ঢাকা, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

পার পাবেন আসামী

বিলুপ্ত আইনে রাজনৈতিক সহিংসতার মামলা

রমেন দাশগুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২৩৫ ঘণ্টা, মে ২৭, ২০১৪
বিলুপ্ত আইনে রাজনৈতিক সহিংসতার মামলা ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

চট্টগ্রাম: প্রায় ১৪ বছর আগে বিলুপ্ত হওয়া একটি বিশেষ ক্ষমতা আইনের একটি ধারায় এখনও মামলা দায়ের করছে চট্টগ্রাম নগর পুলিশ। নির্দলীয় তত্তাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনের সময় সহিংসতার অভিযোগে বিএনপি-জামায়াতের নেতাদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া অধিকাংশ মামলায় বিশেষ ক্ষমতা আইনের ১৬ (২) ধারার প্রয়োগ হয়েছে।



অথচ বিশেষ ক্ষমতা আইনের ১৬ (২) ধারা বিলুপ্ত হয়েছে ১৯৯১ সালে। ২০০৭ সালে ওয়ান-ইলেভেন পরবর্তী জরুরি অবস্থার সময় ধারাটি পুন: প্রতিস্থাপিত হলেও আওয়ামী লীগ সরকার এসে সেটি সংসদে পাশ করেনি।
এর ফলে ধারাটির কার্যকারিতাও আর নেই। কিন্তু ২০১৩ সালেও নগরীর বিভিন্ন থানায় দায়ের হওয়া বিভিন্ন রাজনৈতিক মামলায় এ ধারার প্রয়োগ দেখা গেছে।

আইনজীবীদের মতে, বিলুপ্ত ধারায় দায়ের করা মামলাগুলো আদালতে টিকবেনা। এছাড়া এসব ধারায় অভিযোগপত্র দেয়া হলে তা আইনি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে এবং দীর্ঘমেয়াদি জটিলতার সৃষ্টি করবে। এতে সহজেই পার পেয়ে যাবেন রাজনৈতিক মামলার প্রভাবশালী আসামীরা।

অভিযোগ উঠেছে, রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী আসামীদের ‘বিশেষ সুবিধা’ দিতেই কৌশলে পুলিশ বিলুপ্ত ধারায় তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে।

চট্টগ্রাম মহানগর আদালতের সাবেক পিপি অ্যাডভোকেট আব্দুস সাত্তার বাংলানিউজকে বলেন, বিলুপ্ত ধারায় মামলা দায়েরের ফলে মামলাগুলোর ভবিষ্যত অনিশ্চিত। এরপরও শুধুমাত্র রাজনৈতিক হয়রানির জন্য বিরোধী দলের নেতাদের বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইনের ১৬ (২) ধারায় বিভিন্ন মামলা দায়ের করা হয়েছে। বিলুপ্ত ধারায় মামলা ‍দায়েরের বিষয়টি আদালতেরও নজরে এসেছে।

নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ কমিশনার (প্রসিকিউশন) মুহাম্মদ রেজাউল মাসুদ বাংলানিউজকে বলেন, রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া বিভিন্ন মামলায় বিশেষ ক্ষমতা আইনের ১৬ (২) ধারার প্রয়োগ দেখা গেছে। তবে এসব মামলা শুধুমাত্র এ ধারায় দায়ের হয়নি। ১৬ (২) ধারার সঙ্গে অন্যান্য ধারাও আছে। সেক্ষেত্রে অভিযোগ প্রমাণে কোন সমস্যা হবেনা।

১৯৭৪ সালে প্রণীত বিশেষ ক্ষমতা আইনের ১৬ (২) ধারায় ৮টি বিষয়কে প্রি-জুডিশিয়াল অ্যাক্ট হিসেবে গণ্য করা হয়েছিল। এগুলো হচ্ছে, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও প্রতিরক্ষার বিরুদ্ধে কাজ করা, বাংলাদেশের সঙ্গে অন্য দেশের সম্পর্ক নষ্ট হয় এমন কাজ করা, পরিকল্পিতভাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নস্যাতের চেষ্টা করা, শ্রেণীবিদ্বেষ ছড়ানো, উসকানি দেয়া, সেবামূলক কাজে কোন সংস্থাকে বাধা দেয়া, নির্দিষ্ট শ্রেণীর মধ্যে ভীতি ছড়ানো এবং মানুষকে উত্তেজিত করা।  

সাবেক পিপি অ্যাডভোকেট আব্দুস সাত্তার বাংলানিউজকে বলেন, ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে বলা ছিল, সুনির্দিষ্টভাবে কেউ ৮টি অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকলে তার বিচার ১৬ (২) ধারায় হবে। মূলত সরকার কিংবা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কেউ অর্ন্তঘাতমূলক কার্যক্রমে জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইনের ১৬ (২) ধারায় মামলা নেয়া হত।

চট্টগ্রাম মহানগর আদালতের বর্তমান পিপি অ্যাডভোকেট মো.ফখরুদ্দিন চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, ১৯৯১ সালে সাবেক প্রধান বিচারপতি সাহাবউদ্দিন আহমদের অস্থায়ী সরকারের আমলে বিশেষ ক্ষমতা আইনের ১৬ (২) ধারা বিলুপ্ত করা হয়। ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থায় তত্তাবধায়ক সরকার এসে তিন নম্বর অধ্যাদেশের মাধ্যমে ধারাটি প্রতিস্থাপিত করে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার এসে অধ্যাদেশটি সংসদে পাশ করেনি, সেটি গেজেটেও অর্ন্তভুক্ত হয়নি।

সাবেক পিপি অ্যাডভোকেট আব্দুস সাত্তারের মতে, সংবিধানের ৯৩ (২) ধারা অনুযায়ী জরুরি অবস্থায় জারি হওয়া কোন অধ্যাদেশ সংসদ অধিবেশন শুরুর ৩০ দিনের মধ্যে পাশ না করলে সেটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিলুপ্ত হয়ে যায়। যেহেতু বিশেষ ক্ষমতা আইনের ১৬ (২) ধারাটি সংসদে পাশ হয়নি সেটিও বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

আদালত ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলনের সময় সহিংসতার ঘটনায় নগরীর ১৬টি থানায় মোট ১৮২টি মামলা দায়ের হয়েছিল। এর মধ্যে কোতয়ালী থানায় ৪১, বাকলিয়া থানায় ১২, চকবাজার থানায় ৩, সদরঘাট থানায় ২, পাঁচলাইশ থানায় ২৬, খুলশী থানায় ৫, বায়েজিদ বোস্তামি থানায় ৬, চান্দগাঁও থানায় ১৪, ডবলমুরিং থানায় ৯, হালিশহর থানায় ৬, পাহাড়তলী থানায় ১৪, আকবর শাহ থানায় ১০, বন্দর থানায় ৭, ইপিজেড থানায় ৩, পতেঙ্গা থানায় ২ এবং কর্ণফুলী থানায় ২টি মামলা আছে।

১৮২টি মামলার মধ্যে যেসব মামলায় বিএনপি-জামায়াতের শীর্ষ নেতারা আসামী হিসেবে আছেন এর প্রায় সব মামলাতেই ধারা হিসেবে বিশেষ ক্ষমতা আইনের ১৬ (২) ধারা আছে।

২০১২ সালের ১৩ মে নগরীর নাসিমন ভবনের বিএনপি কার্যালয়ের আশপাশের এলাকায় সমাবেশ চলাকালে পুলিশের সঙ্গে তৎকালীন চারদলীয় জোটের নেতাকর্মীদের দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এক পর্যায়ে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে নগরীর বিভিন্ন পয়েন্টে।

এ ঘটনায় কোতয়ালী থানায় দায়ের হওয়া একটি মামলার এজাহারে ১৬ (২) ধারা সংযোজন করা হয়। মামলা নম্বর ৩৬ (০৫) ২০১২। মামলায় নগর জামায়াতের আমির ও তৎকালীন সাংসদ আন ম শামসুল ইসলাম, বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য আসলাম চৌধুরী, নগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ডা.শাহাদাৎ হোসেন, নগর যুবদলের সাবেক সভাপতি আবুল হাশেম বক্কর, স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা এস কে খোদা তোতনসহ ৬’শ জনকে আসামী করা হয়।

২০১৩ সালের ১৯ মার্চ নগরীতে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনায় কোতয়ালী থানায় দায়ের হওয়া ৩০ (০৩) ২০১৩ নম্বর মামলায়ও ১৬ (২) ধারা সংযোজন করা হয়। এতে অজ্ঞাতনামা ৪’শ থেকে ৫’শ জনকে আসামী করা হয়।

২০১৩ সালের ২৫ অক্টোবর সাংবিধানিকভাবে আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদের শেষদিনে নগরীতে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের সমাবেশ থেকে বহদ্দারহাট, লালখান বাজার, ইস্পাহানি মোড়সহ আশপাশের এলাকায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ ও ভাংচুরের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় নগরীর কোতয়ালী থানায় দায়ের হওয়া একটি মামলায় ১৬ (২) ধারা সংযোজন করা হয়। মামলা নম্বর ৩১ (১০) ২০১৩।

২০১৩ সালের ২৭ নভেম্বর হরতাল চলাকালে কাজির দেউড়ির মোড়ে যাত্রীবাহী অটোরিক্সায় আগুন দেয়ার ঘটনায় নগর বিএনপির সভাপতি আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সাবেক মেয়র মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন, বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম আকবর খোন্দকার, নগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ডা.শাহাদাৎ হোসেন, জামায়াতের সাবেক সাংসদ আ ন ম শামসুল ইসলামসহ ৭৩ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতনামা আরও অনেককে আসামী করে নগরীর কোতয়ালী থানায় একটি মামলা দায়ের হয়। মামলা নম্বর ৪৬ (১১) ২০১৩। মামলায় দন্ডবিধির ১৪৬, ১৪৭, ১৪৮, ১৪৯, ১৮৩, ৩৩২, ৩২৩, ৩৫৩, ৩৪৬ ধারা এবং বিশেষ ক্ষমতা আইনের ১৬ (২) ধারায় আসামীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়।

একইদিন নগরীর চট্টেশ্বীর মোড়ে সিএনজি অটোরিক্সায় এবং দু’যাত্রীর শরীরে আগুন দেয়ার ঘটনায় নগরীর চকবাজার থানায় শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে আরও একটি মামলা দায়ের হয়। মামলা নম্বর ১২ (১১) ২০১৩। এ মামলায়ও দন্ডবিধির ১৪৬, ১৪৭, ১৪৮, ১৪৯, ১৮৩, ৩৩২, ৩২৩, ৩৫৩, ৩৪৬ ধারা এবং বিশেষ ক্ষমতা আইনের ১৬ (২) ধারায় আসামীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়।

সূত্র জানায়, অবরোধ চলাকালে নাশকতার মামলায় ২০১৩ সালের ২৮ নভেম্বর রাতে চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দর থেকে বিএনপি নেতা মীর নাছিরকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ২৬ জানুয়ারি উচ্চ আদালত থেকে জামিন পান তিনি।

চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম আদালতে মীর নাছিরের জামিন শুনানিতে অংশ নেন সাবেক পিপি অ্যাডভোকেট আব্দুস সাত্তার। তিনি জানান, মহানগর হাকিম সৈয়দ মাশফিকুল ইসলাম একটি মামলায় জামিন আদেশে বিলুপ্ত ১৬ (২) ধারায় মামলা দায়েরের বিষয়টি উল্লেখ করেন।

চট্টগ্রাম মহানগর আদালতের পিপি অ্যাডভোকেট মো.ফখরুদ্দিন চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, বিলুপ্ত হওয়া বিশেষ ক্ষমতা আইনের ১৬ (২) ধারা নিয়ে একটি জটিলত‍া রয়ে গেছে। ২০০৭ সালে প্রতিস্থাপিত আইনটি সংসদে পাশ না হওয়ায় বিলুপ্ত হয়ে গেলেও এ বিষয়ে হাইকোর্টের নির্দেশনার প্রয়োজন আছে। আইনটি নিয়ে হাইকোর্টের কোন নির্দেশনা না থাকায় পুলিশ এখনও ওই ধারায় মামলা নিচ্ছে।

কোতয়ালী থানার ওসি একেএম মহিউদ্দিন সেলিম বাংলানিউজকে বলেন, বিশেষ ক্ষমতা আইনের ১৬ (২) ধারা বিলুপ্ত হওয়া নিয়ে কোন সার্কুলার আমাদের হাতে আসেনি। এজন্য বেশকিছু মামলায় এ ধারার প্রয়োগ ঘটেছে। তবে এখন আর এ ধারায় আমরা মামলা নিচ্ছিনা।

বাংলাদেশ সময়: ২২৩৫ ঘণ্টা, মে ২৭,২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।