ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

শাটল ট্রেনে বগিভিত্তিক রাজনীতিতে অতিষ্ঠ শিক্ষার্থীরা

বিপ্লব পার্থ, চবি করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫২৯ ঘণ্টা, মার্চ ১২, ২০১৪
শাটল ট্রেনে বগিভিত্তিক রাজনীতিতে অতিষ্ঠ শিক্ষার্থীরা

চট্টগ্রাম: চট্টগ্রাম নগরী থেকে প্রায় ২২ কিলোমিটার দুরের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে শিক্ষার্থীদের প্রধান মাধ্যম শাটল ট্রেন। কিন্তু সে যাতায়াত মাধ্যমটি বিভিন্নভাবে জিম্মি হয়ে পড়েছে ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রিত কিছু বগিভিত্তিক সংগঠনের হাতে।



বগিভিত্তিক এসব সংগঠনের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে যেমন বারবার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে, তেমনি বগি সংগঠনের কর্মীদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা।

বগি সংগঠনগুলোর এধরণের বেপরোয়া কর্মকাণ্ডে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন একাধিকবার বগিভিত্তিক রাজনীতিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেও বাস্তবায়নের কোন কার্যকর উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি।
ফলে, চবি’র বিষফোড়া হিসেবে রয়ে গেছে বগিভিত্তিক সংগঠনগুলো।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রগুলো বলছে, ছাত্রসংগঠনগুলোর বগি নিয়ন্ত্রন করা, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উদাসীনতা, বগি দখলকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সময় সংগঠিত সংঘর্ষের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহন না করার কারনে বগি ভিত্তিক সদস্যরা বেপরোয়া হয়ে উঠছে।

বিশ্ববিদ্যালযের প্রক্টর মো.সিরাজ উদ দৌলাহ বাংলানিউজকে বলেন, বগিভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকলেও কিছু সরকার দলীয় কর্মী এসব সংগঠনগুলোর উপর নির্ভর করে যার কারণে সংগঠনগুলো রয়ে গেছে। তবে এখন আগের মতো তেমন সংঘর্ষ হয় না। সামান্য ভুল বুঝাবুজি হলেও তারা নিজেদের মধ্যে মিটমাট করে নেয়।

ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে বগি: চবিতে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল অনেকটা মিটে গেলেও বগিভিত্তিক সংগঠনগুলো নিয়ন্ত্রণকে ঘিরে রয়ে গেছে বিভেদ। ফলে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে নিজেদের মধ্যে  বাড়ছে  সংঘর্ষ। ছাত্রলীগের বিভিন্ন গ্রুপ শাটল ট্রেনের বগিগুলোর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এর মধ্যে ভার্সিটি এক্সপ্রেস (ভিএক্স), ককপিট, ফাটাফাটি, দোস্ত, সাম্পান, অলওয়েজ, ফাইট ক্লাব, খাইট্টা খা এবং সিএফসির সদস্যরা চবি ছাত্রলীগের সভাপতি মামুনুল হকের অনুসারী।

এ ছাড়া যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কাজী তানজীম হোসেনের অনুসারীরা 'একাকার', সাংগঠনিক সম্পাদক আলমগীর টিপুর অনুসারীরা 'সিক্সটি নাইন এবং সহ-সভাপতি সাফায়েত বিল্লাহর অনুসারীদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ওয়ারিয়র্স। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গত কয়েক বছরে ছাত্রলীগ-শিবিরের মধ্যে সংঘর্ষের চেয়েও বেশী সংঘর্ষ হয়েছে ছাত্রলীগের নিজেদের মধ্যে। আর প্রত্যেকটি সংঘর্ষই ছিল বগি দখলকে কেন্দ্র করে।

লাঞ্চনার শিকার ছাত্রীরা :
শাটল ট্রেনের বগিতে বেপরোয়া ছাত্রলীগের কর্মীদের হাতে প্রতিনিয়ত লাঞ্চিত হয় ছাত্রীরা।   ছাত্রীদের টার্গেট করে কুৎসিত গান ও কটুক্তি করে।   নিপীড়নের এখানেই শেষ নয়। এছাড়াও, ছাত্রীদের বিভিন্নভাবে যৌন হয়রানি করে বলেও নাম প্রকাশে অনেক শিক্ষার্থী অভিযোগ করেছেন।
 
৩৬ সিটে বসা নিষেধ :
প্রতিটি শাটল ট্রেনে বগি রয়েছে নয়টি। প্রতি বগির ধারণ ক্ষমতা প্রায় দেড়শ' জন। এর মধ্যে ৩৬টি সিট দখল করে ছাত্রলীগ কর্মীরা। তাদের এ দখলের খেলা চলে প্রতিটি বগিতেই। এছাড়া, ৩৬ সিটের বাইরেও অনেক সময় শিক্ষার্থীদের সিট থেকে তুলে দেয় বগির সদস্যরা। বগির সদস্যদের এধরণের আচরণে নিয়মিতই ভোগন্তিতে পড়ছেন শিক্ষার্থীরা। তবুও নিরুপায় তারা। সিট নিয়ে তর্ক করলেই বিপদ।

কাগজে নিষিদ্ধ, বাস্তবে বিপরীত :
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ২০০৯ সালের ১৩ মার্চ ক্যাম্পাসে সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করে। সেই সাথে নিষিদ্ধ করে শাটল ট্রেনের বগিভিত্তিক কার্যক্রম। চারটি বগিভিত্তিক সংগঠনের মধ্যে হামলা-পাল্টা হামলার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১২ সালের ১ মে জরুরি সিন্ডিকেটের ৪৭৩তম সভায় পুনরায় শাটল ট্রেনের বগিভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়। একই সভায়, বগিভিত্তিক সংগঠনের নামে কেউ কোনো বিশৃঙ্খলা করার চেষ্টা করলে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়।

কাগজে-কলমে বগিভিত্তিক রাজনীতিতে এ ধরণের নিষেধাজ্ঞা ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থার কথা থাকলেও বহাল তবিয়তে চলছে বগি রাজনীতি।

সচেতনাতমূলক শ্লোগান মুছে সংগঠনের নাম :
বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটে বগি রাজনীতি নিষিদ্ধের পর প্রতিটি বগিতে সচেতনতামূলক বেশকিছু স্লোগানও লিখে দেয় প্রশাসন। কিন্তু কিছুদিন না যেতেই সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্তকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ছাত্রলীগ কর্মীরা সচেতনতামূলক স্লোগনগুলো মুছে দিয়ে সেখানে লিখে দেয় তাদের সংগঠনের নাম।

অশালীন গান ও নৃত্য :
শাটল ট্রেনের বিভিন্ন বগিগুলোতে অশালীন গান ও নিত্য করার অভিযোগ রয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ছাত্রী বলেন, শুধু অশ্লীল গানেই সীমাবদ্ধ নয়, গান করার সময় অশ্লীল অঙ্গভঙ্গিও করে তারা।

বাড়ছে সংঘর্ষ : শাটল ট্রেনকে কেন্দ্র করে এমন সংঘর্ষের ঘটনা প্রায় প্রতিদিনের। গত চার বছরে সংঘর্ষ হয়েছে অন্তত দুশ' বার। এর মধ্যে বড় ধরনের সংঘর্ষ রয়েছে ২০টি, যাতে আহত হয় শতাধিক ছাত্রলীগ নেতাকর্মী। তাছাড়া বগি দখলের ঘটনায় বিভিন্ন সময় আটক করা হয় অস্ত্র-গুলি সহ দেশীয় অস্ত্র।

নিরুপায় কর্তৃপক্ষ :
বগি ভিত্তিক সংগঠনগুলো নিয়ন্ত্রন করে চবি ছাত্রলীগ। চবি ছাত্রলীগকে নিয়ন্ত্রন করে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী ও সাধারন সম্পাদক আ.জ.ম.নাছির উদ্দিন।   ফলে বগি দখলকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের ঘটনায় দায়েরকুত মামলাগুলো রাজনৈতিক কারনে অগ্রসর হয়নি। এতে উৎসাহিত হয়েছে মূল হোতারা। আর এর কারনে বগি দখলে বারবার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হচ্ছে বলেও অভিমত প্রকাশ করেছেন অনেকে।  

শাস্তির কার্যকারিতা নেই :
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বগিভিত্তিক সংঘর্ষে জড়িত থাকার দায়ে গত তিন বছরে ছাত্রলীগের অন্তত ৩৫ জন নেতাকর্মীকে আজীবনসহ বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার করে। এর পরও বন্ধ করা যায়নি ছাত্রলীগ কর্মীদের বগি দখলের খেলা। চবি প্রশাসন সূত্র জানায়, ২০১২ সালের ৩ মার্চ শাটল ট্রেনে সংঘর্ষের ঘটনায় এক ছাত্রলীগ কর্মীকে এক বছরের জন্য বহিষ্কার করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সেদিন দুপুরে সংঘর্ষের দায়ে ছাত্রলীগের বগিভিত্তিক দু গ্রুপের তিন কর্মীকেও আটক করা হয়। এদের মধ্যে আতাউল মান্নানকে বহিষ্কার করা হয়।

এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৫৬তম সিন্ডিকেট সভায় বহিষ্কার করা হয় চার ছাত্রলীগ কর্মীকে। বহিষ্কার হয় চবি ছাত্রলীগের বর্তমান সহ-সভাপতি শেখ মোঃ সাফায়েত বিল্লাহ (ব্যবস্থাপনা) ও সাংগঠনিক সম্পাদক আলমগীর টিপু (অর্থনীতি), মোঃ নুরুজ্জামান (হিসাববিজ্ঞান) ও মোঃ শহীদুল ইসলাম শহীদকে (গণিত)।

এ ছাড়া ২০০৮ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত প্রায় ৩০ জন ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীকে দফায় দফায় সতর্কীকরণ নোটিশ দেন প্রক্টর।

এর আগে ২০০৯ সালের ১৯ মার্চ ছাত্রলীগের দু'গ্রুপের সংঘর্ষের ঘটনায় আট ছাত্রলীগ কর্মীকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। কারণ দর্শানো ও সতর্কীকরণ নোটিশ দেওয়া হয় আরও ১২ শিক্ষার্থীকে। নোটিশ জারির এক মাস না যেতেই আবারও সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে তারা। এজন্য ২২ এপ্রিল বহিষ্কার করা হয় একজনকে। এর তিন দিন পর ২৫ অক্টোবর ছাত্রী লাঞ্ছিত করার অভিযোগে বহিষ্কার করা হয় ছালিক উদ্দিন নামে আরও একজনকে। ২৫ আগস্ট রেল স্টেশন চত্বরে ছাত্রীদের নিপীড়নের দায়ে বহিষ্কার করা হয় কাজী আলম ও শান্তনু মহাজন নামে দু'ছাত্রলীগ কর্মীকে।

এত বহিষ্কারের ঘটনা থাকলেও এ গুলোর কার্যকারিতা নেই বলে অভিযোগ করেছেন অনেকে। শুধু লোক দেখানোর জন্য এসব বহিষ্কার নাটক করা হয় বলে মত প্রকাশ করেছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা । তারা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যদি শাস্তির ব্যাপারে কঠোর হত তবে বগি দখলের প্রতিযোগীতা হত না এবং সংঘর্ষও ঘটত না।

বাংলাদেশ সময়: ১৫০০ ঘণ্টা, মার্চ ১২, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।