ঢাকা, শুক্রবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

নজিরবিহীন মামলা, ঘটনাবহুল রায়ের দিন

আবদুল্লাহ আল মামুন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯০৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩০, ২০১৪
নজিরবিহীন মামলা, ঘটনাবহুল রায়ের দিন

চট্টগ্রাম: নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে দশ ট্রাক অস্ত্র মামলার রায় ঘোষিত হয়েছে। বহুল আলোচিত এ মামলার রায়কে ঘিরে সারা দেশের মানুষের নজর ছিল আদালতের দিকে।

কি ঘটবে কিংবা কি ঘটতে যাচ্ছে তা নিয়ে উৎসুক জনতারও আগ্রহের কমতি ছিল না। কিন্তু যাদের নিয়ে এ আগ্রহ তারা রায়ের আগে ছিলেন স্বাভাবিক ও নির্ভার।


অবশ্য রায়ের পর হয়েছেন হতাশ। জানালেন ক্ষোভ। দিলেন অভিশাপ। রায়কে বললেন ‘রাজনৈতিক’। নিজেদের দাবি করলেন ‘নির্দোষ’।

রায়কে ঘিরে পুরো আদালত এলাকায় তৈরি করা হয় নিরাপত্তা বলয়। বন্ধ করে দেওয়া হয় আদালত ও জেলা প্রশাসন কার্যালয় এলাকার গলি চিপাগলির পথগুলো। সকাল সাড়ে নয়টা থেকে আদালত প্রাঙ্গণে সাধারণের যাতায়াতও সীমিত করা হয়।

আদালতে বিচারক
ঘড়ির কাটা সকাল ১০টা ১২ মিনিটের ঘরে। সাইরেনের শব্দ। সতর্ক অবস্থান নিরাপত্তা কর্মীদের। দৌঁড়-ঝাপ শুরু গণমাধ্যম কর্মীদের। কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থায় আদালতে আসলেন চট্টগ্রামের বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক এস এম মজিবুর রহমান। গেলেন তার খাস কামরায়।

সকাল ১০টা ১৯ মিনিটে আদালতে আসেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ও মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট কামাল উদ্দিন আহমেদ।

আদালতে আসামিরা
এর প্রায় এক ঘণ্টা পর ১১টা ১২ মিনিটে কঠোর পুলিশি প্রহরায় প্রিজন ভ্যানে করে নিয়ে আসা হয় দু’টি মামলায় জেলহাজতে আটক ১১ আসামিকে। প্রথমে প্রিজন ভ্যান থেকে নামেন জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার(এনএসআই) সাবেক পরিচালক অবসরপ্রাপ্ত উইং কমান্ডার সাহাবুদ্দিন আহমেদ।

এরপর একে একে নেমে আসেন অস্ত্র খালাসের জন্য শ্রমিক সরবরাহকারী দীন মোহাম্মদ (৪৫), চোরাচালানি হাফিজুর রহমান হাফিজ (৪৮), রাষ্ট্রায়ত্ত সার কারখানা চিটাগং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেডের (সিইউএফএল) সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহসিন উদ্দিন তালুকদার (৬২), সাবেক জিএম (প্রশাসন) একেএম এনামুল হক (৬১), এনএসআই’র সাবেক মাঠ কর্মকর্তা আকবর হোসেন (৪৭), সাবেক উপ-পরিচালক অবসরপ্রাপ্ত মেজর লিয়াকত হোসেন (৪৩), এনএসআই’র সাবেক প্রধান অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুর রহিম(৬১), সাবেক প্রধান অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী (৬০) জামায়াতের আমির ও সাবেক শিল্পমন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী(৮২)। সর্বশেষ প্রিজন ভ্যান থেকে নামেন বিএনপি নেতা ও সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর (৫৩)।

এজলাসকক্ষে আসামিরা
এ সময় সবাইকে স্বাভাবিক দেখাচ্ছিল। কেউ তেমন উদ্বিগ্ন ছিলেন না। সাবেক দুই মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ছাড়া সবাই আদালতের আসামির কাঠগড়ায় ঢোকেন। কাঠগড়ায় প্রত্যেকবার বসার জন্য সাবেক দুই মন্ত্রীকে চেয়ার দেওয়া হলেও এবার দেওয়া হয়নি। তাই আদালতের এজলাসকক্ষের চেয়ারে বসে পড়েন তারা। এ সময় দু’মন্ত্রী ও তাদের আইনজীবীরা পুলিশের সঙ্গে বাক-বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন।

বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কাঠগড়ায় চেয়ার দেওয়া হলে দু’জনই পুলিশ কর্মকর্তাদের অনুরোধে কাঠগড়ায় গিয়ে বসেন।

অন্য আসামিরা কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকেন। একপর্যায়ে ক্লান্ত হয়ে তারা কাঠগড়ায় পত্রিকা বিছিয়ে বসে পড়েন।

কাঠগড়ায় আসামিরা
কাঠগড়ায় আসামিদের মধ্যে খুবই নির্ভার ছিলেন এনএসআই’র সাবেক পরিচালক অবসরপ্রাপ্ত উইং কমান্ডার সাহাবুদ্দিন আহমেদ। দোয়া দরুদ পড়ছিলেন সাবেক শিল্পমন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ অন্য আসামিরা। কিছুটা বিমর্ষ দেখা গেছে সি‌ইউএফএল’র সাবেক জিএম (প্রশাসন) একেএম এনামুল হক ও এনএসআই’র সাবেক প্রধান অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী।

নিজামীকে চকলেট দিলেন বাবর
কাঠগড়ায় সাবেক শিল্পমন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী ও সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর দু’জনই মাঝে মাঝে আলাপে ব্যস্ত ছিলেন। এক পর্যায়ে বাবর পকেট থেকে দু’টি চকলেট বের করেন। একটি নিজে মুখে দেন অন্যটি নিজামীর হাতে দেন। এর কিছুক্ষণ পরই নিজামীর আইনজীবীরা কলা ও পানি দিয়ে যান কাঠগড়ায়। নিজামী ও বাবর নিজেরা দু’টি নিয়ে অন্যদের কলাগুলো ভাগ করে দেন।

তসবিহ ও দোয়ায় সময় পার
আসামিরা কাঠগড়ায় ঢোকার পর থেকে দাঁড়িয়ে ও বসে দোয়া-দরুদ পড়ে সময় কাটান। সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও সিইউএফএল’র সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহসিন উদ্দিন তালুকদার- এ দু’জনের হাতেই ছিল তসবিহ। এছাড়া অন্যদেরও বিড়বিড় করে সারাক্ষণ দোয়া পড়তে দেখা গেছে।

এজলাসে বিচারক
দুপুর ১২টা ১৯ মিনিটে খাস কামরা থেকে এজলাসে বসেন চট্টগ্রামের বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক এস এম মজিবুর রহমান। রায় পড়া শুরু হতেই আসামিরা সবাই দাঁড়িয়ে পড়েন। চেষ্টা করেন রায় শোনার। কিন্তু আদালত কক্ষ হট্টগোলের কারণে শুনতে ব্যর্থ হয়ে কয়েকজন দাড়িয়ে থাকলেও লুৎফুজ্জামান বাবরসহ অন্যরা বসে পড়েন।

আইনজীবীর পোশাকে বহিরাগতরা
বহুল আলোচিত মামলাটির রায়কে কেন্দ্র করে আদালতে নিরাপত্ত বলয় তৈরি করা হলেও আইনজীবীর পোশাকে ঢুকে পড়েন বহিরাগতরা। অনেক ছাত্রদল ও শিবির কর্মীকে দেখা গেছে আইনজীবীর পোশাক পরে ঘুরতে। তাদের হট্টগোলের কারণে বিচারকের রায় শুনতে  পারেনি আসামিরা।

পরে রায়ের পর এজলাসকক্ষে বহিরাগতদের আনাগোনার বিষয়ে মহানগর পিপিও অভিযোগ করেন।

প্রথমে স্বস্তি পরে হতাশা
১২টা ৪১ মিনিটে রায় শেষ করে এজলাস ত্যাগ করেন বিচারক। এরপরই রায়ের বিষয়ে জানতে উদগ্রীব হয়ে উঠেন আসামিরা। বার বার আইনজীবীদের খোঁজ করছিলেন। এর মধ্যে অ্যাডভোকেট শাহাদাত নামে বিএনপি-জামায়াতপন্থি এক আইনজীবী আসামিদের জানালেন, চোরাচালান মামলায় সবার যাবজ্জীবন ও অন্য মামলায় সাত বছরের জেল। আসামিরা এটা শুনে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাননি। যেন এটাই হবে তাদের জানা ছিল।

আসামিদের আইনজীবীরা এরপর এসে জানালেন, অস্ত্র চোরাচালান মামলায় সবাইকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এ সময় উত্তেজিত হয়ে পড়েন লুৎফুজ্জামান বাবর। বিমর্ষ হয়ে পড়েন নিজামীসহ অন্যরা।

রায়ে ক্ষোভ
রায় শোনার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে লুৎফুজ্জামান বাবর বলেন, ‘এ রায় সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে দেওয়া হয়েছে। আমি নিদোর্ষ। এর সঙ্গে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। আমি মজলুম, আমি অসহায়। বিচারকের ওপরও আছেন এক বিচারক। আমি তার কাছে এ বিচার দিলাম। পরকালে এ বিচারকের বিচার হবে। সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দশ্যে এ রায়’।

নিজামী বলেন, ‘এ রায় সম্পূর্ণ রাজনৈতিক। এর সঙ্গে শিল্প মন্ত্রণালয়ের কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। এ রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করা হবে।

রায় শুনে অসুস্থ
কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে সারাক্ষণ বিমর্ষ ছিলেন সিইউএফএল’র সাবেক মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) একেএম এনামুল হক। প্রথমে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় শুনে স্বাভাবিক ছিলেন। পরে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার কথা শুনেই কাঠগড়ায় ঢলে পড়ে যান। অন্য আসামিরা তাকে ধরে দাঁড় করিয়ে রাখার চেষ্টা করেন। পরে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সহায়তায় তাকে কোলে করে প্রিজন ভ্যানে তোলা হয়।

স্বজনদের কান্না
রায় শুনেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন স্বজনরা। রায়ের পরই আদালতের কাঠগড়ায় দেখতে আসেন অবসরপ্রাপ্ত উইং কমান্ডার সাহাবুদ্দিন আহমেদের স্ত্রী ও কন্যা। এ সময় তারা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। কাঠগড়ার ভেতর থেকে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে স্বান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করেন সাহাবুদ্দিন। এক পর্যায়ে তিনিও কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। কিন্তু রায়ের কোনো প্রতিক্রিয়া জানাতে চাননি তার কন্যা ও স্ত্রী।

অস্ত্র খালাসের জন্য শ্রমিক সরবরাহকারী দীন মোহাম্মদের স্ত্রী মীনু আরা বেগমও রায় শুনে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। বলেন, ‘আমার স্বামী নির্দোষ। অন্যায়ভাবে এ রায় দেওয়া হয়েছে’।

ট্রলার মালিক হাজী আবদুস সোবহানের বোন ও ছেলেও আদালতের রায় শুনে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। এনএসআই’র সাবেক মাঠ কর্মকর্তা আকবর হোসেনের স্ত্রীও তার সঙ্গে দেখা করেন।

বৃহস্পতিবার দশ ট্রাক অস্ত্র আটক সংক্রান্ত দু’টি মামলার মধ্যে চোরাচালান মামলায় ১৪ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। অস্ত্র আইনে দায়ের করা অন্য মামলাটিতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ পেয়েছেন একই আসামিরা। এছাড়া অস্ত্র আটক মামলার অপর ধারায় সাত বছর কারাদণ্ড দেন বিচারক। দণ্ডপ্রাপ্ত প্রত্যেক আসামিকে ৫ লাখ টাকা করে জরিমানাও প্রদান করা হয়।
 
মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামিরা হচ্ছেন সাবেক শিল্পমন্ত্রী ও জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর এবং ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার সামরিক কমান্ডার পরেশ বড়ুয়া, এনএসআই’র সাবেক মহাপরিচালক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, এনএসআই’র সাবেক মহাপরিচালক অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুর রহিম, ডিজিএফআই’র সাবেক পরিচালক (নিরাপত্তা) অবসরপ্রাপ্ত উইং কমাণ্ডার সাহাবুদ্দিন আহমেদ, এনএসআই’র সাবেক উপ-পরিচালক অবসরপ্রাপ্ত মেজর লিয়াকত হোসেন, এনএসআই’র সাবেক মাঠ কর্মকর্তা আকবর হোসেন খান, রাষ্ট্রায়ত্ত সার কারখানা চিটাগং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেডের (সিইউএফএল) সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহসিন উদ্দিন তালুকদার,  সিইউএফএল’র সাবেক মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) কে এম এনামুল হক, সাবেক ভারপ্রাপ্ত শিল্পসচিব নুরুল আমিন, চোরাচালানি হিসেবে অভিযুক্ত হাফিজুর রহমান, অস্ত্র খালাসের জন্য শ্রমিক সরবরাহকারী দীন মোহাম্মদ ও ট্রলার মালিক হাজী আবদুস সোবহান।

অস্ত্র চোরাচালান মামলায় ৫২ জনের মধ্যে বাকি ৩৮ জন আসামি বেকসুর খালাস পেয়েছেন। অস্ত্র আটক মামলায় ৫০ জনের মধ্যে বাকি ৩৬ জন বেকসুর খালাস পান।

বাংলাদেশ সময়: ১৯০১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩০, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।