ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে এনসিটির দায়িত্ব দিতেই ৭ বছর অপেক্ষা!

তপন চক্রবর্তী,ব্যুরো এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২০৭ ঘণ্টা, জুলাই ২২, ২০১৪
পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে এনসিটির দায়িত্ব দিতেই ৭ বছর অপেক্ষা! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

চট্টগ্রাম: বন্দরের নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) পরিচালনার দায়িত্ব  পছন্দের একটি প্রতিষ্ঠানকে দিতেই  প্রায় সাত বছর ধরে নানা জটিলতায় ঝুলে আছে?

সংশ্লিষ্টদের মধ্যে এরকম প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। ব্যক্তি স্বার্থের কারণে এনসিটি চালু করতে বারবার বাধাগ্রস্থ হচ্ছে বলেও মত দিয়েছেন অনেকে।

 

এনসিটি চালুতে দীর্ঘসূত্রিতার ফলে চট্টগ্রাম বন্দরের ৫৬৬ কোটি টাকা ব্যয়ে এক কিলোমিটার দীর্ঘ টার্মিনালটি নির্মাণ করলেও পুরোপুরি সুফল নিতে পারছে না বন্দর কর্তৃপক্ষ।


এদিকে টার্মিনালটির পরিচালনা নিয়ে এখন দুটি পক্ষ পরস্পরবিরোধী অবস্থান নিয়েছে।


একপক্ষ বলছে, বন্দরের নিজস্ব অর্থে কেনা যন্ত্রপাতি দিয়ে বেসরকারি অপারেটররা দরপত্রের মাধ্যমে স্বল্প মেয়াদে এনসিটি পরিচালনা করবে।

চট্টগ্রাম বন্দরে সব বিধি বিধান লঙ্ঘন করে রহস্যজনকভাবে সাইফ পাওয়ারটেক নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে বারবার কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের কাজ দেওয়ার রহস্য উদঘাটনের আহ্বান জানিয়েছেন সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী।

এক বিবৃতিতে সরকারের উচ্চ মহল, নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় ও দুদকের প্রতি এ আহ্বান জানান তিনি।

সাইফ পাওয়ারটেক-কে বারবার কাজ দেওয়ার রহস্য উদঘাটন না করলে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলারও হুমকি দেন আওয়ামী লীগের এই নেতা।

বিবৃতিতে মহিউদ্দিন চৌধুরী বলেন, ৮ বছর আগে চট্টগ্রাম বন্দর নির্মিত সর্বাধুনিক কন্টেইনার টার্মিনাল এনসিটি শুরু থেকেই ১/১১ সরকার আমলের বেনিফিসিয়ারি সাইফ পাওয়ারটেক দিয়ে পরিচালনা করা হচ্ছে।

২০০৭ সালের ১৬ মে থেকে গত ২০১১ সালের ৯ মে পর্যন্ত কোনো টেন্ডার ছাড়াই বন্দরের আইন-কানুন, বিধি-বিধান লঙ্ঘন করে এই প্রতিষ্ঠানকে এনসিটির কাজ দেওয়া হয়।

তারপর ২০১৩ সালের ১০মে থেকে চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১০ মাসের জন্য এবং গত ১ মার্চ থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত চার মাসের জন্য সাইফ পাওয়ারটেককে সম্পূর্ণ অবৈধভাবে পাবলিক প্রকিউরম্যান্ট বিধিমালা লঙ্ঘন করে কাজ দেওয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

এদিকে কোনো অপারেটরকে দীর্ঘ মেয়াদে এনসিটি পরিচালনার জন্য দেওয়া হলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ তার কর্তৃত্ব হারাবে বলে মনে করছেন বার্থ অপারেটর অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ফজলে ইকরাম চৌধুরী।

বাংলানিউজকে তিনি বলেন, দীর্ঘ মেয়াদে এনসিটি পরিচালনার জন্য কোনো প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসে এবং তারা যদি গর্হিত কাজ করে সেক্ষেত্রে বন্দর কর্তৃপক্ষ কোনো ধরনের ব্যবস্থা নিতে পারবে না।

স্থানীয় অপারেটররা পরীক্ষিত উল্লেখ করে ফজলে  ইকরাম বলেন, বন্দরের জেনারেল কার্গো বার্থ (জিসিবি), চিটাগাং কন্টেইনার টার্মিনালের (সিসিটি) বার্থ অপারেটররা তিন বছরের জন্য নিয়োগ পেয়েছে। এক্ষেত্রে আধুনিক এনসিটিও স্বল্প মেয়াদে পরিচালনার জন্য দিতে পারে। তবেই সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান সচেতন থাকবে।

না হলে একদিকে অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হবে অন্যদিকে শ্রমিকদের কাঙ্ক্ষিত কর্মসংস্থান হবে না  এবং অনেক শ্রমিক চাকরি হারাবে।

তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যন্ত্রপাতি ক্রয় করে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ সিসিটির আদলে এনসিটি পরিচালনার দায়িত্ব দিলে এটি দ্রুত চালু করা সম্ভব হবে। অন্যথায় দীর্ঘ প্রক্রিয়ার কারণে স্বল্প সময়ে চালু করা সম্ভব হবে না।

এনসিটির পাশে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা থাকার কারণে এটি দীর্ঘ মেয়াদে কাউকে দেওয়া উচিত হবে না বলেও উল্লেখ করেন ফজলে ইকরাম চৌধুরী।

তিনি বলেন, সব পক্ষ নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। না হলে বন্দরের শৃঙ্খলা রক্ষা হবে না।


ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই-এর সাবেক পরিচালক আমিরুল হক বলেন, বিনা টেন্ডারে এনসিটি পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হলে আইনের শাসনের ব্যত্যয় ঘটবে। এভাবে কাজ দেওয়া হলে দুর্নীতিকেও প্রশ্রয় দেওয়া হবে। এর ফল গ্যাটকোর মতো হতে পারে।

স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দরের গুরুত্বপূর্ণ এ টার্মিনালটি পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া উচিত বলেও মনে করেন এ শীর্ষ ব্যবসায়ী।  
                                                                                                                                                                                                                                                এদিকে বেসরকারি অপারেটর যন্ত্রপাতি ক্রয় করে দীর্ঘমেয়াদে টার্মিনাল পরিচালনার পক্ষে মত দিয়েছিন অন্যপক্ষ।

তারা বলছেন, এতে বন্দরের প্রায় এক হাজার ২০০ কোটি টাকার মতো বিনিয়োগ করতে হবে না। কেনাকাটা নিয়েও জটিলতা তৈরি হবে না।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান  রিয়ার অ্যাডমিরাল নিজামউদ্দিন আহমেদ বলেন, বন্দরে কন্টেইনার পরিবহনের হার যেভাবে বাড়ছে তাতে এনসিটি চালু করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।

বাংলানিউজকে তিনি বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে হলে যেভাবেই হোক এনসিটি চালু করতে হবে। না হলে প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা যাবে না। আর প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে না পারলে বিদেশিরা এ বন্দর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। এতে বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে।

পিছু ছাড়ছে না জটিলতা: 
নির্মাণের পর থেকেই টার্মিনালটি চালু করতে উদ্যোগ নিয়েছিল চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক)। কিন্তু জটিলতা এর পিছু ছাড়েনি। দুই দফা দরপত্র আহ্বান করে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়ার সব আয়োজনও শেষ করেছিল চবক।

উচ্চ আদালতে মামলার পর সেই উদ্যোগও ভেস্তে গেছে। এরপর বন্দরের টাকায় যন্ত্রপাতি কিনে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পরিচালনার উদ্যোগ নেয় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এই পদ্ধতিতে খুব বেশি সুফল পাওয়া যাবে না, এমন আপত্তির কারণে গত ১৪ জুলাই দরপত্র-প্রক্রিয়া বাতিল করা হয়।

জটিলতার কারণ:
এনসিটি নির্মাণ শুরু হয় ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে। তা শেষ হয় ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে। এতে চট্টগ্রাম বন্দরের খরচ হয় ৪৬৮ কোটি ৯০ লাখ টাকা। পরে দুটি জেটির পেছনে কন্টেইনার রাখার চত্বর তৈরিতে ব্যয় হয় প্রায় ৯৮ লাখ টাকা।

বেসরকারি অপারেটর যন্ত্রপাতি কিনে টার্মিনাল পরিচালনা করবে এবং নির্দিষ্ট সময় পর বন্দর কর্তৃপক্ষকে হস্তান্তর করবে-(এসওটি) এই নীতিতে টার্মিনালটি চালুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ২০০৭ সালে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সব কাজ গুছিয়েও আনা হয়।

২০০৯ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিশ্বখ্যাত চারটি প্রতিষ্ঠানকে (হাচিসন পোর্ট ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড, ডিপি ওয়ার্ল্ড, এপিএম টার্মিনালস এবং ইন্টারন্যাশনাল কন্টেইনার সার্ভিসেস) দরপত্রে অংশ নেওয়ার যোগ্য নির্বাচিত করা হয়।

২০০৯ সালের নভেম্বরে দরপত্র জমা দেওয়ার সময়ও নির্ধারণ করে বন্দর কর্তৃপক্ষ। তবে তৎকালীন সংসদীয় কমিটি এই প্রক্রিয়ায় বাধা দেয়। ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের এক সভায় দেশীয় প্রতিষ্ঠানকে সুযোগ দিতে এই দরপত্র বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

এ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বন্দর কর্তৃপক্ষ দরপত্র বাতিল করে। এরপর দেশীয় সাইফ পাওয়ারটেক ও বিদেশি পিএসএ ইউরোপ নামে আরও দুটি প্রতিষ্ঠানকে দরপত্রে অংশ নেওয়ার যোগ্য হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়।

মূল দরপত্র দলিলও দফায় দফায় সংশোধন করা হয়। ২০১২ সালের ৩০ আগস্ট দ্বিতীয় দফায় পাঁচটি প্রতিষ্ঠান দরপত্রে অংশ নেয়।

এই সংশোধন আইনসম্মত হয়নি অভিযোগ করে দ্বিতীয় দফায় প্রাক-যোগ্য দুটি প্রতিষ্ঠানকে বাদ দিয়ে প্রথম দফায় প্রাক-যোগ্য চারটি প্রতিষ্ঠানকে বহাল রেখে দরপত্র-প্রক্রিয়া শুরুর নির্দেশ দেয় প্যানেল।

এই আদেশের বিরুদ্ধে সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেড আদালতে রিট আবেদন করে। আদালত সিপিটিইউর নির্দেশের ওপর তিন মাসের স্থগিতাদেশ দিলে দরপত্র প্রক্রিয়া ঝুলে যায়।

সময় চাইলেন মন্ত্রী:
গত ১৬ জুলাই বুধবার বিকেলে বন্দর উপদেষ্টা কমিটির অষ্টম সভা ফজলুর রহমান মুন্সি অডিটরিয়মে অনুষ্ঠিত হয়। এতে নৌ-পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান সভাপতিত্ব করেন।  

সভায় বক্তারা বন্দরের প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে এনসিটি চালুর প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে বক্তব্য দিলেও এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেন নি মন্ত্রী। সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনা করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় চেয়েছেন তিনি।  

নৌমন্ত্রী বলেন, ‘এনসিটি চালু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে তখন জটিলতা দেখা দেয়। ফলে এটি চালু করা সম্ভব হয়নি। এখন সবার সঙ্গে আলোচনা করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এজন্য সময়ের প্রয়োজন। ’

ব্যক্তি স্বার্থে চালু হচ্ছে না এনসিটি:

নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার দীর্ঘ সাড়ে ৭ বছর পরও এনসিটি চালু করতে না পারায় পেছনে ব্যক্তি স্বার্থ জড়িত রয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন সংসদ সদস্য ও বন্দর উপদেষ্টা কমিটির সদস্য মঈনুদ্দিন খান বাদল।

গত বুধবার উপদেষ্টা কমিটির সভায় এনসিটি চালুর সিদ্ধান্ত নিতে না পারার কারণ জানতে চেয়ে তিনি বলেন, ব্যক্তি স্বার্থ জড়িত থাকার কারণেই টার্মিনালটি চালু করা যাচ্ছে না। এটি পরিচালনার জন্য ব্যক্তিগত কোনো ইন্টারেস্ট নেই এমন লোককে দায়িত্ব দিতে হবে।

প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ক্রয় করে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকেই এনসিটি পরিচালনা করতে হবে এমন মত দিয়ে তিনি বলেন, যন্ত্রপাতি কিনে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়ার কোনো অর্থ থাকতে পারে না।

বাংলাদেশ সময়: ১২০২ঘণ্টা, জুলাই ২২, ২০১৪ 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।