ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

স্বর্ণ ব্যবসায়ী অপহরণ

পুলিশের সন্দেহের তালিকায় র‌্যাব নেই

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০০৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০১৪
পুলিশের সন্দেহের তালিকায় র‌্যাব নেই ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

চট্টগ্রাম: ধনাঢ্য স্বর্ণ ব্যবসায়ী মৃদুল চৌধুরীকে অপহরণের ক্ষেত্রে তার পরিবারের সন্দেহের তীর র‌্যাবের দিকে থাকলেও পুলিশের সন্দেহের তালিকায় র‌্যাব নেই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কেউ এ অপহরণের সঙ্গে জড়িত নয় বলেও দাবি পুলিশের।



সোমবার সন্ধ্যা পৌনে ৬টার দিকে নগরীর ও আর নিজাম রোডে রয়েল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মৃদুল চৌধুরীকে দেখতে যান নগর পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম। এক ঘণ্টারও বেশি সময় তার সঙ্গে একান্ত বৈঠকের পর বেরিয়ে আসেন সিএমপি কমিশনার।


হাসপাতালে উপস্থিত সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে সিএমপি কমিশনার বলেন, র‌্যাব অপহরণ করেছে এমন কোন অভিযোগ ভিকটিম মৃদুল চৌধুরী করেননি। কারণ গাড়িতে তোলার পরই তার চোখ বেঁধে ফেলা হয়। সবার মুখে মুখোশ ছিল। তিনি কাউকে দেখেননি। তিনি গাড়িতে বসে নড়াচড়া করে চেষ্টা করেছেন তার সঙ্গে গাড়িতে যারা ছিল তাদের কাছে অস্ত্র আছে কিনা কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য কিনা সেটা বোঝার জন্য। কিন্তু তিনি কিছুই বুঝতে পারেননি।

পুলিশ কমিশনার বলেন, ‘তবে কেউ না কেউ তো তাকে অপহরণ করেছে। এখন কারা অপহরণ করেছে সেটি তদন্ত না করে বলা যাবেনা। আমরা মনে করিনা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কেউ তাকে নিয়ে গিয়েছিল। তবে তদন্তের পরই পরিস্কার হবে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নাকি সন্ত্রাসীরা তাকে অপহরণ করেছে। ’

মৃদুল চৌধুরীর পরিবারের বক্তব্য অনুযায়ী র‌্যাবকে অপহরণের ক্ষেত্রে সন্দেহের তালিকায় রাখা হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না, আমরা সন্দেহ করছিনা। ’

কেন সন্দেহ করছেন না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা সন্দেহ করে তো কোন লাভ হবেনা, ভিকটিমকে তো বলতে হবে। যিনি ভিকটিম তিনি যদি সন্দেহের কথা বলতেন সেক্ষেত্রে আমরা তদন্তে সন্দেহের তালিকায় রাখতাম। ’

সিএমপি কমিশনার জানান, অপহরণের পর তার পরিবারের কাছে ৫০ লক্ষ টাকা মুক্তিপণ দাবির কথা বলেছিল। পরে বলেছে টাকা লাগবেনা।

তিনি বলেন, ভিকটিমের উপর খুব নির্যাতন করা হয়েছে। তাকে মারধর করা হয়েছে বলে তিনি আমাদের বলেছেন। তবে তাকে খাওয়াদাওয়ার কোন কষ্ট দেয়া হয়নি। এমনকি তাকে ওষুধও কিনে দেয়া হয়েছে।

সিএমপি কমিশনার বলেন, ভিকটিম তাকে নিয়ে সন্দেহজনক একটি জায়গায় রাখার কথা বলেছেন। আমরা ওই জায়গা ধরে তদন্ত শুরু করব।

র‌্যাবের সঙ্গে শত্রুতা ছিল
গত ১৫ জানুয়ারি ঢাকার সিএমএম আদালতে র‌্যাব-২ এর কর্মকর্ত‍া মেজর রাকিবুল আমিনসহ তিনজনের বিরুদ্ধে ৮০ ভরি স্বর্ণ লুটের মামলা করেন মৃদুল চৌধুরী। এরপর থেকে র‌্যাবের সঙ্গে শত্রুতার সৃষ্টি হয়েছিল বলে জানিয়েছেন মৃদুলের ছোট ভাই শিমুল চৌধুরী।

তবে এর জের ধরে র‌্যাব অপহরণ করেছে কিনা তাদের জানা নেই বলে জানান শিমুল চৌধুরী।

সোমবার বিকেলে হাসপাতালে উপস্থিত সাংবাদিকদের শিমুল চৌধুরী বলেন, মামলার কারণে র‌্যাবের সঙ্গে শত্রুতার সৃষ্টি হয়েছিল। তবে তারা অপহরণ করেছে কিনা আমার জানা নেই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কারা অপহরণ করেছে সেটা তদন্ত করে দেখবে।

হাসপাতালে উপস্থিত মৃদুল চৌধুরীর স্ত্রী শেলী চৌধুরী কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, গত ছয়দিন ধরে আমি কারও সঙ্গে কথা বলতে পারিনি, মুখে ভাত দিতে পারিনি। চোখের জলেই আমার দিন কেটেছে। যারা তাকে (মৃদুল চৌধুরী) অপহরণ করে নিয়ে গিয়ে এমন নির্যাতন করেছে তাদের যেন কঠোর শাস্তি হয়।

স্ত্রী বলেন, অপহরণকারীরা তাকে নেবার সময় র‌্যাব আর ডিবি’র পরিচয় দিয়েছিল। কিন্তু কারা অপহরণ করেছে সেটা তো এখন বলতে পারবনা। সেটা তদন্ত করে তাদের যেন কঠোর শাস্তি হয়।

পুলিশ-মিডিয়ার তোড়জোড়ের কারণেই মুক্তি
মৃদুল চৌধুরীকে অপহরণের পর থেকেই গণমাধ্যমে বিষয়টি ব্যাপকভাবে প্রচার হতে শুরু করে। মৃদুল চৌধুরীর পরিবার এবং পুলিশও মিডিয়ায় বিভিন্ন তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেন। পাশাপাশি স্বর্ণ ব্যবসায়ীরাও আন্দোলন শুরু করেন।

এতে ব্যাপকভাবে চাপ সৃষ্টি হওয়ায় দুর্বৃত্তরা মৃদুল চৌধুরীকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় বলে মনে করছেন পুলিশ ও তার পরিবারের সদস্যরা।

মৃদুল চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলে বেরিয়ে সিএমপি কমিশনার সাংবাদিকদের বলেন, অপহরণকারীরা পত্রিকা, টিভি মিডিয়ায় এত নিউজ কেন হচ্ছে তার কাছে বারবার সেটা জানতে চেয়েছে। সাংবাদিকদের মধ্যে আত্মীয়স্বজন কেউ আছে কিনা জানতে চেয়েছে। পত্রপত্রিকার সংবাদ নিয়ে তাদের মধ্যে উদ্বেগ ছিল।

অপহরণ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্ত‍া কোতয়ালী থানার এস আই মোহাম্মদ কামরুজ্জামান বাংলানিউজকে বলেন, তাকে ব্যাপক নির্যাতন করা হয়েছে। মাথায় আঘাত করা হয়েছে। হয়ত তাকে মেরে ফেলারও পরিকল্পনা ছিল।

তিনি বলেন, ‘কিন্তু শুরুতেই মিডিয়ায় বিষয়টি ব্যাপকভাবে প্রচার করে। আমরাও সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে পুরো বিষয়টিকে আওতার মধ্যে নিয়ে এসেছিলাম। এতে সন্ত্রাসীরা বুঝতে পেরেছে তাদের পক্ষে রাখা সম্ভব নয়। সেজন্য ফেলে রেখে গেছে। ’

মৃদুলের ছোট ভাই শিমুল চৌধুরী বলেন, মিডিয়ার কারণে অপহরণকারীরা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। আমরা মিডিয়ার কাছে কৃতজ্ঞ।

তবে চিকিৎসাধীন মৃদুল চৌধুরীর সঙ্গে সাংবাদিকদের সরাসরি কোন কথা বলতে দেয়া হয়নি।

এর আগে কুমিল্লা থেকে উদ্ধার হওয়া অপহৃত স্বর্ণ ব্যবসায়ী মৃদুল চৌধুরীকে কঠোর নিরাপত্তায় চট্টগ্রামে নিয়ে আসা হয়। সোমবার বিকেল ৪টা ৫৫মিনিটে দিকে চট্টগ্রামের ও আর নিজাম রোডের বেসরকারি রয়েল হাসপাতালে তাকে ভর্তি করা হয়।

এসময় তাকে বিধ্বস্ত দেখা গেছে। তিনি কান্না করছিলেন। এসময় তার সঙ্গে পরিবারের সদস্যরা ছিলেন। পরিবারের সদস্যরা তাকে পেয়ে আনন্দে আপ্লুত হয়ে পড়েন। পুলিশ ওই হাসপাতালটি ঘিরে রাখে।  

সোমবার ভোরে ৬টার দিকে কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার কংশনগর বাজার থেকে দেবপুর ফাঁড়ির পুলিশ তাকে উদ্ধার করে।
 
সোমবার ভোর পৌনে ৪টায় মৃদুলকে কংশনগর এলাকায় চোখ বাঁধা অবস্থায় কৃষি জমিতে ফেলে দিয়ে যায় অপহরণকারীরা। পরে আহত অবস্থায় মৃদুল কংশনগর বাজারে এলে বাজারের নৈশপ্রহরী হারুনুর রশিদ ভূঁইয়া তাকে দেখতে পেয়ে উদ্ধার করে বাড়ি নিয়ে যান। খবর পেয়ে ভোর ৫টার দিকে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে দেবপুর ফাঁড়িতে নিয়ে আসে।

নৈশপ্রহরী হারুনুর রশীদ বাংলানিউজকে বলেন, আমি তাকে উদ্ধার করে বাড়িতে আনার পর স্বর্ণ ব্যবসায়ী মৃদুল আমার মোবাইল ফোন দিয়ে তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পরে মৃদুলের পরিবারের লোকজন চট্টগ্রাম কোতোয়ালি থানা পুলিশকে বিষয়টি জানান। তাৎক্ষণিকভাবে চট্টগ্রাম কোতোয়ালি থানা পুলিশ কুমিল্লার দেবপুর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ উপ-পরিদর্শক (এসআই) দেবাশীষ বিশ্বাসকে জানালে তিনি আমার বাড়ি থেকে মৃদুলকে দেবপুর পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে যান।

এসআই দেবাশীষ বিশ্বাস বাংলানিউজকে জানান, পুলিশ মৃদুলকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়েছে। সকাল ১০টায় চট্টগ্রাম কোতোয়ালি থানার এসআই কামরুজ্জামানের নেতৃত্বে পুলিশের পাঁচ সদস্যের একটি দল ও মৃদুল চৌধুরীর ভাই শিমুল চৌধুরী কুমিল্লায় যান।

কুমিল্লায় পুলিশ হেফাজতে মৃদুল চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, ১১ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে ১০টায় দোকানে যাওয়ার উদ্দেশে আমি ও আমার ছোট ভাই জুনু বাড়ি থেকে বের হই। দোকানের কাছাকাছি আসার পর একটি নোহা মাইক্রোবাস এসে আমার সামনে দাঁড়ায়। পরে মাইক্রেবাস থেকে কয়েকজন লোক (সিভিল পোশাক পরিহিত ছিল) নেমে নিজেদের ডিবি পুলিশ পরিচয় দিয়ে আমাকে গাড়িতে উঠতে বলেন। আমি ভাবলাম যদি গাড়িতে না উঠি তাহলে হয়তো গুলি করতে পারে। তাই আমি গাড়িতে উঠি। এরপর তারা আমাকে মুখোশ পরিয়ে দেন। তা দেখে জুনু বাইরে থেকে চিৎকার শুরু করেন। ততক্ষণে গাড়িটি ছেড়ে দেয়। গাড়ি ছাড়ার আধঘণ্টা পর আরেকটি গাড়িতে আমাকে ওঠানো হয়। এভাবে তিনটি গাড়ি পরিবর্তন করেন তারা। পুরো সময় আমার চোখ বাঁধা ছিল। রাত ১০টার দিকে আমাকে তিন তলা একটি বাড়িতে ওঠানো হয়। আসলে এটি বাড়ি নাকি অন্য কিছু তা জানিনা।

তিনি আরো বলেন, এই ছয়দিনে আমাকে খাওয়া-দাওয়া করতে দেওয়া হয়। তবে দুইদিন পর থেকে আমাকে গালি-গালাজ করে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়। সোমবার ভোরে আমাকে চোখ বেঁধে একটি কৃষি জমিতে ফেলে তারা চলে যান। এই ছয়দিন আমার চোখ বাঁধা ছিল।

বাংলাদেশ সময়: ২০৩৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারী ১৭, ২০১৪

* স্বর্ণ ব্যবসায়ী মৃদুল চট্টগ্রামের হাসপাতালে ভর্তি
* চট্টগ্রাম থেকে অপহৃত স্বর্ণ ব্যবসায়ী কুমিল্লায় উদ্ধার

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।