ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

পটিয়া উপজেলা নির্বাচন

আওয়ামী লীগকে হারাল আওয়ামী লীগ

রমেন দাশগুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৪৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০১৪
আওয়ামী লীগকে হারাল আওয়ামী লীগ

চট্টগ্রাম: নিজের একক কর্তৃত্ব জাহিরের চেষ্টায়, নিজে একক নেতা সাজতে গিয়ে পটিয়া উপজেলায় আওয়ামী লীগ নেতারা নিজেদের প্রার্থীদের হারিয়ে দিয়েছেন বলে এলাকায় আলোচনা চলছে।

পটিয়া উপজেলা নির্বাচনে বিএনপি যেভাবে কৌশলী হয়ে এবং নেতাকর্মীদের সংগঠিত করে মাঠে নামতে পেরেছে, সমান সুযোগ থাকলেও আওয়ামী লীগ সেভাবে মাঠ দখলে ব্যর্থ হয়েছে।

শুরু থেকেই পটিয়ায় চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী মনোনয়নে দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে পারেননি আওয়ামী লীগ নেতারা। কর্মীদেরও ঐক্যবদ্ধ করে মাঠে নামাতে পারেনি।
নিজেকে একক নেতা হিসেবে অক্ষুন্ন রাখতে দুর্বল প্রার্থী চাপিয়ে দিয়েছেন মানুষের উপর, যাকে মানুষ সহজভাবে গ্রহণ করেননি।

এর বাইরে পটিয়ার তৃণমূলে মানুষের মধ্যে আওয়ামী লীগ বিরোধী মনোভাব আছে। এর সঙ্গে ধর্মীয় ইস্যুতে বিভিন্ন নেতিবাচক প্রচারণা চালিয়ে মানুষকে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে সক্ষম হন বিএনপি নেতারা। তাদের সঙ্গে ছিল জামায়াত আর হেফাজতের নেতারাও। ভোটকেন্দ্রে যাননি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকাংশ ভোটাররা।

সব মিলিয়ে শিক্ষিত ও সংখ্যালঘুদের অঞ্চল হিসেবে পরিচিত পটিয়ায় অখ্যাত এক বিএনপি নেতার কাছে চেয়ারম্যান পদে হেরেছে আওয়ামী লীগ।

চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোছলেম উদ্দিন আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, পটিয়ায় আমরা প্রার্থী দিয়েছিলাম। কিন্তু বিদ্রোহী প্রার্থীকে বসাতে পারিনি। এতে কর্মী থেকে সাধারণ মানুষ সবাই বিভ্রান্ত হয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে ফলাফলে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের অপর এক শীর্ষ নেতা বাংলানিউজকে বলেন, প্রার্থীকে জিতিয়ে আনার চেয়েও নেতা, এমপি সবাই নিজেকে প্রদর্শন করাকেই বড় করে দেখেছেন। সুসংগঠিতভাবে কোথাও আমরা প্রচারণা পর্যন্ত চালাতে পারিনি। নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করাতেই আমাদের কিছু নেতা বেশি ব্যস্ত ছিলেন। এর ফলে আমাদের দু’জন প্রার্থী মিলে বিএনপির প্রার্থীর অর্ধেক ভোট পেয়েছেন। এতে আমরা বিব্রত হয়েছি।

গত উপজেলা নির্বাচনে পটিয়ায় চেয়ারম্যান পদে জয় পেয়েছিলেন উপজেলা বিএনপির সভাপতি মোহাম্মদ ইদ্রিস মিয়া। এবার তিনি নির্বাচনে না দাঁড়িয়ে এলাকার মানুষের কাছে ‍অনেকটাই অপরিচিত ব্যবসায়ী ও উপজেলা বিএনপির সহ-সভাপতি মোজাফফর আহমদ টিপুকে সমর্থন দেন।

মোজাফফর আহমদ চৌধুরী টিপু বাংলানিউজকে বলেন, মানুষ এখন বিএনপিমুখী। মানুষ জোট বেঁধে বিএনপিকে ভোট দিয়েছে। দল আমাকে সমর্থন দিয়েছে বলেই আমি জিতেছি।

অন্যদিকে শুরুতে পটিয়ায় উপজেলা চেয়ারম্যান পদে উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মোতাহার হোসেন চৌধুরীকে সমর্থন দেন। কিন্তু বিদ্রোহী প্রার্থী থাকার অজুহাত দেখিয়ে তিনি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান। এরপর আকস্মিকভাবে কোলাগাঁও ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান নাছির আহমদকে সমর্থন দেয় আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে বিদ্রোহী হিসেবে মাঠে থেকে যান গতবারের ভাইস চেয়ারম্যান ও দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক তিমির বরণ চৌধুরী।

নাছির আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, আমি উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মোতাহার ভাই প্রার্থী হওয়ার পর আমি তাকে সমর্থন দিই। পরে মোতাহার ভাই যখন নির্বাচন করলেন না, তখন আমাকে ২ ফেব্রুয়ারি অতর্কিত আওয়ামী লীগের নেতারা বললেন নির্বাচন করতে হবে। আমাকে জোর করে এনে মনোনয়ন পত্র জমা দেয়া হয়।

বিদ্রোহী প্রার্থী তিমির বরণ চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, আওয়ামী লীগের প্রার্থীর এলাকায় কোন গ্রহণযোগ্যতা নেই। দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি (মোছলেম উদ্দিন) এবং পটিয়ার এমপি (সামশুল হক চৌধুরী) টাকা নিয়ে নাছির আহমদকে সমর্থন দিয়েছে। কিন্তু সব বড় বড় নেতার এলাকায় নাছির আহমেদ তৃতীয় হয়েছেন।

টাকা দেয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে নাছির আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, আমি তো নমিনেশন চাইনি। আমাকে জোর করে নমিনেশন দেয়া হয়েছে। তাহলে টাকার প্রশ্ন আসে কিভাবে ?

এ বিষয়ে কথা বলার জন্য পটিয়ার সাংসদ শামসুল হক চৌধুরীর মোবাইলে ফোন করা হলে তিনি মিটিংয়ে ব্যস্ত থাকায় কথা বলতে পারবেন না বলে জানানো হয়।

সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকা হিসেবে পরিচিতি আছে চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার। কিন্তু বৃহস্পতিবার ভোটগ্রহণের সময় সংখ্যালঘুদের আধিক্য আছে এমন বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে হিন্দু, বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকজনকে তেমনভাবে ভোটকেন্দ্রে যেতে দেখা যায়নি। সংখ্যালঘু নারীরা ভোটকেন্দ্রেই আসেননি বলে এলাকায় প্রচার আছে।

তিমির বরণ চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, নির্বাচনের আগের দিন এমপি সাহেবের লোকজন এলাকায় এলাকায় গিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনকে হুমকি ধমকি দিয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতারা মনে করেছেন, হিন্দুরা ভোটকেন্দ্রে গেলে আমি জিতে যাব। সেজন্য তারা আমাকে ঠেকানোর জন্য হিন্দুদের ভোটকেন্দ্রে না যেতে বলেছে।

অন্যদিকে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী মাজেদ ‍বেগম শিরু বাংলানিউজকে বলেন, শিব চতুদর্শীর উপবাসের কারণে ক্লান্ত থাকায় হিন্দু সম্প্রদায়ের মহিলারা কেউ ঘর থেকে বের হতে পারেননি।

এছাড়া ভোটগ্রহণের সময় অধিকাংশ কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের কোন সক্রিয় উপস্থিতিও চোখে পড়েনি। বিপরীতে ভোটকেন্দ্রে ভোটকেন্দ্রে সরব উপস্থিতি দেখা গেছে বিএনপির নেতাকর্মীদের। হেফাজতে ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত জিরি মাদ্রাসা থেকে বের হয়ে হেফাজত সমর্থকদের বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে সরাসরি বিএনপির প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা চালাতে দেখা গেছে। বিএনপির নেতাকর্মীদের রিক্সা, অটোরিক্সায় করে ভোটারদের কেন্দ্রে আনতে দেখা গেছে।

এলাকার লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিএনপি হেফাজতে ইসলামের মাধ্যমে এলাকায় এলাকায় আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ধর্মীয় ইস্যুতে প্রচারণা চালাতে সক্ষম হয়েছে। উপজেলা নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীকে ভোট দিলে বেগম খালেদা জিয়া আবারও প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন বলেও বিভিন্ন এলাকায় প্রচারণা চালানো হয়। ইসলামকে বাঁচাতে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ভোট দেয়ারও আহ্বান জানানো হয় বিভিন্ন এলাকায়।

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি নেতিবাচক ধর্মীয় প্রচারণার বড় শিকার হয়েছেন পটিয়ার মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী (গতবারের ভাইস চেয়ারম্যান) মাজেদা বেগম শিরু। তার সমর্থকরা জানান- মাজেদা বেগমের স্বামী শরীফ চৌহান গণজাগরণ মঞ্চের সমন্বয়ক, তিনি নাস্তিক, মাজেদা বেগম কমিউনিস্ট, হেফাজতে ইসলাম তার বিরুদ্ধে এসব মিথ্যা প্রচারণা চালিয়েছে।

এসব প্রচারণার ফলে নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ থেকে বিএনপিতে যোগ দেয়া আলোচিত-সমালোচিত প্রার্থী আফরোজা আক্তার জলি’র কাছে মাজেদা বেগম হেরেছেন। বিএনপির প্রচারণাসহ নির্বাচনী এসব কৌশল নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও পটিয়ার সাবেক সাংসদ গাজী শাহজাহান জুয়েল।

মাজেদা বেগম বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে বিভিন্ন কুৎসা রটানো হয়েছে। ধর্মীয় উসকানি দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা হয়েছে। ’

তবে নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী টিপু বাংলানিউজকে বলেন, প্রচারণা, কৌশল এসব কোন বিষয় নয়। গত ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের নামে আওয়ামী লীগ যে প্রতারণা করেছে সুযোগ পেয়ে পটিয়াবাসী তার জবাব দিয়েছে।

নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে মোজাফফর আহমদ টিপু আনারস প্রতীকে ৮১ হাজার ৪৫৮ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন। প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের নাছির আহমদ পেয়েছেন ৩০ হাজার ১৮ ভোট। আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী তিমির বরণ পেয়েছেন ২৫ হাজার ১৫৭ ভোট।

বাংলাদেশ সময়: ২০০২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৮,২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।