ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

ফটিকছড়ির চা বাগান

গ্যাস আর শ্রমিক সংকটে হারাচ্ছে সম্ভাবনা

স্পেশাল করেপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৪০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০১৪
গ্যাস আর শ্রমিক সংকটে হারাচ্ছে সম্ভাবনা

চট্টগ্রাম: দেশের চা শিল্পে সম্ভাবনা জাগালেও চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার চা বাগানগুলো নানা সমস্যায় জর্জরিত। বারবার দাবি জানানোর পরও চা বাগানগুলোতে দেয়া হচ্ছেনা গ্যাস সংযোগ।

দক্ষ শ্রমিক সংগ্রহেও বেগ পেতে হচ্ছে চা বাগান মালিকদের।

চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতেই সিমুতাং গ্যাসক্ষেত্রের অবস্থান।
অথচ গ্যাসের অভাবে ফটিকছড়ির চা বাগানগুলোকে প্রক্রিয়াজাতকরণের ক্ষেত্রে কয়লা অথবা জ্বালানি তেল ব্যবহার করতে হচ্ছে। এতে অতিরিক্ত উৎপাদন খরচের বোঝা টানতে হচ্ছে চা বাগানের মালিকদের। প্রতিযোগিতার বাজারে ক্ষেত্রবিশেষে তাদের লোকসানও গুণতে হচ্ছে।

এর ফলে ব্যাপক সম্ভাবনার চা শিল্প এখন নানা সংকটে ম্রিয়মান হয়ে পড়ছে।

সম্প্রতি ফটিকছড়ি উপজেলায় হালদা ভ্যালি টি এস্টেটসহ বিভিন্ন চা-বাগান ঘুরে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

হালদা ভ্যালি চা বাগানের ব্যবস্থাপক জাহাঙ্গীর আলম বাংলানিউজকে বলেন, ফার্ণেস অয়েল দিয়ে প্রক্রিয়াজাতকরণের খরচ পড়ে ৩২ টাকা। কয়লা ব্যবহার করলে পড়ে প্রতি কেজিতে ১২টাকা। অথচ গ্যাস ব্যবহার করতে পারলে লাগত মাত্র ৪টাকা। এতে বাজারেও কম দামে চা সরবরাহ করা যেত।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, চট্টগ্রাম জেলার ২২টি চা বাগানের মধ্যে ১৭টির অবস্থান ফটিকছড়িতে। দেশে উৎপাদিত চায়ের ৮ থেকে ৯ শতাংশের যোগান দেয় চট্টগ্রামের চা বাগানগুলো।

২০১৩ সালে দেশে চা উৎপাদন হয়েছে প্রায় ৬২ মিলিয়ন কেজি। বাংলাদেশ চা বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, পঞ্চগড় জেলার বাগানগুলোতে প্রতি হেক্টর জমিতে গড়ে এক হাজার ২৫০ কেজি চা উৎপাদন হয়। আপরদিকে ফটিকছড়ির চা বাগানগুলোতে গড়ে প্রতি হেক্টরে উৎপাদন হয় আড়াই থেকে তিন হাজার কেজি।

হালদা ভ্যালী চা বাগান পরির্দশনে গেলে ব্যবস্থাপক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, বাগানে উৎপাদিত পাতা গ্যাস চালিত কারখানায় প্রক্রিয়াজাত করতে পারলে ভালো চা তৈরি করা যায়। চট্টগ্রাম অঞ্চলের বাগানগুলোতে গ্যাস সংযোগ না থাকায় অন্য জেলায় উৎপাদিত চায়ের সাথে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছি।

তিনি আরও বলেন, চা পাতা বিক্রির দিক থেকে আমাদের (হালদা ভ্যালি) অবস্থান চতুর্থ। গ্যাস সংযোগ পেলে দেশের প্রথম সারির বাগানে পরিণত হতে পারব।
 
অনুসন্ধানে জানা গেছে, দেশের প্রথম সারির ১০টি চা বাগানের মধ্যে চারটির অবস্থান ফটিকছড়িতে। এই অঞ্চলের বাগান মালিকরা সম্মিলিতভাবে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (কেজিডিসিএল) কাছে গ্যাস সংযোগ প্রদানের জন্য লিখিত দাবি জানায়। কিন্তু এ ব্যাপারে কোন সাড়া পাওয়া যাচ্ছেনা কর্ণফুলী গ্যাস কর্তৃপক্ষের।  

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কেজিডিসিএল’র মহাব্যবস্থাপক (বিপণণ) প্রকৌশলী ফিরোজ আলম বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের গ্যাসের স্বল্পতা আছে। শহরের অনেক কারখানায়, আবাসিক খাতে আমরা গ্যাস সরবরাহ করতে পারছিনা। এ অবস্থায় চা বাগারে গ্যাস সরবরাগের আপাতত কোন পরিকল্পনা আমাদের নেই।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০০৩ সালে হালদা ভ্যালী চা বাগানটি সরকারের কাছ থেকে নিলামে কিনে নেন পেডরোলো গ্র“পের কর্ণধার নাদের খান। প্রথমে দুই হেক্টর জমিতে চা চাষ শুরু করেন তিনি। প্রায় ৪৩০ হেক্টর আয়তনের এই বাগানে বর্তমানে ২৬৪ দশমিক ৮৩ হেক্টর জমিতে চা চাষ হচ্ছে।

২০১৩ সালে এ বাগানে পাঁচ লাখ তিন হাজার ৪৩৪ কেজি চা উৎপাদন হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের ১৬৬টি চা বাগানের মধ্যে ফটিকছড়ি উপজেলার হালদা ভ্যালি টি এস্টেটই একমাত্র চা বাগান, যেখানে শুষ্ক মৌসুমে আধুনিক পদ্ধতিতে পাম্প করে পানি সেচ দেওয়ার সুব্যবস্থা রয়েছে। থাইল্যান্ড থেকে সেচ প্রযুক্তি আমদানি করে এ বাগানে স্থাপন করা হয়েছে। সাধারণত এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত চা পাতার মৌসুম হলেও আধুনিক সেচ ব্যবস্থার কারণে হালদা ভ্যালি চা বাগানে মার্চ মাসেই চা উৎপাদন শুরু হয় বলে জানান ব্যবস্থাপক জাহাঙ্গীর আলম।

তবে শ্রমিকদের নিয়েও সংকটে ভুগছে ‍হালদা ভ্যালিসহ ফটিকছড়ির চা বাগানগুলো।

হালদা ভ্যালি চা বাগানের ব্যবস্থাপক জাহাঙ্গীর আলম বাংলানিউজকে জানান, তাদের বাগানে প্রায় সাত’শ শ্রমিক কাজ করে। এদের মধ্যে সীতাকুণ্ডের বিভিন্ন রিজার্ভ ফরেস্ট থেকে সংগ্রহ করা তিন’শ ত্রিপুরা, ভারতের উড়িষ্যা এবং মাদ্রাজ থেকে আসা শ্রমিকও আছে।

হালদা ভ্যালি বাগানে শ্রমিকদের চা বোর্ড নির্ধারিত বেতন দেয়া হয়। এছাড়া ভর্তুকির মাধ্যমে প্রত্যেক শ্রমিককে মাত্র এক টাকা ৩০ পয়সা দরে সপ্তাহে তিন কেজি ২৭০ গ্রাম করে চাল দেয়া হয়। শ্রমিকদের জন্য চা বাগানে পাঁচ শয্যার একটি হাসপাতালও আছে। এছাড়া বাগানের ভেতরেই শ্রমিকদের জন্য সুদৃশ্য মাটির ঘর তৈরি করে দেয়া হয়েছে। প্রত্যেক ঘরেই বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

কিন্তু এরপরও শ্রমিকরা চা বাগান ছেড়ে অন্যান্য পেশার দিকে ঝুঁকে পড়ছে বলে জানান জাহাঙ্গীর আলম।

তিনি বাংলানিউজকে বলেন, চা বাগান ছেড়ে অনেকে সেলুন কিংবা অন্যান্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। কেউ কেউ কৃষিকাজের দিকেও ঝুঁকে পড়ছেন। এতে প্রায়ই আমরা দক্ষ শ্রমিক সংকটে ভুগছি। নতুন করে শ্রমিক সংগ্রহ করতেও আমাদের বেগ পেতে হচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চা বাগানের ভেতরে স্কুল না থাকায় শ্রমিকরা সন্তানের পড়ালেখার জন্য অনেক সময় বাগান ছেড়ে যান।

জাহাঙ্গীর আলম বাংলানিউজকে বলেন, চা বাগানের ভেতরে স্কুল করার বিষয়ে সরকারের কোন নীতিমালা নেই। আমাকে বাগান করার জন্য জমি লিজ দিয়েছে, স্কুল করার জন্য তো দেননি। এ বিষয়ে সরকার নীতিমালা করলে প্রত্যেক চা বাগানেই একটা করে স্কুল হতে পারে।

বাংলাদেশ সময়: ১৭০০ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৬,২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।