ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

ভুজপুর তাণ্ডব

অভিযোগের দায় থেকে মুক্ত হচ্ছে হেফাজত !

রমেন দাশগুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫২৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ১০, ২০১৪
অভিযোগের দায় থেকে মুক্ত হচ্ছে হেফাজত ! ছবি: সোহেল সরওয়ার/ বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

চট্টগ্রাম: চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার ভুজপুরে মিছিলে হামলা ও নৃশংস তাণ্ডবের ঘটনার পর জামায়াত-শিবির, হেফাজতে ইসলাম এবং মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর অনুসারীদের দায়ী করেছিল আওয়ামী লীগ। পুলিশও তদন্তের শুরতে এমনই তথ্য পেয়েছিল।

কিন্তু নৃশংস সেই ঘটনার এক বছর পর এসে অভিযোগের দায় থেকে হেফাজতকে বাদ দিয়েছে আওয়ামী লীগ।  

এছাড়াও আওয়ামী লীগের একাংশের বিরুদ্ধে ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বাঁচানোর চেষ্টারও অভিযোগ উঠেছে।
ক্ষমতাসীন দলের এমন রাজনৈতিক অবস্থানের প্রভাব পড়েছে মামলার তদন্তেও। ফলে গত এক বছরেও এ ঘটনায় দায়ের হওয়া পাঁচটি মামলার মধ্যে একটিরও অভিযোগপত্র পুলিশ আদালতে দাখিল করতে পারেনি বলে অভিযোগ আছে।

চট্টগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (উত্তর) মো.শহীদুল্লাহ বাংলানিউজকে বলেন, তিনটি মামলার তদন্ত শেষে মেমো অব এভিডেন্স (এমওই) অনুমোদনের জন্য পাঠানও হয়েছে। বাকিগুলোর তদন্ত চলছে। স্পর্শকাতর মামলা, অনেক আসামী এবং সাক্ষীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় তদন্তে সময় লাগছে।

গত বছরের ১১ এপ্রিল ১৮ দলের ডাকা হরতালের বিরুদ্ধে ফটিকছড়ি উপজেলার ভুজপুর ইউনিয়নের কাজিরহাট এলাকায় শান্তি মিছিল বের করেন নবম সংসদ নির্বাচনে ফটিকছড়ি থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী আওয়ামী লীগ নেতা এটিএম পেয়ারুল ইসলাম। প্রায় পাঁচ শতাধিক গাড়ি নিয়ে বের করা মিছিল কাজিরহাটে গিয়ে সহিংসতার শিকার হয়। হামলাকারীদের তাণ্ডবে প্রাণ হারান তিনজন এবং কমপক্ষে দু’শতাধিক নেতাকর্মী আহত হন। পুড়িয়ে দেয়া হয় দু’শতাধিক গাড়ি।

এক বছরের মাথায় উপজেলা আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের উদ্যোগে নৃশংস ওই ঘটনার বিচার দাবি করে পোস্টার ও লিফলেট বের করে। সেখানে ঘটনার জন্য জামায়াত-শিবির, জঙ্গী এবং যুদ্ধাপরাধী সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে দায়ী করা হয়েছে। হেফাজতের কথা সেখানে উল্লেখ করা হয়নি।



আওয়ামী লীগ নেতা এটিএম পেয়ারুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, জামায়াত-শিবির, সাকা বাহিনী এবং জঙ্গীরা প্রকাশ্য দিবালোকে পরিকল্পিতভাবে এ ঘটনা ঘটিয়েছে। জামায়াত নেতা ও চেয়ারম্যান শফী নূরী কাজিরহাট মসজিদের বড় হুজুরকে খুন করা হয়েছে, তুলে নেয়া হয়েছে- এ ধরনের গুজব ছড়িয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করে তাদের ক্যাডারদের সঙ্গে লেলিয়ে দেয়।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, তদন্তে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ঘটনার আগের দিন ১০ এপ্রিল সন্ধ্যায় ভুজপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও জামায়াত নেতা শফিউল আলম নূরী, বাগানবাজার ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি ওহিদুর রহমান সওদাগর, ভুজপুর ইউনিয়ন পরিষদের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য বিএনপি নেতা মো.জাহিদ ওরফে জাহিদ মেম্বার, শিবির ক্যাডার বেলাল, পারভেজ ও ফরিদ এবং হেফাজত ইসলামের পক্ষে কাজিরহাট এমদাদুল ইসলাম মাদ্রাসার (কওমী মাদ্রাসা) শিক্ষক আজগর ছালেহসহ ১২ জন বসে তাণ্ডবের পরিকল্পনা নেয়। আজগর ছালেহসহ বৈঠকে উপস্থিত ১০ জনের উপর দায়িত্ব পড়ে ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম ও পাড়া থেকে লোকজন নিয়ে ১০টি দলে ভাগ হয়ে সরাসরি হামলায় অংশ নেয়া। এছাড়া আজগর ছালেহ এবং শিবির ক্যাডার পারভেজ মুঠোফোনে বিভিন্ন উসকানিমূলক তথ্য ছড়িয়ে দেন বলেও তদন্তে তথ্য পেয়েছে পুলিশ।

উল্লেখ্য কাজিরহাট এমদাদুল ইসলাম মাদ্রাসাটি হেফাজতে ইসলাম নিয়ন্ত্রিত মাদ্রাসা হিসেবে এলাকায় পরিচিত। ঘটনার পর শফিউল আলম নূরী গ্রেপ্তার হলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে আছেন আজগর ছালেহ।

হেফাজত নিয়ে কোন অভিযোগ না করার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এটিএম পেয়ারুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, যে মাদ্রাসা থেকে উসকানি দেয়া হয়েছে, সেই বড় হুজুরের সঙ্গে আমার মিছিলের আগে কথা হয়েছে। আসলে বড় হুজুরের নামে গুজব ছড়িয়ে জঙ্গীগোষ্ঠী ফায়দা হাসিল করেছে।

পুলিশ সূত্র জানায়, ঘটনার পরদিন ভুজপুর থানার এস আই মুজিবর রহমান বাদি হয়ে ভুজপুর ইউপি চেয়ারম্যান মো.শফিউল আলম নুরীকে প্রধান আসামী করে ১৩৯জনের নাম উল্লেখ করে ও ৩-৪ হাজার অজ্ঞাতনামা আসামী করে হত্যা, গুরুতর জখম, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগের অভিযোগে একটি মামলা দায়ের করে। নিহত ফোরকানের পিতা মো.এজাহার মিয়া বাদি হয়ে ১২০জনের নাম উল্লেখ করে এবং দেড় হাজার জনকে অজ্ঞাতনামা আসামী করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।



এছাড়া নিহত মো.রুবেলের মামা জামাল পাশা শওকত বাদি হয়ে ৯৮ জনকে এজাহার নামীয় এবং দু’হাজার জনকে অজ্ঞাতনামা আসামী করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। নিহত ফারুক ইকবাল বিপুলের মামা জিয়াউল হক জিয়া বাদী হয়ে ১১৫জনের নাম উল্লেখ করে একটি মামলা দায়ের করেন। ফায়ার সার্ভিসের গাড়ী পোড়ানোর দায়ে ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন অফিসার সমীর দাশগুপ্ত বাদি হয়ে অজ্ঞাতনামা ৬-৭হাজার জনকে আসামী করে একটি মামলা দায়ের করেন।

ভুজপুর থানার ওসি মো.কবির হোসেন বাংলানিউজকে জানান, ঘটনার পর পুলিশ এ পর্যন্ত ১৮৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছে এবং এদের মধ্যে ৩৫ জন উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে ইতোমধ্যে বেরিয়ে গেছেন। গ্রেপ্তার হওয়া আসামীদের মধ্যে ১৪ জন দায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে।  

পুলিশ সূত্র জানায়, আসামীদের গ্রেপ্তারের পর ফটিকছড়ি আওয়ামী লীগের পেয়ারুল ইসলামবিরোধী একটি গ্রুপ বিভিন্নভাবে থানায় প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালায়। চিহ্নিত আসামী ধরার পরও তাদের নির্দোষ অভিহিত করে পুলিশের কাছে তদবির করেছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। সরকারী দলের এমন ভূমিকার কারণে এক পর্যায়ে গ্রেপ্তার, তদন্ত প্রায় থমকে  যায়।

এছাড়া পুলিশের বিরুদ্ধেও নিরীহ লোকজনকে থানায় ধরে নিয়ে গ্রেপ্তার বাণিজ্যের অভিযোগ উঠে। এরপর বছরের শেষদিকে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হলে মামলাগুলো ধামাচাপা পড়ে যায়।

আওয়ামী লীগের একাংশের বিতর্কিত ভূমিকা নিয়ে এটিএম পেয়ারুল ইসলাম কোন মন্তব্য করতে চাননি। তবে এ ধরনের কর্মকাণ্ডে চরম ক্ষুব্ধ পেয়ারুর অনুসারী নেতাকর্মীরা।

ঘটনায় গুরুতর আহত ফটিকছড়ির বখতপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহ-সভাপতি মো.ফারুকুল আজম বাংলানিউজকে বলেন, আওয়ামী লীগের একটি অংশের সহিংসতাকারীদের সঙ্গে অদৃশ্য যোগাযোগ গড়ে উঠেছে। সবকিছু মিডিয়ার সামনে বলা সম্ভব নয়। শুধু এতটুকু বলতে চাই, আসামীদের জন্য আওয়ামী লীগের কোন কোন নেতা সুপারিশ করেন, এর চেয়ে বড় দু:খ আর কি হতে পারে ?

ফটিকছড়ির ধর্মপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও উপজেলা যুবলীগের আহবায়ক কমিটির সদস্য কাজী মাহমুদুল হক বাংলানিউজকে বলেন, আওয়ামী লীগের যেসব নেতা খুনিদের বাঁচাতে চাইছেন, আমি বিশ্বাস করিনা তারা বঙ্গবন্ধুর অনুসারী। তারা মীরজাফর, খন্দকার মোস্তাকের অনুসারী। তারা যদি সত্যিকার বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাস করতেন, তাহলে জামায়াত-হেফাজতের সঙ্গে আঁতাত করতে পারত না।

তাণ্ডবে নিহত উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক ফারুক ইকবাল বিপুলের স্ত্রী সানজিদা আরফিন নিশু বাংলানিউজকে বলেন, রাজনীতি আমার স্বামীর নেশা ছিল। দল করতে গিয়ে তাকে মরতে হয়েছে। তার খুনের বিচার কি আমি পাব না ? হেফাজত তো এলাকায় অনেক কর্মকাণ্ড করছে, তাদের ধরা হচ্ছে না কেন ?

ঘুমের মধ্যে আঁতকে উঠেন আহতরা
ভুজপুরে তাণ্ডবে বেঁচে যাওয়া আহতদের অনেকেই সেই বিভৎস স্মৃতি ভুলতে পারছেন না। অনেকেই এখনও মানসিক বিপর্যস্ত অবস্থা কাটিয়ে উঠতে পারেননি। ঘটনার বছরপূর্তির আগে নিহতের পরিবার, আহতরা সবাই এসে ভিড় করেন তাদের নেতা এটিএম পেয়ারুল ইসলামের বাসায়।

গুরুতর আহত ছাত্রলীগ কর্মী হেলাল উদ্দিন পেয়ারু বাংলানিউজকে জানান, ঘটনার সময় বেলাল নামের এক বন্ধু তাকে পেছন থেকে ‘পেয়ারু’ বলে ডাক দেয়। হামলাকারীরা তাকে এটিএম পেয়ারুল ইসলাম মনে করে ঘিরে ধরে কোপাতে থাকে। মাথায় ও পেটে উপর্যুপরি কোপানোর ফলে মগজ ও ভুঁড়ি বের হয়ে যায়। এরপর মারা গেছে ভেবে তাকে ফেলে যায়। ৩১ দিন অজ্ঞান থাকার পর তার জ্ঞান ফেরে। চিকিৎসাধীন হেলাল এখন শ্বাসকষ্ট এবং মানসিক পঙ্গুত্বে ভুগছেন।

ধর্মপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কাজী মাহমুদুল হক বাংলানিউজকে বলেন, এ ধরনের বিভৎস ঘটনা আমি অতীতে কখনও দেখিনি আর দেখতেও চাইনা। মানুষ যে এত পাষণ্ড হতে পারে তা কল্পনাও করা যাবেনা। আমি এখনও রাতে ঘুমাতে পারিনা। আমাদের চোখের সামনে মানুষকে সাপের মত করে পেটানোর দৃশ্যগুলো ভেসে উঠে। আমি চিৎকার করে বিছানা ছেড়ে উঠে যায়।

বখতপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো.ফারুকুল আজম বাংলানিউজকে বলেন, জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাসীরা আমাকে মারতে মারতে রাস্তায় ফেলে দেয়। প্রাণ বাঁচাতে আমি বণিকপাড়ায় আশ্রয় নিই। সেখান থেকে ইউএনও অঞ্জনা খান মজলিশ আমাকে অ্যাম্বুলেন্সে করে উদ্ধার করে নিয়ে যান। যাবার পথে অ্যাম্বুলেন্স ভাংচুর করে হামলাকারীরা।

এটিএম পেয়ারুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, আমি কেয়ামত দেখিনি। আমি একাত্তর দেখেছি, একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলা দেখেছি। ভুজপুরের ঘটনায় আমার মনে হয় অতীতের সব বর্বরতার রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। যারা এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়েছে তারা হিংস্র, বর্বর, জঙ্গী।

বাংলাদেশ সময়: ১৫২৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ১০,২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
welcome-ad