ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

দখল-দূষণে ধুকছে লুসাই কন্যা কর্ণফুলী

ইফতেখার ফয়সাল, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৫১ ঘণ্টা, জুন ৩, ২০১৪
দখল-দূষণে ধুকছে লুসাই কন্যা কর্ণফুলী ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

চট্টগ্রাম: ‘ও রে কর্ণফুলী রে, সাক্ষী রাখিলাম তোরে/অভাগিনীর দুঃখের হথা হবি বন্ধু রে’ (ও রে কর্ণফুলি তোকে স্বাক্ষী রাখলাম, অভাগিনীর দুঃখের কথা তুই বন্ধুকে জানিয়ে দিস) ।

যুগ যুগ ধরে এভাবেই চট্টগ্রামবাসীর সুখ-দুঃখের সাথী হয়েছে যে নদী, সে কর্ণফুলীই এখন ধুকছে দখল আর দূষণে।

কিন্তু অভাগিনী এ লুসাই কন্যার দুঃখের কথা যেনো শোনার কেউ নেই।

দুই পাড়ে গড়ে ওঠা প্রায় ৭০০টি ছোটবড় কলকারখানার বর্জ্য অপরিকল্পিতভাবে পড়ছে ঐতিহ্যবাহী এ নদীটিতে।
নদী তীরবর্তী ভূমিগুলো নিয়ে চলছে ভরাট ও দখলের প্রতিযোগিতা। ইতোমধ্যেই ১৫১ একর ভূমি দখল করে গড়ে উঠেছে অবৈধ স্থাপনা।

অব্যাহত দখল-দূষণে একদিকে যেমন প্রাণবৈচিত্র্য ও ব্যবহার উপযোগিতা হারাচ্ছে, তেমনি অন্যদিকে ক্রমেই ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়ছে ঐতিহ্যবাহী এ নদী।

পরিবেশবিদদের আশঙ্কা, এ ধরণের দখল-দূষণ অব্যাহত থাকলে অচিয়েই বুড়িগঙ্গার মতো মরা নদীতে পরিণত হবে কর্ণফুলী।

চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক জাফর আলম বাংলানিউজকে বলেন, ‘কর্ণফুলি নদী দূষণের জন্য বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি সিটি কর্পোরেশন, ওয়াসা, বন্দর কর্তৃপক্ষের মতো সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও দায়ী। শুধু জরিমানা আদায় করে এ দূষণ রোধ সম্ভব নয়। তাই এ নদী রক্ষায় একটি সমন্বিত উদ্যোগের লক্ষ্যে আমরা দূষণের জন্য দায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করছি। যারা এ নদীকে দূষণ করছে, তাদেরকেই উত্তরণের পথ বের করে আনতে হবে। ’

অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক রাজস্ব এস এম আবদুল কাদের বাংলানিউজকে বলেন,‘কর্ণফুলি তীরবর্তী অবৈধ দখল উচ্ছেদের জন্য আমরা একাধিকবার অভিযান চালিয়েছি। কিন্তু আদালতের স্থগিতাদেশের কারণে অনেক জায়গায় উচ্ছেদ অভিযান চালানো যায়না। ’

কর্ণফুলী নদী বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের একটি প্রধান নদী। ভারতের মিজোরামের লুসাই পাহাড় থেকে ২৭৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এ নদীর উৎপত্তি। ভারতে এর বিস্তৃতি খুবই কম। এই নদীর মোহনাতে বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর অবস্থিত।

যেভাবে দূষণ:

কর্ণফুলি নদী দূষণের জন্য প্রধানত দায়ী নদীর দুই পাড়ে গড়ে ওঠা প্রায় সাড়ে সাতশো শিল্প কারখানা। এর মধ্যে রয়েছে পেপার মিল, রেয়ন মিল, সার কারখানা, ওয়েল রিফাইনারি, পাওয়ার প্লান্ট, সিমেন্ট কারখানা, ডাইং ও ওয়াশিং কারখানা ও ট্যানারি শিল্প। এসব কারখানার অধিকাংশতেই বর্জ্য শোধানাগার (ইটিপি) নেই। যার কারণে কারখানার নির্গত বর্জ্য গিয়ে পড়ছে কর্ণফুলীতে।

পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, যেসব কারখানায় ইটিপি রয়েছে সেগুলোতেও সার্বক্ষণিক ইটিপি চালু রাখার সংস্কৃতি গড়ে উঠেনি। অনেক শিল্প-কারখানায় অপরিশোধিত তরল বর্জ্য ইটিপি দ্বারা শোধন না করেই খালে নিক্ষেপ করা হয়। যা কর্ণফুলিকে দূষণ করছে।

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে বর্তমানে বসবাসরত প্রায় ৫৫-৬০ লাখ মানুষের গৃহস্থলী বর্জ্যও কর্ণফুলি নদীতে গিয়ে পড়ছে। নগরীর কঠিন বর্জ্য যথাযথভাবে সংগ্রহ ও পরিবেশ সম্মতভাবে অপসারণ ও ডাম্পিংয়ের জন্য সিটি কর্পোরেশনের পরিকল্পিত কোন উদ্যোগ নেই বলে বিভিন্ন সময় অভিযোগ করে আসছেন পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।

তাদের দাবি, দুটি ডাম্পিং গ্রাউন্ডে ময়লা আবর্জনা নিক্ষেপের পরও খাল-নালার মাধ্যমে ২৫ শতাংশ বর্জ্য সরাসরি কর্ণফুলী নদীতে পড়ছে।

একইভাবে চট্টগ্রাম ওয়াসাকে কর্ণফুলি দূষণের জন্য দায়ী করেছেন পরিবেশবিদরা। প্রতিষ্ঠার ৫১ বছরেও সুয়্যারেজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারেনি নাগরিক সেবা দানকারি এ প্রতিষ্ঠানটি।

পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসেবে মতে, নগরবাসীর নিঃসরিত পয়ঃবর্জ্যের পরিমাণ দৈনিক প্রায় সাড়ে তিন হাজার টন। এর পাশাপাশি উৎপাদিত হচ্ছে কয়েক কোটি লিটার তরল বর্জ্যও। বিশ্বের উন্নত শহরগুলোতে এধরণের বর্জ্য নিয়ন্ত্রণে পাইপ লাইনের মাধ্যমে সুয়্যারেজের ব্যবস্থা থাকে। চট্টগ্রামে খোলা ড্রেনের মাধ্যমে এ কাজটি চলছে। যার কারণে ব্যবহৃত ময়লা পানি ও মানব বর্জ্য বিভিন্ন খাল হয়ে কর্ণফুলী নদীতে গিয়ে পড়ছে। যা কর্ণফুলী দূষণের জন্য দায়ী।

নদীতে চলাচলরত ১ হাজার ২০০ ছোট জাহাজ, ৬০-৭০টি তেলের ট্যাংকার, সাড়ে ৩ হাজার ইঞ্চিন চালিত নৌকার বর্জ্যতেও প্রতিনিয়ত কর্ণফুলী দূষণ হচ্ছে।

দূষণের প্রভাব:

পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী ভূপৃষ্ঠ বা নদীর প্রতি লিটার পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের (ডিও) পরিমাণ ৫ মিলিগ্রামেরও ওপরে, পিএইচ (ঋণাত্মক হাইড্রোজেন আয়ন ঘনত্বের পরিমাপক) এর পরিমাণ ৬ দশমিক ৫ মিলিগ্রাম থেকে ৮ দশমিক ৫ মিলিগ্রাম এবং নদীতে বায়োলজিক্যাল অক্সিজেন ডিমান্ড (বিওডি) ৫ থেকে ১০ মিলিগ্রাম থাকার বিধান রয়েছে।

কিন্তু পরিবেশ অধিদফতরের পরীক্ষায় কর্ণফুলীর বিভিন্ন এলাকায় ডিও ৩ মিলিগ্রামেরও নিচে এবং বিওডি ৩ দশমিক ২ মিলিগ্রাম পর্যন্ত পাওয়া গেছে। পিএইচের পরিমাণও ভয়াবহ।

গত ২২ ও ২৩ এপ্রিল  কর্ণফুলি নদীর ৩৬টি স্থানে দুইটি প্যারামিটারে পানির গুণাগুণ পরীক্ষা করে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)। এর মধ্যে মধ্যে অন্তত ২০টি স্থানে সহনীয় মাত্রার কম দ্রবীভূত অক্সিজেনের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।

পবার যুগ্ম সম্পাদক ও প্রকৌশলী মো. আবদুস সোবহান বাংলানিউজকে জানান, পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা কমে গেলে ছোট ছোট মাছগুলোর বেঁচে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ে। ডিও কমে যাওয়ার মধ্য দিয়ে নদীর প্রাণী বৈচিত্র্য যেমন নষ্ট হচ্ছে, তেমনি নদীর বাস্তুসংস্থান প্রক্রিয়া ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।

বিভাগীয় পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক জাফর আলম বাংলানিউজকে বলেন, ‘আঙ্গিক গঠন এবং জোয়ার-ভাটা অব্যাহত থাকার কারণে মূলত কর্ণফুলী এখনো ব্যবহার উপযোগিতা হারায়নি। দূষণ চলতে থাকলে কর্ণফুলী অচিরেই মৃতপ্রায় নদীতে পরিণত হবে। ’

বিলুপ্ত ৩৫ প্রজাতির মাছ

পরিবেশ অধিদপ্তরের এক প্রকাশনায় উল্লেখ করা হয়, এক সময় কর্ণফুলী নদীতে মিঠা পানির ৬৬ প্রজাতির, মিশ্র পানির ৫৯ প্রজাতির এবং সামুদ্রিক পরিযায়ী ১৫ প্রজাতির মাছ পাওয়া যেতো। দূষণের কারণে এর মধ্যে মিঠা পানির প্রায় ২৫ প্রজাতির এবং মিশ্র পানির ১০ প্রজাতির মাছ এখন বিলুপ্তপ্রায়। এছাড়াও ১০-২০ প্রজাতির মাছ বিপদাপন্ন।

বিলুপ্ত মাছের মধ্যে রয়েছে ফাইস্যা, কাঁচকি, রূপচাঁদা, কালিচাঁদা, পাঙ্গাস, বাচা, ভেটকি, পাশা, বাঁশপাতা, বারগুনি, লটিয়া, রিক্সা, মধু পাবদা, পোয়া, গুলশা, মহাশোল, তেলে গুলশা, সাদা গনিয়া ইত্যাদি। বিপদাপন্ন মাছের মধ্যে রয়েছে রুই, কাতলা, মৃগেল, পোয়া, বোয়ালি পাবদা, বড় চিতল প্রজাতির মাছ।

নদী তীরবর্তী ১৫৮ একর ভূমি বেদখলে

কর্ণফুলী নদীর উভয় পাড়কে কেন্দ্র করে চলছে ভরাট ও দখলের প্রতিযোগিতা। সম্প্রতি জেলা প্রশাসন এ নদী তীরবর্তী ১৫৮ দশমিক ৪৫ একর ভূমিতে অবৈধ স্থাপনা চিহ্নিত করে। এসব জমির আনুমানিক মূল্য প্রায় ৩৪০ কোটি টাকা।

জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, অবৈধ এসব স্থাপনা উচ্ছেদের জন্য একাধিকবার অভিযান চালানো হয়েছে। তবে এর মধ্যে ৫০ দশমিক ৬৪ একর ভূমি নিয়ে মামলা থাকায় অভিযান বন্ধ রয়েছে।

অবৈধ এসব স্থাপনার মধ্যে ব্রিক ফিল্ড, দোকান, বস্তি, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন ধরণের স্থাপনা রয়েছে। এক অভিযানে সম্প্রতি কর্ণফুলি নদীর উত্তর পাড়ের ২২ দশমিক ১৪ একর জায়গায় স্থাপন করা মেসার্স প্যাসিফিক মেরিন অটো-ব্রিকস নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে সিলাগালা করা হয়। ভূমি প্রতিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ এ অভিযানে নেতৃত্ব দেন।

স্থানীয়রা বলছেন, নদী ভরাট ও তীরবর্তী জায়গা দখল করে একশ্রেণীর ভূমি দস্যু রাতারাতি সেগুলো প্লটাকারে বিক্রি করছেন। এ সংঘবদ্ধ চক্রটি উচ্ছেদ অভিযান ঠেকাতে বিভিন্ন মামলার আশ্রয় নেওয়ার পাশাপাশি বেদখল হওয়া বিভিন্ন জায়গায় মসজিদ-মন্দির নির্মাণ করছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতার আশ্রয় এবং সরকারি কর্মকর্তার যোগসাজশে এ দখল বাণিজ্য চলছে।

দখলকৃত ভূমিগুলোর দখলস্বত্ত্ব বিক্রি হচ্ছে প্রতি শতক এক থেকে দেড় লাখ টাকা করে। দখলকে ঘিরে প্রায়ই সময় এসব এলাকায় দাঙ্গা-সংঘর্ষ লেগে থাকে।

নদী ভরাট ও তীরবর্তী ভূমি দখল নদীর স্বাভাবিক গতি প্রবাহ নষ্ট করে বলে মনে করেন পরিবেশ গবেষকরা। এছাড়াও, নদী দখলের এ অপতৎপরতার মধ্য দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের ক্ষতিগ্রস্থ হবে উল্লেখ অবিলম্বে দখল-দূষণ বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান তাদের।

বাংলাদেশ সময়: ১০৪২ ঘণ্টা, জুন ৩, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।