ঢাকা, শুক্রবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

ধনীরাই করখেলাপি

আবদুল্লাহ আল মামুন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮০৯ ঘণ্টা, জুলাই ২৩, ২০১৪
ধনীরাই করখেলাপি

চট্টগ্রাম: বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির উপ-কোষাধ্যক্ষ এস এম ফজলুল হক। ১৪টি শিল্প প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার।

১৮ বছর ধরে হোল্ডিং ট্যাক্স (পৌর কর) দেন না এই শিল্পপতি। তার কাছ থেকে সিটি কর্পোরেশনের হোল্ডিং ট্যাক্স পাওনা ২৮ লাখ ৪১ হাজার টাকা।


মামুন সালাম সেলিম অ্যান্ড ব্রাদার্স-এর কর্ণধার। বিশ্বের নামিদামি ব্র্যান্ডের প্রতিষ্ঠানকে তৈরি পোশাক সরবরাহ করে এ শিল্প প্রতিষ্ঠানটি। এই শিল্পপতিও ১৮ বছর ধরে কর্পোরেশনকে হোল্ডিং ট্যাক্স দেন না। তার কাছ থেকে সিটি কর্পোরেশনের পাওনা প্রায় ৪৭ লাখ ৩০ হাজার টাকা।

শুধু মামুন সালাম কিংবা ফজলুল হকই নন। সম্প্রতি  শীর্ষ ৮০ কর খেলাপির তালিকা তৈরি করেছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)। এদের সবাই সমাজের ধনী ব্যক্তি। খেলাপির তালিকায় আছে সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও। তাদের কেউই কর দিতে আগ্রহী না।

সিটি কর্পোরেশন তাদের একের পর এক নোটিশ দিয়ে কর আদায় করতে ব্যর্থ হয়েছে।

‘সরকারি দাবি আদায় আইন' অনুযায়ী লিখিত নোটিশ দেওয়ার নির্ধারিত সময়ে বকেয়া পৌর কর পরিশোধ না করলে কর খেলাপিদের সর্বোচ্চ শাস্তি হলো স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি জব্দ করা। বিত্তশালীরা কর খেলাপি হওয়ায় চূড়ান্ত ব্যবস্থা নিতে আগ্রহী নয় কর্পোরেশন।

এ প্রসঙ্গে সিটি কর্পোরেশনের মেয়র এম মনজুর আলম বলেন,‘সম্মানিত করদাতাদের কর দিয়ে কর্পোরেশনের সেবাখাত পরিচালিত হয়। তাই তাদের অসম্মান হয় এমন কিছু করা সমীচীন মনে করি না। তবে যারা দীর্ঘদিন ধরে পৌরকর দিচ্ছেন না  তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ’

কর্পোরেশন সূত্রে জানা যায়, চসিকের বর্তমানে হোল্ডিং রয়েছে ১ লাখ ৪৭ হাজার ৫৯১টি। এরমধ্যে সরকারি হোল্ডিং ১ হাজার ৬৫০টি। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি মালিকানাধীন হোল্ডিং  ১ লাখ ৩৫ হাজার ৫৩টি।

এসব হোল্ডিংয়ের বিপরীতে করপোরেশনের কর বকেয়া ২১৭ কোটি ৯৮ লাখ ৪৯ হাজার ৪৬৭ টাকা। এর মধ্যে সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে পাওনা ১৫১ কোটি ৭৯ লাখ ৪৯ হাজার ৩৫৬ টাকা। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি মালিকানাধীন কর বকেয়া ৬৬ কোটি ১৯ লাখ ১১১ টাকা।

শীর্ষ কর খেলাপি
সিটি কর্পোরেশনের আটটি আঞ্চলিক কর সার্কেল রয়েছে। শীর্ষ কর খেলাপিরা হলেন সমাজের ধনীরা।   আটটি সার্কেলের কর খেলাপি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিরা হলেন- চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতি। সংগঠনটির কাছে কর্পোরেশনের পাওনা ৬১ লাখ ৪৮ হাজার ৭৫৭ টাকা। ১৯৮২-৮৩ সাল থেকে পেশাজীবী সংগঠনটি তাদের পৌরকর পরিশোধ করছে না।

চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুর রশিদ বাংলানিউজকে বলেন,‘কর্পোরেশনের হোল্ডিং ট্যাক্স পাওনার কথা আমার জানা নেই। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর কোনো ট্যাক্স চাওয়া হয়নি। কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে ট্যাক্স চাওয়া হলে বিষয়টি তখন দেখা হবে। ’

কর্পোরেশনের সার্কেল-৩-এর কর কর্মকর্তা আনিছুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, ‘প্রতিবছরই তাদের বকেয়া কর পরিশোধের জন্য নোটিশ দেওয়া হয়। কিন্তু তারা কর দেন না। ’

সেলিম অ্যান্ড ব্রাদার্স-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মামুন সালাম। তার কাছ থেকে পাওনা ৪৭ লাখ ৩০ হাজার ৭৬৫ টাকা।

এ প্রসঙ্গে মামুন সালামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি একটু ব্যস্ত, পরে ফোন দেন। ’ এরপর একাধিকবার চেষ্টা করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। ক্ষুদে বার্তা পাঠানো হলেও কোনো সাড়া মেলেনি।

মদিনাতুন নুর ইন্ডাস্ট্রি, চয়েজ গার্মেন্টস ও চয়েজ ওয়াসিং লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্ণধার বিএনপির কেন্দ্রীয় উপ-কোষাধ্যক্ষ ও সাবেক চাকসু ভিপি এস এম ফজলুল হক। তার কাছ থেকে পাওনা ২৮ লাখ ৪১ হাজার ১৬৪ টাকা।

এ প্রসঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি মুঠোফোন রিসিভ করেননি। পরে ক্ষুদে বার্তা পাঠানো হলেও তিনি কোনো উত্তর দেননি।

নগরীর কাজীর দেউরীতে অবস্থিত অ্যাপোলো শপিং সেন্টার। শপিং সেন্টারটির মালিক নুরুল ইসলাম। তার হোল্ডিং ট্যাক্স বকেয়া ২৩ লাখ ৪৩ হাজার ৯৪৫ টাকা।

এ প্রসঙ্গে নুরুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, ‘প্রতিমাসে ১ লাখ টাকা করে পরিশোধ করার ব্যাপারে কর্পোরেশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা হয়েছে। সে অনুযায়ী জুন মাসে এক লাখ টাকা পরিশোধ করেছি। বাকি টাকাও একইভাবে পরিশোধ করে দেওয়া হবে। ’
দেওয়ানহাট ওয়াকফ এস্টেট। প্রতিষ্ঠানটির কাছে পাওনা ২৩ লাখ ২৪ হাজার ৭০০ টাকা।

প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্বে থাকা আরিফ দেওয়ান বাংলানিউজকে বলেন, ‘ঘরগুলো খালি পড়ে আছে। কোনো ভাড়া নেই। তাছাড়া অতিরিক্ত কর ধার্য্য করা হয়েছে। যার কারণে পরিশোধ করা হয়নি। এছাড়া যেখানে কর্পোরেশন হোল্ডিং দেখাচ্ছে সেখানে এখন গোয়াল ঘর। ’

কর্পোরেশনের সার্কেল-৫ এর কর কর্মকর্তা জানে আলম জানু বাংলানিউজকে বলেন, এসব অজুহাত। ঘর থাকলে আইন অনুযায়ী কর দিতে হবে। ঘর যদি ভেঙ্গে ফেলা হয়, তাহলে কর্পোরেশনকে জানাতে হবে। কর্পোরেশন কর মওকুফ করবে। এর আগে নয়।
সাউথল্যান্ড সেন্টার। নগরীর আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকায় অবস্থিত। শপিংমলটির কর্ণধার লতিফ আনোয়ার চৌধুরী। তার বকেয়া কর ১৮ লাখ ৩৫ হাজার ১ টাকা।

এ প্রসঙ্গে লতিফ আনোয়ার চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, ‘কর কমানোর বিষয়ে আপিল করা হয়েছে। আপিল নিষ্পত্তির পর কর পরিশোধ করা হবে। ’

কর্পোরেশনের সার্কেল-৭ এর কর কর্মকর্তা জানে আলম বাংলানিউজকে বলেন, ৫০ শতাংশ কর পরিশোধ করলেই আপিল গ্রহণ করা হয়। এসব কর ফাঁকি দেওয়ার অজুহাত।

এছাড়াও তালিকার শীর্ষ কর খেলাপিরা হলেন- শুলকবহর এলাকার আহমদ ছবুর, ২ নং গেইট শেখ ফরিদ মার্কেটের মালিক ডা. আবদুস সাত্তার, ওহিদুল ইসলাম ও আনোয়ারুল ইসলামের মালিকানাধীন মেসার্স মারমাইড লিমিটেড, জিহাদ রহমান ও পারভেজ উদ্দিনের মালিকানাধীন মেসার্স ফারফিউম কেমিক্যাল,  মো. আনুর মালিকানাধীন রীমা কমিউনিটি সেন্টার, রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, ঘাটফরহাদ বেগের হাফিজা খানম, উত্তর নালা পাড়ার বেলাল উদ্দিন, রেয়াজ উদ্দিন বাজার জনতা মার্কেটের মালিক আমিনুল হক মিয়া,  কাজির দেউরী এলাকার ঝুমুর সিনেমা হল, নুর এ মদিনা সিএনজি স্টেশনের মালিক হাশেম আলী, আগ্রাবাদ মিস্ত্রিপাড়া এলাকার বাসিন্দা আলতাফ হোসেন, দক্ষিণ হালিশহর আলিশা নগর এলাকার বাসিন্দা এস কে বড়ুয়া।

কর্পোরেশনের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা আহমুদুল হক বাংলানিউজকে বলেন,‘নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তরা নিয়মিত হোল্ডিং ট্যাক্স পরিশোধ করলেও ধনীদের হোল্ডিং ট্যাক্স প্রদানে অনীহা দেখা গেছে। বকেয়া হোল্ডিং ট্যাক্স আদায় না হলে ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন না করতে কর কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া মালামাল ক্রোক করার কথাও ভাবা হচ্ছে। ’

কর খেলাপিতে শীর্ষে সরকারি প্রতিষ্ঠান
সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে বকেয়া ১৯৪ কোটি ৮৪ লাখ ৩৭ হাজার ১১২ টাকা হোল্ডিং ট্যাক্সের (পৌর কর) বিপরীতে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ২০১৩-১৪ অর্থবছরে আদায় করেছে মাত্র ৪৩ কোটি ৪ লাখ ৮৭ হাজার টাকা।

এর মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে পেয়েছে ৩৫ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। অন্য চার সরকারি প্রতিষ্ঠান কোনো বকেয়া কর পরিশোধ করেনি।

বাংলাদেশ রেলওয়ের কাছে বকেয়া কর ৬৬ কোটি ১১ লাখ ৯৮ হাজার ৫৪১ টাকা। এ প্রসঙ্গে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহা-ব্যবস্থাপক মোজ্জাম্মেল হক বাংলানিউজকে বলেন,‘কত টাকা বকেয়া এটা আমার জানা নেই। বিষয়টি ঈদের পরে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ’
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কাছে বকেয়া কর ১০ কোটি ৪৬ লাখ ২৯ হাজার ৩৪৪ টাকা। দীর্ঘদিন ধরে কর আদায় করছে না এ প্রতিষ্ঠানটি।

চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান আবদুস ছালাম বাংলানিউজকে বলেন,‘সিটি কর্পোরেশন আমাদের কাছে পাবে এটা সত্য। আমরাও সরকারি বিধি অনুযায়ী ২ শতাংশ কর কর্পোরেশনের কাছে পাবো। আমি বলেছিলাম কার কাছ থেকে কত পাবে এটা বসে সমাধান করার জন্য। এ নিয়ে একটা বৈঠক হয়েছিল। পরবর্তীতে আর কোনো আলোচনা না হওয়ায় বিষয়টি ঝুলে আছে। ’

বন্ধ হয়ে যাওয়া স্টিল মিলের কাছে চসিকের বকেয়া কর ৭ কোটি ৮৭ লাখ ৯৫ হাজার ৩৫৪ টাকা। চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থার কাছ থেকে পাওনা ১ কোটি ৭২ লাখ ৯ হাজার ৯৭৫ টাকা।

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র এম মনজুর আলম বাংলানিউজকে বলেন, ‘বকেয়া কর আদায় সহজীকরণের লক্ষ্যে ঈদের পর কমিটি করা হবে। কমিটি কীভাবে কর সহজে আদায় করা যায়  এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। এছাড়া সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে বকেয়া আদায় করতে একজনকে লিয়াঁজোর দায়িত্ব দেওয়া হবে। ’

বাংলাদেশ সময়: ১৮০৯ঘণ্টা, জুলাই ২৩, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।