ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

অপহরণকারীদের ডাকতেন ‘স্যার’

হ্যান্ডকাপ পরিয়ে মৃদুলের উপর নির্যাতন চলে

রমেন দাশ গুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৩১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০১৪
হ্যান্ডকাপ পরিয়ে মৃদুলের উপর নির্যাতন চলে ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

চট্টগ্রাম: অপহরণকারীদের হেফাজতে থাকার অধিকাংশ সময় ধনাঢ্য স্বর্ণ ব্যবসায়ী মৃদুল চৌধুরীকে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে রাখা হয়। তাকে নির্যাতনের সময়ও মুখোশ ও হ্যান্ডকাপ পরিয়ে রাখা হত।

এছাড়া নির্যাতনের সময় তিনি র‌্যাবের বিরুদ্ধে কেন মামলা করেছিলেন সেটিও জিজ্ঞেস করে অপহরণকারীরা।

তবে অপহরণের সঙ্গে র‌্যাব জড়িত কিনা সেটি নিশ্চিত করতে পারেননি মৃদুল চৌধুরী।
তিনি জানিয়েছেন, অপহরণকারীরা তাকে ছেড়ে দেবার আগে বলেছে, তারা ডিবি নয়, র‌্যাবও নয়, তারা সন্ত্রাসী। কিন্তু অপহরণকারীদের তিনি ‘স্যার’ সম্বোধন করেছিলেন বলে জানিয়েছেন।

বুধবার সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম আদালতে উপস্থিত সাংবাদিকদের এসব তথ্য দিয়েছেন মৃদুল চৌধুরী। এর আগে তিনি মহানগর হাকিম সৈয়দ মাশফিকুল ইসলামের আদালতে ভিকটিম হিসেবে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন।

বুধবার দুপুর ২টার দিকে তাকে কঠোর নিরাপত্তায় আদালতে হাজির করে পুলিশ। বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে তাকে মহানগর হাকিমের খাস কামরায় ঢোকানো হয়। জবানবন্দি শেষে সন্ধ্যা ৬ টা ১৭ মিনিটে তিনি বেরিয়ে আসেন। এরপর মৃদুল চৌধুরী সাংবাদিকদের কাছে অপহরণ ও নির্যাতনের বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা দেন।

মুখে মুখোশ, হাতে হ্যান্ডকাপ
মৃদুল চৌধুরী জানান, ১১ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে ১০টার দিকে নগরীর হাজারি লেইন এলাকায় তার বাসা থেকে বেরিয়ে তিনি দোকানে যাচ্ছিলেন। পায়ে হেঁটে সামান্য দূরে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের নিচে যাবার পর একটি কালো রংয়ের নোহা মাইক্রোবাস এসে তার সামনে দাঁড়ায়। চালকের পাশে থাকা এক লোক তাকে ডিবি-র‌্যাবের লোক পরিচয় দিয়ে গাড়িতে উঠতে বলে। এক পর্যায়ে তারা ধ্বস্তাধ্বস্তি করে তাকে গাড়িতে তুলে ফেলে। এসময় তার দোকানের স্টাফ ঝুনু সাহা বিষয়টি দেখে চিৎকার শুরু করলে গাড়িতে থাকা লোকজন বলে, বেশি বাড়াবাড়ি করলে গুলি করে দেব। এরপর তাকে নিয়ে মাইক্রোবাসটি দ্রুত ওই স্থান ত্যাগ করে।

তিনি জানান, মাইক্রোবাসে তোলার সঙ্গে সঙ্গে মৃদুলের দু’হাতে হ্যান্ডকাপ এবং মুখোশ পরিয়ে দেয়া হয়। এরপর তার মাথা অপহরণকারীদের একজনের দু’হাঁটুর মাঝখানে ঢুকিয়ে রাখা হয়। আধাঘণ্টা থেকে ৩৫ মিনিট পর তাকে হ্যান্ডকাপ ও মুখোশ পরিহিত অবস্থায় ওই গাড়ি থেকে নামিয়ে আরেকটি গাড়িতে তোলা হয়। ওই গাড়ি প্রায় দু’ থেকে আড়াই ঘণ্টা চলার পর এক জায়গায় গাড়ি থামিয়ে রেখে অপহরণকারীরা দুপুরের খাবার খায়। ১৫ মিনিট পর তারা ফিরে আসে।

মৃদল চৌধুরী জানান, তাকে তুলে নেয়ার সময় মাইক্রোবাসটিতে ৬ জনকে তিনি দেখেছেন।

ফ্লাইওভার, শোনা যায় বিমান আর ট্রেনের শব্দ
মৃদুল চৌধুরী জানান, দুপুরের খাবার শেষে গাড়ি আরও ৩-৪ ঘণ্টা চলার পর তার মনে হচ্ছিল, তাদের গাড়ি একটি ফ্লাইওভারের উপর দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মুখোশের কারণে তিনি কিছুই দেখতে পাচ্ছিলেন না। সেখানে তাকে ওই গাড়ি থেকে নামিয়ে আরেকটি গাড়িতে তুলে। ৫-৭ মিনিট চলার পর ওই গাড়ি থেকে নামিয়ে তাকে আনুমানিক দোতলা কিংবা তিনতলা একটি ভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তিনি বিমানের শব্দ এবং ট্রেনের হুইসেল শুনতে পাচ্ছিলেন। কিছু কিছু গাড়িরও আওয়াজ শুনছিলেন। এভাবে ১১ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার বেলা ১২ টা পর্যন্ত তিনি ওই ভবনেই ছিলেন। পুরোটা সময় তিনি মুখোশ এবং হ্যান্ডকাপ পরিহিত অবস্থায় ছিলেন।

স্যার, আমার কি অপরাধ, মামলা করেছিলি কেন ?
মৃদুল চৌধুরী জানান, ১৪ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার বেলা সোয়া ১২টার দিকে তাকে মুখোশ পরিহিত অবস্থায় হাত পিছন দিকে বেঁধে আরেকটি ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাকে একটি খাঁচার মত জায়গায় ঢুকিয়ে দেয়া হয়। সুইচ টিপ দেয়ার পর তিনি কয়েক ফুট উপরে উঠে যান। এরপর তাকে বেদমভাবে পেটাতে থাকে।

মৃদুল জানান, এসময় তিনি চিৎকার করে বলছিলেন, স্যার আমার কি অপরাধ ? এসময় অপহরণকারীরা বলে, র‌্যাবের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলি কেন ? বেশি কথা বলবিনা। বেশি কথা বললে খবর আছে।

তিনি বলেন, ‘আমি বলি, স্যার আমাকে একবার ফ্লোরে নামান। আমার নি:শ্বাস চলে যাচ্ছে। তখন আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি। জ্ঞান ফিরলে দেখি তারা বলছে, একে ইলেকট্রিক শক দিতে হবে। পরে আরেকটি ঘরে নিয়ে আমাকে হাত বেঁধে শক দেয়। ’

মৃদুল চৌধুরী জানান, ইলেকট্রিক শক দেয়ার পাশাপাশি তাকে ব্যাপকভাবে হাঁটুতে মারধর করে। শরীরে প্রচণ্ড যন্ত্রণা আর রক্ত ঝরা শুরু হয়। পরে তাকে সাবান দিয়ে তার প্যান্ট ধুয়ে দিতে বলে। তাকে একটি লুঙ্গি পরানো হয়।

তিনি বলেন, বাথরুমে যাওয়া ছাড়া আমার চোখ সবসময় বাঁধা আর হ্যান্ডকাপ পরা থাকত। সেদিনও বাথরুম থেকে বের হওয়ার পর আমাকে হ্যান্ডকাপ লাগিয়ে দেয়া হল। চোখও বেঁধে দেয়া হল। আমি তাদের বললাম, স্যার আমাকে একটু ওষুধ দেন। আমাকে একটু মলম দেন।

তিনি জানান, এভাবে ১৪ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার থেকে পরবর্তী রোববার সকাল পর্যন্ত কেটে যায়।

৫০ লক্ষ টাকা মুক্তিপণ দাবি
মৃদুল জানান, রোববার সকাল ৯টা থেকে সাড়ে ৯টার দিকে তাকে আরেকটি ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে অপহরণকারীদের কয়েকজন এসে তাকে জিজ্ঞেস করে, তুই কি বাঁচতে চাস। তিনি বলেন, স্যার আমি বাঁচতে চাই। অপহরণকারীরা বলে, তাহলে ৫০ লক্ষ টাকা লাগবে।

তিনি জানান, মৃদুল ৪০ লক্ষ টাকা দেবে বললে অপহরণকারীরা রাজি হয়। তারা বলে, তোর পরিবারের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলে তিনদিন পর তোকে ছেড়ে দেব। অপহরণকারীরা বলে, তোর হাত অনেক উপরে। তোর জন্য তো মনে হয় আমাদের পালিয়ে যেতে হবে। র‌্যাব-ডিবি এরা তো মনে হয় আমাদের থাকতে দেবেনা।

মৃদুল বলেন, এসময় একজন এসে জিজ্ঞেস করে বলে, আমরা কে জানিস ? তিনি বলেন, আপনারা তো র‌্যাব-ডিবি পরিচয় দিয়ে আমাকে এনেছেন। এসময় ওই ব্যক্তি বলে, আমরা র‌্যাবও না, ডিবিও না, আমরা সন্ত্রাসী।

তবে অপহরণকারীরা মুক্তিপণ নেয়ার প্রসঙ্গে পরে আর কোন কথা বলেনি বলে দাবি করেন মৃদুল চৌধুরী।

মৃত্যু থেকে বেঁচে গেলাম
মৃদুল জানান, রোববার রাতে তাকে আবারও মুখোশ পরিহিত এবং পেছন থেকে হাত বাঁধা অবস্থায় একটি গাড়িতে তোলা হয়। প্রায় ৩-৪ ঘণ্টা গাড়ি চলার পর হঠাৎ ব্রেক কষলে মৃদুল দেখে নিঝুম রাত। অপহরণকারীরা বলে, সামনে পুলিশের গাড়ি। তুই এখানে নেমে দৌঁড় দে।

তিনি বলেন, ‘নামতে বললে আমার মনে ভয় ঢুকে যায়। মনে হচ্ছে, হয়ত মৃত্যু হবে। ’

মৃদুল জানান, গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়ে অপহরণকারীরা বলে, ‘তাড়াতাড়ি দৌঁড়ে যা, না হলে চাকু দিয়ে ভূরি বের করে দেব। ’ এসময় মৃদুল অপহরণকারীদের পা জড়িয়ে ধরেন। নামার আগে অপহরণকারীরা তার চোখে মলম ল‍াগিয়ে দেয় এবং মুখোশ খুলে চোখে কাপড় বেঁধে দেয়। গাড়ি থেকে ফেলে দেয়ার পর মৃদুল ধানক্ষেত দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে যাওয়া শুরু করে। এসময় তার চোখের কাপড় খুলে যায়। এসময় পেছন ফিরে মৃদুল দেখেন, অপহরণকারীদের গাড়ি চলে গেছে। তিনি ভাবেন, আমি মৃত্যু থেকে বেঁচে গেলাম।

তিনি বলেন, ‘আমার গায়ে হঠাৎ অনেক শক্তি এসে যায়। পেছন থেকে হাতের বাঁধন খুলে ফেলি। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছিল। প্রচণ্ড ঠান্ডায় আমার শরীরে কাঁপন ধরে। ১৫-২০ মিনিট এক জায়গায় বসে থেকে আবারও হেঁটে এবং কিছুদূর হামাগুড়ি দিয়ে সড়কে চলে যাই। সেখান থেকে বাজারে গিয়ে নৈশপ্রহরীর সঙ্গে যোগাযোগ করি। তার কাছ থেকে মোবাইল নিয়ে বাসায় ফোন করি। ’

অবশেষে মায়ের কাছে মৃদুল
অপহরণের ৯ দিন পর নগরীর পুরাতন টেলিগ্রাফ রোডের কে বি প্লাজায় নিজ বাসায় ফিরে গেছেন মৃদুল চৌধুরী।  

অপহরণকারীদের কবল থেকে মুক্তি পাবার পর থেকে পুলিশ হেফাজতে ছিলেন মৃদুল চৌধুরী। আদালতে জবানবন্দি দেয়ার পর বিচারক তাকে নিজের জিম্মায় ফেরত যাবার অনুমতি দেন। এরপর আদালত থেকে সরাসরি তাকে বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে জানান ছোট ভাই শিমুল চৌধুরী।

মৃদুলকে কাছে পেয়ে মা স্বরস্বতী বালা চৌধুরী বুকে জড়িয়ে ধরেন। এসময় তার চোখ দিয়ে শুধু জল ঝরছিল। মৃদুলের স্ত্রী, সন্তানসহ পরিবারের সদস্যরাও কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।

স্বরস্বতী বালা চৌধুরী বলেন, ‘আমারে ছেলেকে যারা এভাবে কষ্ট দিয়েছে, ভগবান যেন তাদেরও একইভাবে কষ্ট দেয়। আমি ছেলেকে ফিরে পাব ভাবিনি। আমার ছেলে ফিরে এসেছে। আমার আর কিছু চাইনা। শুধু চাই দোষীদের শাস্তি হোক। ’

শিমুল চৌধুরী বাংলানিউজকে জানান, মৃদুলের ডায়াবেটিসের মাত্রা বেড়ে গেছে। চিকিৎসক তাকে এক সপ্তাহ পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে বলেছেন।

উল্লেখ্য গত ১১ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে ১০টার দিকে নগরীর পুরাতন টেলিগ্রাফ রোডে নিজ বাসার সামনে থেকে র‌্যাবের বিরুদ্ধে মামলা করে আলোচিত ধনাঢ্য স্বর্ণ ব্যবসায়ী মৃদুল চৌধুরীকে তুলে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। এসময় তাদের এক আত্মীয় বাধা দেয়ার চেষ্টা করলে দুর্বৃত্তরা নিজেদের ডিবি পুলিশ পরিচয় দিয়ে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে দ্রুত ওই স্থান ত্যাগ করে।

এ ঘটনার পর মৃদুল চৌধুরীর পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, জানুয়ারির মাঝামাঝিতে র‌্যাবের এক কর্মকর্তাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে ৮০ ভরি স্বর্ণ লুটের একটি মামলা দায়ের করেন মৃদুল চৌধুরী। এ ঘটনার জের ধরে র‌্যাব তাকে অপহরণ করেছে বলে সন্দেহ করেন মৃদুলের স্ত্রী ও ভাই।

বাংলাদেশ সময়: ২০৩১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০১৪

* র‌্যাবের বিরুদ্ধে মামলা কেন, জানতে চেয়েছে অপহরণকারীরা
* পুলিশের সন্দেহের তালিকায় র‌্যাব নেই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।