিঘি পাড়ে সিএমপি পাহাড়ে ডিএসবি অফিসে এনে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয়। পরে তাদের কারাগারে চালান করে দেয়া হয়। কারাগার থেকে তারা তিন বছর পর ১৯৭৮ সালে মুক্তি পান।

তিনি জানান, তক্তাডালা পদ্ধতিতে নির্যাতনের কারণে জাসদের আবু তাহের খান খসরু শহীদ হয়ে যান। সুলতান, শামসুদ্দিন, মোতাহের উন্মাদপ্রায় হয়ে যান। প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা সুলতান উল কবির চৌধুরী, পটিয়ার শামসুদ্দিন আহমেদ ও মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরীও পাহাড়তলী হাজী ক্যাম্পে তক্তাডালা পদ্ধতিতে নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন।

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী জানান, তাদের চিকা, দেয়াল লিখনের কারণে মানুষ নতুন প্রেরণায় উদ্দীপ্ত হয়েছিল। তারা বুঝতে পেরেছিল বঙ্গবন্ধুর সমর্থনে দেশ জেগে উঠেছে এবং তার অনুসারীরা তাদের আশেপাশে রয়েছে। এই চিকার কারণে মুসলিম লীগাররা আতংকিত হয়ে পড়েছিল।

মঈনউদ্দিন খান বাদলের নির্দেশনায় জাসদের যারা সংঘটিত হয়েছিলেন তাদের নামও প্রকাশ করা হয় লিখিত বক্তব্যে। এরা হলেন, রফিক আহমেদ, মোহাম্মদ রফিক, স্বপন চৌধুরী, নূরুল হক, মিলন সেন, মোহাম্মদ ইউসুফ, নূরুল আফসার, মুজিবুর রহমান খান, নূর উল আরশাদ চৌধুরী, আবু তাহের, নূরুল হাকিম, বরুণ দত্ত, নূরুল আমিন, চন্দন এবং বোয়ালখালীর আ হ ম নাসিরউদ্দিন, আবদুন নূর ও হোসেনুজ্জামান।

লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, সেদিন বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করতে গিয়ে সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধেরও অবতারণা হয়েছিল। শহীদ মৌলভী সৈয়দ, এস এম ইউসুফ, এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী ঘাতকদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন।

এই প্রতিরোধ সংগ্রামে অন্যান্যের মধ্যে অংশ নিয়েছিলেন গোলাম রব্বান, কাজী ইনামুল হক দানু, মাহফুজুল বারী, আনোয়ারুল আজিম, সুভাষ আচার্য্য, দীপেশ চৌধুরী, পীযূষ রক্ষিত, কেশব, কাজী আবু তৈয়ব, আ ক ম শামসুজ্জামান, আব্দুল মান্নান, আবুল মনসুর সিদ্দিকী, নায়েক শফি, ফকির জামাল, অধ্যাপক আবু সৈয়দ, সৈয়দ মাহমুদুল হক, শফিক আদনান, দীপঙ্কর চৌধুরী কাজল।

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী বলেন, আর্ন্তজাতিক পরিস্থিতির নাটকীয় পরিবর্তনে এই প্রতিরোধ যুদ্ধের আকস্মিক অকাল পরিসমাপ্তি ঘটে। মৌলভী সৈয়দ নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে আটক অবস্থায় নির্যাতনে মৃত্যুবরণ করেন। এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী আটক হয়ে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন। তাদের বিরুদ্ধে ‘চট্টগ্রাম ষড়যন্ত্র মামলা’ নামে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছিল।

সংবাদ সম্মেলনে আবেগআপ্লুত নাসিরুদ্দিন চৌধুরী বলেন, তখন দেশে সামরিক শাসন, সমস্ত জাতির কণ্ঠরোধ এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করে জাতিকে শৃঙ্খলিত করে খাঁচায় পুরে ফেলা হয়েছিল। এমনি শ্বাসরুদ্ধকর, চরম বিভিষীকাময় পরিস্থিতিতে সেদিন বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করার অর্থ ছিল স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে আলিঙ্গণ করা। সেদিন প্রতিবাদী কর্মসূচী পালনের জন্য কতখানি অবিচলিত সাহস, আদর্শনিষ্ঠা, দেশপ্রেম ও সংকল্পের প্রয়োজন ছিল, সেটা আজ কল্পনাও করা যাবেনা।

সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন জাসদের কার্যকরী সভাপতি ও সাংসদ মঈনউদ্দিন খান বাদল, দক্ষিণ জেলা জাসদের সভাপতি নূরুল আলম মণ্টু, মুক্তিযোদ্ধা রাজেন্দ্র প্রসাদ চৌধুরী, দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান, জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার মো.সাহাবউদ্দিন প্রমুখ।

বাংলাদেশ সময়: ১৩২২ঘণ্টা, আগস্ট ০৯,২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।