ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

অনলাইন গণমাধ্যমকে আইনি কাঠামোয় আনার তাগিদ

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ও স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮১১ ঘণ্টা, মার্চ ১০, ২০১৪
অনলাইন গণমাধ্যমকে আইনি কাঠামোয় আনার তাগিদ ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

চট্টগ্রাম: অনলাইন গণমাধ্যমকে আইনি কাঠামোর মধ্যে আনার তাগিদ এসেছে বন্দরনগরীর প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সেমিনারে বিশিষ্টজনদের বক্তব্যে। পাশাপাশি অনলাইন গণমাধ্যমের কাছে বিবেকবোধে উজ্জীবিত হয়ে দায়িত্বশীল সাংবাদিকতাও প্রত্যাশা করা হয়েছে।



চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন পরিচালিত প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ সোমবার দুপুরে ‘বাংলাদেশে অনলাইন সাংবাদিকতা: বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিতে আইনগত তাৎপর্য’ শীর্ষক এ সেমিনারের আয়োজন করে।

আইন বিভাগের চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদের সভাপতিত্বে সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন একুশে পদকপ্রাপ্ত সমাজবিজ্ঞানী ও প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড.অনুপম সেন।
বিশেষ অতিথি ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ড.ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী।

অতিথি আলোচক হিসেবে শিক্ষার্থীদের সামনে অনলাইন গণমাধ্যম, নীতিমালা এবং সাংবাদিকতা নিয়ে সারগর্ভ আলোচনা করেন বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কমের এডিটর ইন চীফ আলমগীর হোসেন।

এছাড়া আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে সেমিনারে আলোচনায় অংশ নেন পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন, খাগড়াছড়ি এর সচিব (যুগ্ম জেলা জজ) মোহাম্মদ মাহাবুবুর রহমান এবং বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কমের হেড অব নিউজ মাহমুদ মেনন।

সহকারী অধ্যাপক হিল্লোল সাহা’র সঞ্চালনায় প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’শিক্ষক মেহের নিগার ও অনুপ কুমার বিশ্বাস সেমিনারে বক্তব্য রাখেন। সেমিনারে উপস্থিত অতিথিরা আইন বিভাগের শিক্ষার্থীদের তৈরি অবিনাশী শীর্ষক দেয়ালিকা উদ্বোধন করেন।

মানুষকে মঙ্গল চেতনায় জাগাতে হবে: ড.অনুপম সেন
জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে মানুষকে মঙ্গল চেতনায় উজ্জীবিত করার জন্য অনলাইন গণমাধ্যমকে কাজ করে যাবার আহ্বান জানিয়েছেন সমাজবিজ্ঞানী ড.অনুপম সেন।

তিনি বলেন, তথ্যপ্রযুক্তির অনেক ভাল দিক আছে, অনেক খারাপ দিকও আছে। অনেকে ভাবেন, অনলাইন সৃজনশীলতাকে নষ্ট করে দিচ্ছে। প্রযুক্তিনির্ভরতা সৃজনশীলতা ধ্বংস করে। মানুষের এ ধারণা সর্বাংশে সত্য নয়। বাংলানিউজের মত কিছু অনলাইন গণমাধ্যমে অনেক ইতিবাচক কাজ করছে। অনলাইনের মাধ্যমে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে। অনলাইনকে মানুষের মঙ্গল চেতনায় উজ্জীবিত করার কাজ করতে হবে।

তিনি বলেন, প্রযুক্তিকে মানুষের দোরগোড়ায় নিয়ে যাচ্ছে অনলাইন গণমাধ্যম। একসময় মানুষ টেলিগ্রাম পেলে ভীত হয়ে যেত কি খবর এসেছে সেটা ভেবে। কিন্তু এখন টেলিগ্রামের যুগ নেই। এখন সারাক্ষণ ইমেইল, ফেসবুকে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ হচ্ছে।

তিনি বলেন, অনলাইন গণমাধ্যম শুধু মানুষকে দ্রুত তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করছে তা-ই নয়। অনলাইনে সমৃদ্ধ সাহিত্যচর্চা হচ্ছে। মানসম্মত গল্প, কবিতা লেখা হচ্ছে।

অনুপম সেন বলেন, প্রযুক্তি কিংবা অনলাই যে আবার সবক্ষেত্রে ভাল করছে তা-ও কিন্তু নয়। অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা অসাধারণ কৌশল প্রয়োগ করে ব্যাংকের টাকা উধাও করে দিচ্ছে। পেন্টাগণের তথ্যকেন্দ্রে ঢুকে কম্পিউটার হ্যাক করা হচ্ছে। এজন্য প্রযুক্তিকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে হবে। অনেক আইন আছে যেগুলো পুঁজিবাদি আইন। নতুন করে আইনি কাঠামোর মধ্যে এনে অনলাইন গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

সুস্থ সংস্কৃতির জন্য কাজ করতে হবে: ইফতেখার উদ্দিন
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ উপাচার্য ড.ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী বলেন, সমস্ত বিশ্বকে যে গ্লোবাল ভিলেজ বলা হচ্ছে তা অবাধ তথ্য প্রবাহের জন্য। আর এই অবাধ তথ্যপ্রবাহের কাজটি সহজ করছে বাংলানিউজের মত কিছু অনলাইন গণমাধ্যম।

সাম্প্রতিক সময়ে অনলাইন গণমাধ্যম কিছু নেতিবাচক ভূমিকা পালন করছে বলে অভিযোগ করে তিনি বলেন, সাঈদীর রায় ঘোষণার পর তাকে চাঁদে দেখা যাচ্ছে বলে কিছু অনলাইন গণমাধ্যম কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম মিথ্যা তথ্য পরিবেশন করল। মক্কা শরিফের গিলাফ নিয়ে ১০ জন খতিব মানববন্ধন করছে বলে জঘন্য মিথ্যাচার করা হল। সহিংসতার মূল সূত্রপাত হয়েছে কিন্তু এসব প্রচারণার কারণেই।

ইফতেখার উদ্দিন বলেন, তবে আশার কথা হচ্ছে, অনলাইন থেকে মিথ্যা তথ্য প্রচার হলেও তরুণরা আবার অনলাইনেই সেসব মিথ্যার বিরুদ্ধে সত্যকে তুলে ধরেছেন। সুতরাং অনলাইন মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনা দরকার। এক্ষেত্রে নীতিমালা করে তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।

তিনি বলেন, আমরা অনলাইন গণমাধ্যমের কাছে আশা করি, তারা সত্য তথ্য, সত্য বক্তব্য দিয়ে সমাজকে আলোকিত করবে। যেসব অনলাইন মিডিয়া অসুস্থ সংস্কৃতির জন্ম দিচ্ছে বাংলানিউজসহ মূলধারার অনলাইন মিডিয়াগুলো তার বিপরীতে সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার কাজ করবে।

শুধু আইন নয়, বিবেকবোধে তাড়িত হতে হবে: আলমগীর হোসেন
অনলাইন গণমাধ্যমকে আইনি কাঠামোর মধ্যে আনার তাগিদে একমত পোষণ করে সেই আইন মেনে চলা নিয়ে শংকা প্রকাশ করেছেন বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কমের এডিটর ইন চীফ আলমগীর হোসেন।

তিনি বলেন, অনলাইন গণমাধ্যমের জন্য নীতিমালা তৈরি হচ্ছে। সংবাদপত্রের  জন্য তো নীতিমালা আছে। কিন্তু সেই নীতিমালা কি প্রিন্ট মিডিয়াগুলো মানছে? সুতরাং বলছি, শুধু আইন কিংবা নীতিমালা তৈরি করলে হবে না। বিবেকবোধে তাড়িত হতে হবে। আইন তৈরির পর যদি কেউ সেই আইন না মানেন, তাহলে? যারা অনলাইন সাংবাদিকতা করেন তারা যদি বিবেক দিয়ে নিজেদের পরিচালিত করেন তাহলে কোন সমস্যা হবে না।

তিনি বলেন, যে আইন দিয়ে দেশ চলছে তা ব্রিটিশদের আইন। আমরা যখন প্রযুক্তির জন্য আইন তৈরি করছি, তখন প্রযুক্তি দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। সরকার আইন তৈরি করে, অনেকে সেই আইন মানে না। সুতরাং দ্রুত বিকাশমান অনলাইনের জন্য নীতিমালা তৈরি করতে হলে বড় পরিসরে বিতর্ক প্রয়োজন। শিক্ষার্থীরা কি চান, তরুণরা কি চান সেগুলো জানতে হবে।

আলমগীর হোসেন বলেন, অনেকে বলছেন ব্যাঙের ছাতার মত অনলাইন পত্রিকা গজিয়ে উঠছে। কিন্তু আমাদের তো এটাও ভাবতে হবে কি পরিমাণ সংবাদপত্র আছে? পত্রিকা ছাপানোর জন্য কি পরিমাণ গাছ কাটতে হচ্ছে? কত গাছ আমরা ধ্বংস করছি?

তিনি বলেন, সিটিজেন জার্নালিজম একটা বিষয় যেটা খুব পপুলার হচ্ছে। অনেক নামীদামী বাংলাদেশি পত্রিকায় সিটিজেন জার্নালিস্টদের সুযোগ দেয়া হচ্ছে। আমরাও চেষ্টা করছি বাংলাদেশে এ জায়গাগুলো ফিক্সড করতে।

তিনি বলেন, অনলাইন সাংবাদিকতার বিপদও অনেক। আমাদের দ্রুত তথ্য দিতে হয়। দ্রুত পরিবেশন করতে গিয়ে তথ্য ভুল থাকার ঝুঁকি থাকে। প্রিন্ট মিডিয়ার এত ঝুঁকি নেই।

প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সামনে নিজের ৪০ বছরের সাংবাদিকতা জীবনের দীর্ঘ বর্ণনাও দেন ‍বাংলাদেশে অনলাইন গণমাধ্যমের পথিকৃৎ আলমগীর হোসেন।

তিনি বলেন, সাংবাদিকদের লোভ, লালসার উর্দ্ধে থাকতে হবে। বিবেকের প্রতি দায়বদ্ধ থাকতে হবে। সংবাদ পরিবেশনের পর অনেক ধরনের চাপ আসে। কিন্তু নৈতিকতার জায়গায় অটল থাকলে সেই চাপ অগ্রাহ্য করা যায়।

প্রযুক্তির আলোয় আলোকিত হতে চাই: মাহাবুবুর রহমান
পার্বত্য ভূমি কমিশন, খাগড়াছড়ি এর সচিব মোহাম্মদ মাহাবুবুর রহমান বলেন, অনলাইন সাংবাদিকতার দ্রুত বিকাশ হচ্ছে। অনলাইন গণমাধ্যম সমাজে দ্রুত পরিবর্তন আনছে। অবস্থা এমন হয়েছে, অনলাইনের কারণে কোন মূর্খ এখন আর মূর্খ থাকতে চাইলেও পারছেনা। মূর্খতা হচ্ছে সমস্ত দুর্নীতি ও দুর্ভোগের মূল কারণ। এখন অনলাইন গণমাধ্যম দ্রুত আমাদের সেই দুর্ভোগ থেকে মুক্তি দিতে কাজ করছে।

তিনি বলেন, প্রযুক্তি এগিয়েছে, ফলে দেশ এগিয়েছে। আমিও মনে করি, প্রযুক্তিকে আইনি কাঠামোর মধ্যে আনা উচিৎ। তথ্যপ্রযুক্তি আইন সংশোধন হয়েছে। তবে এরপরও আরও আরও অনলাইন গণমাধ্যম চাই। অনলাইন শুধু বাংলাদেশ নয়, সমস্ত বিশ্বকে আলোকিত করছে। আমরাও প্রযুক্তির আলোয় আলোকিত হতে চাই।

বাংলানিউজের ভূয়সী প্রশংসা করে মাহাবুবুর রহমান বলেন, বাংলানিউজের কারণে অনেক পত্রিকা আমার পাঠ্যসূচী থেকে ‍বাদ পড়েছে। আমি মনে করি, বাংলাদেশের প্রত্যেক শিক্ষার্থী বাংলানিউজ থেকে শিখছে। বাংলাদেশে যেসব অনলাইন গণমাধ্যম আসছে সবগুলো বাংলানিউজকে অনুসরণ করেই আসছে।

দ্রুত নিউজ আপলোড একটি বড় চ্যালেঞ্জ- মাহমুদ মেনন
সেমিনারে বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কমের হেড অব নিউজ মাহমুদ মেনন বলেন, দ্রুততম সময়ে নিউজ আপলোড করা একটি চ্যালেঞ্জ। বিশেষ কয়েকটি আইনসহ দেশের মোট ২৪টি আইন কোনো না কোনোভাবে অনলাইন সাংবাদিকতার সঙ্গে সম্পৃক্ত। এই আইন মাথায় রেখেই কাজ করতে হয় অনলাইন সংবাদ মাধ্যমকে।

এ প্রসঙ্গে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে আইনগত বিষয়ের মুখোমুখি হওয়ার অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন মাহমুদ মেনন।

তিনি বলেন, সময়ের স্বলতার কারণে অনলাইনের ক্ষেত্রে সংবাদের সৌন্দর্য বা সাহিত্যমান কতটুকু রক্ষিত হবে তা নিয়ে প্রশ্ন আসতে পারে। কিন্তু পাঠকদের ধরে রাখতে সেই চ্যালেঞ্জটিকেও গ্রহণ করতে হয়।

মেনন বলেন, অনলাইনে একটা ক্লিকেই পাঠক অন্য যে কোন সাইটে চলে যেতে পারে তাই পাঠকদের ধরে রাখার জন্য বিভিন্ন কন্টেন্টের আশ্রয় নিতে হয়। বাংলানিউজে পাঠক সাইটে গড়ে ২০ মিনিট করে অবস্থান করে এমন তথ্য দিয়ে তিনি বলেন, পর্যাপ্ত ও পছন্দের কনটেন্ট পাঠক পাচ্ছেন বলেই তারা দীর্ঘ সময় ধরে বাংলানিউজে থাকেন, যা অনলাইন সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে বড় সাফল্য।

বাংলাদেশ সময়: ১৮১১ ঘণ্টা, মার্চ ১০,২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
welcome-ad