চট্টগ্রাম: আসন্ন বাজেটে শিল্পায়ন ও ব্যবসা-বাণিজ্য বিকাশে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ কামনা করেছেন চিটাগাং চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (সিসিসিআই) সভাপতি মাহবুবুল আলম।
বাজেটে তিনি আমদানি শুল্কহারের স্তর পুনর্বিন্যাসের প্রস্তাব দেন।
তিনি বলেন, নির্মাণ সামগ্রীর দাম স্থিতিশীল পর্যায়ে রাখার জন্য এম এস বিলেট এর শুল্কহার টনপ্রতি ৩৫’শ টাকা থেকে কমিয়ে ১৫’শ টাকা, এআইটি প্রতি টনে ৮’শ টাকা কমিয়ে শূন্য এবং এটিভি ৪ শতাংশ প্রত্যাহারের প্রস্তাব করেন।
চেম্বার সভাপতি বলেন, এম এস বিলেট রড, লোহা, ইস্পাত সামগ্রীর কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
প্রাক-বাজেট নিয়ে বাংলানিউজের সঙ্গে একান্ত আলাপে এসব কথা বলেন চিটাগাং চেম্বার সভাপতি মাহবুবুল আলম।
মোটরসাইকেল, কার, পিকআপ আমদানিতে শুল্ক হ্রাস ও ট্রাক-বাসের উৎপাদনে প্রণোদনা প্রদানের প্রস্তাব জানিয়ে চেম্বার সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, পরিবেশবান্ধব, সহজলভ্য, বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ী, জ্বালানি সাশ্রয়ী ও সর্বত্রগামী ছোট সিসির মোটরকার এদেশে খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছে।
“বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে যা খুবই উপযোগী। জনমুখী ও জনস্বার্থে আমদানির বেলায় বৃহত্তর মধ্যবিত্ত শ্রেণি ও পেশাজীবীদের জন্য এই গাড়িগুলোকে ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে আনতে হলে শুল্ক কমানো উচিত বলে আমরা মনে করি। বর্তমানে আমদানি শুল্ক ২৫ ভাগ থেকে কমিয়ে ১২ ভাগ এবং সম্পূরক শুল্ক সম্পূর্ণভাবে রহিত করতে হবে। ”
তিনি বলেন, বাংলাদেশে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির সঙ্গে পরিবহন সেক্টরে মোটরসাইকেলের অবদান অপরিসীম। জীবনযাত্রার মানবৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কারণে মোটরসাইকেলের চাহিদা ১৮-২০ ভাগ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এর ধারাবাহিকতায় স্থানীয় পর্যায়ে মোটরসাইকেল তৈরি হচ্ছে।
স্থানীয় শিল্প সংরক্ষণের স্বার্থে ও মধ্যবিত্ত জনগণের একান্ত নিজস্ব বাহনের মূল্য ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রাখার জন্য সিকেডি পর্যায়ে ফোর স্ট্রোক মোটরসাইকেল আমদানির উপর আমদানি শুল্ক হ্রাস করে সিবিউ গাড়ির উপর অধিকতর হারে শুল্ক আরোপ করে সিকেডি এবং সিবিউর শুল্কের তারতম্য নূন্যতম ৪০ শতাংশ থাকা উচিত বলে মনে করেন এ ব্যবসায়ী।
তিনি বলেন, “এ ক্ষেত্রে সম্পূরক শুল্ক ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ করার জন্য প্রস্তাব করছি। ”
চেম্বার সভাপতি বলেন, বর্তমানে পিকআপ সিকেডি এবং সিবিইউ এর শুল্ক কর সমান। অন্যদিকে সিকেডির ক্ষেত্রে উৎপাদনে মূল্য সংযোজন কর ১৫ শতাংশ থাকার ফলে সংযোজিত পিকআপের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ফলে বাণিজ্যিকভাবে আমদানিকৃত সিবিইউ পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা অত্যন্ত কষ্টকর হচ্ছে। তাই বর্তমানে আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ এবং উৎপাদন পর্যায়ে মূল্য সংযোজন কর ১৫ শতাংশ রহিত করার প্রস্তাব করেন সিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম।
তিনি বলেন, বর্তমানে কিছু উদ্যোক্তা স্থানীয় পর্যায়ে বাস ও ট্রাকের কিছু যন্ত্রাংশ উৎপাদন করছে। বিশেষ করে ট্রাকের ক্ষেত্রে কেবিনসহ অন্যান্য আইটেম তৈরি করছে এবং উল্লেখযোগ্যহারে স্থানীয় উপকরণ সংযোজিত করে তথা ভ্যালু এডিশন করে চলছে।
বর্তমানে স্থানীয় পর্যায়ে মোটরসাইকেল উৎপাদনের ক্ষেত্রে সরকার উৎপাদনকারীদেরকে যে প্রণোদনা দিয়েছে তা যদি বাস ও ট্রাকের যন্ত্রাংশ স্থানীয়ভাবে উৎপাদনকারীদের দেয়া হয় তাহলে স্থানীয় উপকরণ সংযোজনের হার অনেক বৃদ্ধি পাবে। চেম্বার সভাপতি ৭ আসন বিশিষ্ট গাড়ির জন্য নতুন এইচএসকোড সংযোজনেরও প্রস্তাব করেন।
পোশাক শিল্পের আমদানিকৃত কাঁচামাল পুনঃরপ্তানিতে জটিলতা নিরসন করার দাবি জানিয়ে চেম্বার সভাপতি বলেন, শতভাগ রপ্তানিমুখী শিল্প হিসেবে আমাদের পোশাক শিল্পের আমদানিকৃত কাঁচামাল বিশেষ করে কাপড় কোনো কারণে অগ্রহণযোগ্য বিবেচিত হলে প্রয়োজনীয় শর্ত ও আনুষ্ঠানিকতা পূরণ সাপেক্ষে এর পুনঃরপ্তানি প্রক্রিয়া সহজিকরণ ও দ্রুত করার লক্ষ্যে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। এ ধরণের পুনঃরপ্তানির ক্ষেত্রে আইনগত বা অন্যকোনো জটিলতা অথবা বিলম্বের কারণ থাকলে তা নিরসনে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজনে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের নজরে আনতে হবে।
চেম্বার সভাপতি শতভাগ রপ্তানিমুখী কার্টুন ও একসেসরিজ খাতের পলিব্যাগ ও হ্যাঙ্গার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের জন্য তাদের আমদানিকৃত কাঁচামাল খালাস করতে ১০ শতাংশ ব্যাংক গ্যারান্টি দেওয়ার যে নিয়ম আছে সেটি প্রত্যাহার করারও সুপারিশ করেন।
দেশিয় কাঁচামালভিত্তিক শিল্পগুলোকে বিশেষ উৎসাহ দেওয়ার জানান চেম্বার সভাপতি। তিনি বলেন, “সম্পূর্ণ দেশিয় কাঁচামালভিত্তিক শিল্পকে আমদানিকৃত কাঁচামালভিত্তিক একই রকম শিল্পের চেয়ে অধিকতর সুবিধা এবং প্রণোদনা দেওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে দেশিয় কাঁচামালভিত্তিক রপ্তানি শিল্পকে আরো বেশি প্রণোদনা দেওয়া যেতে পারে। এতে করে দেশিয় কাঁচামালভিত্তিক শিল্পায়ন তথা রপ্তানি গতি পাবে।
এছাড়া তিনি লুব্রিকেন্ট অয়েল, ইন্ডাস্ট্রিয়াল র ম্যাটেরিয়াল, থ্রেটেড স্ক্রু আমদানিতে শুল্ক হার কমানো, চা আমদানির উপর অতিরিক্ত শুল্ক প্রত্যাহার, গ্রিজ এর সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন।
চট্টগ্রামের এ ব্যবসায়ী নেতা আরো বলেন, বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পের অবকাঠামো ও ভিত্তি বর্তমানে খুবই শক্তিশালী এবং তা বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। কিন্তু ওষুধের কাঁচামাল যা এপিআই নামে পরিচিত, তা বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়।
২০১৬ সালের পরে এই আমদানি সুযোগ আর থাকবে না। তাই বর্তমানে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা-ডব্লিউটিও এর আওতায় প্রাপ্ত সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ওষুধ রপ্তানিকে ত্বরান্বিত করতে এবং ২০১৬ সালের পর বাংলাদেশ যাতে স্থানীয়ভাবেই ওষুধের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সংগ্রহ করতে পারে সেজন্য চট্টগ্রামে জরুরি ভিত্তিতে একটি এপিআই পার্ক করতে হবে এবং সরকারও এ বিষয়ে সম্মত। তাই কালবিলম্ব না করে চট্টগ্রামে এপিআই পার্ক এবং ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে সকল কোম্পানির জন্য একটি সাধারণ (কমন) সুবিধা সম্বলিত ল্যাবরেটরি স্থাপন করা উচিত।
চেম্বার সভাপতি পলিস্টার সূতার কাঁচামাল পেটচিপস্ এর উপর শুল্কহার শূণ্যহারে নির্ধারণ ও দেশে উৎপাদিত পলিস্টার সুতা বিক্রির উপর সম্পূর্ণরূপে ভ্যাট প্রত্যাহার, প্রচলিত এডভান্স ট্রেডভ্যাট (এটিভি) কর্তন পদ্ধতি পরিবর্তন, একই পণ্যের বিক্রির ক্ষেত্রে দ্বৈত মূসক আদায় বাদ দেওয়ার প্রস্তাব করেন।
এ ছাড়া সিআর কয়েলের এর উৎপাদন পর্যায়ে মূসক আরোপের জন্য টনপ্রতি আট হাজার টাকায় ট্যারিফ মূল্য ধার্য করা, ক্যাপিটাল মেশিনারি ও কাঁচামাল আমদানির মূসক অব্যাহতি বহাল রাখা, থার্ড পার্টি ম্যানুফ্যাকচারিং এর ক্ষেত্রে উৎসে মূসক ও অগ্রিম আয়কর কর্তনের সুনির্দিষ্ট বিধান করা, বিলাসবহুল রেস্টুরেন্ট এবং শপিংমলকে মূসকের আওতায় আনা, শিল্প কারখানা স্থাপনের সময় নির্মাণ কাজের জন্য প্রদেয় মূল্যের উপর মূসক হ্রাস করা, ট্যাক্স প্রদানে উৎসাহিত করতে স্টিল কারখানার এই স্বীকৃত ৬ ভাগ ওয়েস্টেজ বিক্রি করার সময় কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতি নেয়ার প্রথা বাতিল এবং কোনো প্রকার মূসক আদায় না করাসহ বিভিন্ন প্রস্তাবের কথা বলেন চট্টগ্রামের এ ব্যবসায়ী নেতা।
বাংলাদেশ সময়: ২১১২ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৪, ২০১৪