ঢাকা, মঙ্গলবার, ৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

জামায়াতি সহিংসতায় নিহত

মুছার পরিবারে ভাত জোটেনা

রমেন দাশগুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৩১ ঘণ্টা, জুলাই ২৭, ২০১৪
মুছার পরিবারে ভাত জোটেনা ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

চট্টগ্রাম: এক ভাইকে পুলিশ অফিসার আর এক বোনকে ডাক্তার বানানোর স্বপ্ন দেখতেন টমটম চালক মোহাম্মদ মুছা। অভাবের সংসারে নিজে পড়ালেখা শিখতে পারেননি, তাই স্বপ্ন দেখতেন পাঁচ ভাইবোনকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মত মানুষ করবেন।

হরতালের নামে জামায়াতের সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছে মুছা। এখন মুছার মা-বাবা, ভাইবোনদের তিন বেলা ভাতই জোটেনা, পড়ালেখাও বন্ধ হওয়ার পথে।


২০১৩ সালের ২৫ মার্চ জামায়াতের ডাকে হরতাল চলাকালে নগরীর চান্দগাঁও থানার এক কিলোমিটার এলাকায় মুছার শরীরে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় পিকেটাররা। ১২ দিন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে ৬ এপ্রিল মুছা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মৃত্যুর কাছে হার মানে।

মুছার মৃত্যুর পর তার পরিবারে নেমে এসেছে কঠিন অন্ধকার। পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তির চিরবিদায়ের নির্মম নিষ্ঠুর বাস্তবতায় এখন পথে বসেছে তার স্বজনরা।

রোববার মুছার বাড়ি নগরীর বাকলিয়া ‍থানার ওয়াজিরপাড়া এলাকায় গেলে দেখা মেলে তার তিন বোনের। নিতান্ত পর্ণ কুটিরে কোনমতে মাথা গুঁজে থাকেন মা-বাবা আর পাঁচ ভাইবোন। দু’বোনের আগে বিয়ে হয়েছে।

মুছার বোন বিবি রহিমা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বাংলানিউজকে বলেন, ভাইয়ার (মুছা) মৃত্যুর পর আমার আব্বা আর কাজে যেতে পারেন না। আমরা পাঁচ ভাইবোন পড়ালেখা করি। আমাদের দিন কিভাবে কাটছে আল্লাহ ছাড়া কেউ জানেনা। মাঝে মাঝে মনে হয়-একদিন ভোরে যদি আমাদের পরিবারের কেউ আর ঘুম থেকে না উঠতাম ! সবাই যদি একসঙ্গে মরে যেতাম, তাহলে ভাল হত।

পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে এক ভাই মোহাম্মদ হানিফ এবার এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। আরেক ভাই মোহাম্মদ হোসেন পড়ছে ষষ্ঠ শ্রেণীতে। তিন বোনের মধ্যে বিবি রহিমা ইন্টারমিডিয়েট দ্বিতীয় বর্ষে, বিবি খতিজা নবম শ্রেণীতে এবং বিবি রাবেয়া পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ালেখা করছে।

বিবি রহিমা বলেন, মুছা ভাই চেয়েছিল হানিফ পুলিশ অফিসার আর খতিজা ডাক্তার হবে। টমটম চালিয়ে আমার ভাই যা আয় করত সব আমাদের পড়ালেখার পেছনে খরচ করত। আমার আব্বা কাঠমিস্ত্রির কাজ করে সংসার চালাত। এখন আমার আব্বা কাজে যেতে পারেন না। পঙ্গুর মত বাসায় বসে থাকেন।  

তিনি জানান, হানিফ দু’টো টিউশনি করে কোনভাবে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। রহিমাও দু’টো টিউশনি করে লেখাপড়ার খরচ চালান। যে বোনকে মুছা ডাক্তারি পড়ানোর স্বপ্ন দেখেছিলেন, খরচ চালাতে পারবেনা দেখে তাকে নবম শ্রেণীতে স্কুল কর্তৃপক্ষ বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি করেনি।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে রহিমা বলেন, ‘আমরা তিনবেলা ভাতই খেতে পারিনা। লেখাপড়া কিভাবে করব ? বাবা বারবার বলছেন লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে যেন কাজ করি। ভাইয়ের কথা মনে উঠলে লেখাপড়া ছাড়তে পারিনা। ’

তিনি বলেন, আমার ভাইয়ের মৃত্যুর পর সরকার আমাদের পাঁচ লক্ষ টাকা সাহায্য দিয়েছে। মাসে সুদ পাই দুই হাজার ২৬০ টাকা। এ টাকা দিয়ে কি সংসার চলে ?

কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে বোন খতিজা বলেন, আমার ভাই আমাকে ডাক্তার বানানোর স্বপ্ন দেখত। ডাক্তার হতে পারবনা। কিন্তু লেখাপড়াটা অন্ত:ত শেষ করতে পারলে ভাইয়ের আত্মা শান্তি পেত।

আলাপকালে তারা জানান, মুছার মৃত্যুর পর তার বাবা আব্দুল মোনাফ সারাদিন বাসায় বসে থাকেন। ছেলের কথা চিন্তা করে বাবা-মা দুজনই শুধু কাঁদেন। তাদের কান্না সহ্য করতে না পেরে ঘর থেকে সব ছবি সরিয়ে ফেলা হয়েছে। এরপর কোনদিন ছবি চোখের সামনে পড়লে অপলক দৃষ্টিতে মা-বাবা চেয়ে থাকেন সেই ছবির দিকে আর ছবির উপর টপটপ করে গড়িয়ে পড়ে অশ্রু। বাড়ির পাশে রাস্তায় টমটম যাবার শব্দ শুনলে দৌঁড়ে বের হয়ে যায় মুছা, মুছা বলে চিৎকার দিয়ে।

ভাইয়ের কোন স্মৃতি তাদের এখনও তাড়া করে ফেরে-এমন প্রসঙ্গও উঠে একান্ত আলাপচারিতায়। এমন প্রসঙ্গে তাদের আবেগ আর বাধা মানেনা। হু হু করে কেঁদে উঠে তিন বোন।

রহিমা বলেন, প্রতিদিন ভোরে টমটম নিয়ে বাসা থেকে বের হবার আগে আমার ভাই মাকে সালাম করত। সেদিন মা ঘুমিয়ে থাকায় সালাম না করেই বেরিয়ে যায়। আমাকে বলেছিল মাকে ডেকে দিতে, কিন্তু আমি দিইনি। আমি যদি মাকে ডেতে দিতাম, যদি আমার মাকে সালাম করে সে বের হত, তাহলে হয়ত আমার ভাই মরত না।

তিনি বলেন, পেট্রল আর পাউডার ছিটিয়ে যখন তার শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয় হরতালকারীরা, কেউ আমার ভাইকে বাঁচাতে আসেনি। আমাদের পরিচিত এক আপু দৌঁড়ে গিয়ে তাকে হাসপাতালে নেয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু আমার ভাই বারবার মা, মা করছিল। মাকে সে একবার দেখতে চেয়েছিল।

আরেক বোন বিবি রাবেয়া বলেন, প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে যখন বিছানায় ভাইকে দেখিনা তখন বুক ভেঙ্গে যায়। আমার ভাই পৃথিবীর সেরা ভাই। আল্লাহ আমাদের নিয়ে তাকে বাঁচিয়ে রাখল না?

ঈদুল ফিতরের প্রসঙ্গও উঠে আলাপচারিতায়। রহিমা বলেন, আমাদের আর কিসের ঈদ ! আমাদের ঈদ মানে হচ্ছে কান্না, শুধুই কান্না। মা-বাবা কাঁদবে, আমরাও কাঁদব।

** পুলিশ হওয়ার স্বপ্ন জহুরুল পুত্রের
** বাবলুর মা’র কান্না থামছেই না
** কবর ও ভিটে ছাড়া কিছুই নেই

** ছেলের চাকরি চান ফিরোজা

** অভাবে সিদ্ধার্থের পরিবার
** বিপাকে মোজহারের পরিবার
** চাকরির আশায় দ্বারে দ্বারে লায়লা
** বাবার শূন্যতায় অশ্রু ঝরে ফারজানা-আরিফের
** সাদামাটা ঈদ জাকারিয়ার পরিবারে
** চাকরি মিলছে না তোজাম্মেলের এমবিবিএস পাস পুত্রের

** কেউ নতুন কাপড় দেয়নি ফিরোজের মাকে
** খাওয়ার নিশ্চয়তা চায় শামসুলের পরিবার
** প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাত চায় মাফিজুরের পরিবার 
** কঠিন জীবন সংগ্রামে হোসনে আরা  
** কবর ও ভিটে ছাড়া কিছুই নেই

 

বাংলাদেশ সময়: ২০২৩ ঘণ্টা, জুলাই ২৭, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।