ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

রায়ের জন্য অপেক্ষা

রমেন দাশগুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭২৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩০, ২০১৪
রায়ের জন্য অপেক্ষা

চট্টগ্রাম: ঘটনার দশ বছর পর চাঞ্চল্যকর দশ ট্রাক অস্ত্র আটক সংক্রান্ত দু’টি মামলার রায় অবশেষে ঘোষণা হতে যাচ্ছে। চট্টগ্রামের স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক এস এম মুজিবুর রহমান আজ(বৃহস্পতিবার) এ রায় ঘোষণা করবেন।

   

‌আর্ন্তজাতিক অঙ্গণে তোলপাড় সৃষ্টি করা, দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অস্ত্রের চালান আটক হওয়ার এ ঘটনায় অস্ত্র আইনে এবং চোরাচালান আইনে নগরীর কর্ণফুলী থানায় দু’টি মামলা দায়ের হয়। দু’টি মামলা এক বাক্যে ‘দশ ট্রাক অস্ত্র মামলা’ হিসেবে ব্যাপক পরিচিত পায়।


একইসঙ্গে চলা দু’টি মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ, যুক্তিতর্কসহ সব কার্যক্রম শেষে আদালত গত ১৩ জানুয়ারি রায় ঘোষণার জন্য ৩০ জানুয়ারি অর্থাৎ আজ (বৃহস্পতিবার) সময় নির্ধারণ করেন।

এদিকে দু’টি মামলাতেই রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সব আসামী সর্বোচ্চ শাস্তি পাবেন বলে আশা করছেন। আর আসামীপক্ষের আইনজীবীদের আশা, আসামীরা বেকসুর খালাস পাবেন।

কি ঘটেছিল সেইদিন
২০০৪ সালের ১ এপ্রিল রাত ১২টা। নগর পুলিশের তৎকালীন উপ-কমিশনার (বন্দর) আবদুল্লাহ হেল বাকী বেতার মারফত সংবাদ পান সিইউএফএল জেটিঘাটে কিছু অবৈধ মালামাল ট্রলার থেকে ট্রাকে উত্তোলন করা হচ্ছে। রাত ১২টা ৫৫ মিনিটে কর্ণফুলী থানার ওসি আহাদুর রহমান ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে দু’টি মাছ ধরা ট্রলার জেটিতে বাঁধা অবস্থায় দেখতে পান। ওইসময় একটি ক্রেনের সাহায্যে কয়েকজন লোক ট্রলার দু’টি থেকে মালামাল নামিয়ে অবস্থানরত পাঁচটি ট্রাকে বোঝাই করছিলেন। নানা নাটকীয়তার পর পুলিশ অস্ত্র ও গোলাবারুদগুলো আটক করে পরদিন দুপুরে দামপাড়া পুলিশ লাইনে নিয়ে আসে।

অস্ত্র আটকের সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত সার্জেণ্ট হেলাল উদ্দিনের সাক্ষ্যে পাওয়া গেছে ঘটনার বর্ণণা। ২০১২ সালের ৩০ জুলাই আদালতে দেয়া সাক্ষ্যে হেলাল জানান, ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল রাতে ডিসি (পোর্ট) আবদুল্লাহ হেল বাকীর নির্দেশে সার্জেন্ট আলাউদ্দিনকে সহযোগিতা করতে তিনি সিইউএফএল জেটিতে যান। সেখানে আলাউদ্দিন তাকে জানান, অস্ত্র খালাসকারী দু’জন লোকের একজন নিজেকে হাফিজুর রহমান এবং অপরজন উলফা নেতা আবুল হোসেন বলে পরিচয় দিয়েছে। মালামালগুলো অস্ত্র ও গোলাবারুদ এবং সরকারের সকল এজেন্সি (গোয়েন্দা সংস্থা) এ মালামালের বিষয়ে অবগত আছে বলে তিনি শুনেছেন বলেও হেলালকে জানান।

হেলাল ঘটনাস্থলে গিয়েই মালামালের দাবিদারের সহযোগী ৫ জনকে আটক করে বন্দর পুলিশ ফাঁড়িতে পাঠিয়ে দেন। ডিসি (পোর্ট) আবদুল্লাহ হেল বাকি ঘটনাস্থলে গেলে আবুল হোসনকে তার কাছে নিয়ে যান সার্জেণ্ট হেলাল ও আলাউদ্দিন। এসময় বাকি ও আবুল হোসেন দূরে গিয়ে কথা বলতে থাকেন। পরে আবুল হোসেনকে আর ঘটনাস্থলে দেখতে পাইনি।

মামলার তদন্ত চলাকালীন সময়ে ওই আবুল হোসেনকে পরে টিআই প্যারেডে এনএসআই’র উপ-পরিচালক অবসরপ্রাপ্ত মেজর লিয়াকত হোসেন হিসেবে শনাক্ত করেছিলেন হেলাল উদ্দিন।

সাক্ষ্যে হেলাল জানায়, ঘটনাস্থল থেকে তিনি যে পাঁচজনকে আটক করেছিলেন তাদের পরবর্তীতে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর নির্দেশে ছেড়ে দেয়া হয় বলে শুনেছেন। আবুল হোসেন নামধারী লিয়াকতকেও বাবরের নির্দেশে ছেড়ে দেয়া হয় বলে আদালতে যুক্তি উপস্থাপনকালে বলেছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী।

কি ছিল দশ ট্রাকে ?
পুলিশের জব্দ তালিকা অনুযায়ী দশ ট্রাক অস্ত্রের মধ্যে ছিল ৬৯০টি এসএমজি (৫৬-১) ও ২৭৯২টি ম্যাগজিন, ৬০০টি এসএমজি (৫৬-১) ও ৪০০টি ম্যাগজিন, ১৫০টি রকেট লাঞ্চার, ৪০০টি নাইন এম এম সেমি অটোমেটিক স্পার্টিং রাইফেল ও ৮০০টি ম্যাগজিন, ১০০টি টমিগান ও ৪০০ ম্যাগজিন, ২০০০ লাঞ্চিং গ্রেনেড টিউব, ১৫০টি সাইড ফর রকেট লাঞ্চার, ৫১২টি ৭.৬২ বোরের এসএমজি ও ৩৯ হাজার ৬৮০ রাউণ্ড গুলি, ১৭৬টি ৭.৬২ বোরের পিস্তল ও চার লক্ষ টমিগানের গুলি, ২৪ হাজার ৯৯৬টি হ্যাণ্ড গ্রেনেড, ৮৪০টি ৪০ এম এম রকেট, এলিনকো ওয়াকিটকি সেট এবং অস্ত্র সংরক্ষণের বিভিন্ন সরঞ্জাম।

এছাড়া ঘটনাস্থল থেকে পাঁচটি ট্রাক, এমভি খাজার দান ও এমভি শাহ আমানত নামে দু’টি মাছ ধরার ট্রলার, ২০ কেজি ওজনের ৮৭টি লবণের বস্তা, ৩০টি ধানের তুষের বস্তা, ২০টি ১০ কেজি ওজনের চাউলের বস্তা।

নাটকীয়তায় ভরা তদন্ত
২০০৪ সালের ১ এপ্রিল রাতে রাষ্ট্রায়ত্ত সার কারখানা চিটাগং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেডের (সিইউএফএল) জেটিঘাটে দশ ট্রাক অস্ত্রের চালানটি খালাসের সময় ধরা পড়ে। এমভি শাহ আমান ও এমভি খাজার দান নামে দু’টি ফিশিং ট্রলার থেকে অস্ত্রগুলো খালাসের সময় গোপন সংবাদের ভিত্তিতে পুলিশ গিয়ে সেগুলো আটক করে।

এ ঘটনায় কর্ণফুলী থানার তৎকালীন ওসি আহাদুর রহমান বাদি হয়ে অস্ত্র আইনের ১৯ (ক) ধারায় ৪৩ জনকে এবং চোরাচালানের অভিযোগে বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৫ (বি) ধারায় ৪৫ জনকে আসামী করে পৃথক দু’টি মামলা মামলা দায়ের করেন।

এতবড় অস্ত্রের চালান খালাসের ঘটনায় বিস্ময়করভাবে আসামী করা হয় ট্রলার মালিক, ঘাট শ্রমিক, পরিবহন শ্রমিক, ট্রলারের সারেং, স্থানীয় ইউপি সদস্য, এলাকার সাধারণ মানুষকে।  

দায়েরের পর দু’টি মামলা তদন্তের দায়িত্ব নিজেই নেন ওসি আহাদুর রহমান। পরবর্তীতে বাদি ও তদন্তকারী কর্মকর্তা একই ব্যক্তি নিয়ে সমালোচনা সৃষ্টি হলে তদন্তভার ন্যস্ত হয় সিআইডির কাছে। ২৬ এপ্রিল তদন্তভার নেন সিআইডির এএসপি কবির উদ্দিন।

দু’মাস তদন্তের পর ২০০৪ সালের ১১ জুন সিআইডির এএসপি কবির উদ্দিন অস্ত্র আটক মামলায় ৪৩ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেন। একই বছরের ৯ নভেম্বর সিআইডির এএসপি নওশের আলী খান চোরচালান মামলায় ৪৫ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেন।

কিন্তু তৎকালীন মহানগর পিপি ও বিএনপি নেতা আব্দুস সাত্তার অস্ত্র আটক মামলার অভিযোগপত্রের উপর নারাজি দেন। তার যুক্তি, ট্রাকগুলো যে পরিবহন কোম্পানি থেকে ভাড়া করা হয়েছিল তার মালিককে আসামী কিংবা সাক্ষী করা হয়নি। এছাড়া অস্ত্র খালাসের সঙ্গে আবুল হোসেন নামে একজনের সম্পৃক্ততার বিষয় প্রকাশ পেয়েছিল। তার বিষয়েও কোন তদন্ত হয়নি।

আব্দুস সাত্তারের আবেদনের প্রেক্ষিতে সিআইডির এএসপি নওশের আলী খান পুন:তদন্ত করে অস্ত্র আটক মামলায় ২০০৪ সালের ২৫ আগস্ট আরও এক দফা অভিযোগপত্র দেন। কিন্তু তাতে আসামীর সংখ্যার কোন পরিবর্তন হয়নি। শুধুমাত্র ট্রাকের মালিক প্রতিষ্ঠান গ্রীণওয়েজ ট্রান্সপোর্টের মালিক হাবিবুর রহমানকে সাক্ষী করা হয়।

এরপর ২০০৫ সালের ২৩ এপ্রিল অস্ত্র আটক মামলায় এবং ২০০৪ সালের ৩০ নভেম্বর চোরাচালান মামলায় আসামীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়।

২০০৫ সালের ৬ জুলাই দু’মামলায় বাদি আহাদুর রহমান প্রথম সাক্ষ্য দেন। ২০০৭ সালের ১৪ আগস্ট পর্যন্ত সাক্ষ্যগ্রহণ চলে। তখন পর্যন্ত অস্ত্র আটক মামলায় ৩১ জন এবং চোরাচালান মামলায় ২৮ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দেন।

সেনাসমর্থিত তত্তাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালের ২০ নভেম্বর রাষ্ট্রপক্ষের তৎকালীন কৌসুলী ও অতিরিক্ত মহানগর পিপি হুমায়ন কবির রাসেল মামলার অধিকতর তদন্তের জন্য মহানগর দায়রা জজ আদালতে আবেদন করেন। সেই আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত অস্ত্রের উৎস, গন্তব্য, অস্ত্রের ধরণ, চালান থেকে অস্ত্র খোয়া গিয়েছিল কিনা, কাদের জন্য অস্ত্র আনা হয়েছিল, কোন জলযানে অস্ত্র ঢুকেছিল-এ ধরনের সাতটি পর্যবেক্ষণসহ অধিকতর তদন্তেরে আদেশ দেন।

সিআইডির এএসপি ইসমাইল হোসেন প্রথম দফা অধিকতর তদন্তের দায়িত্ব পেলেও তিনি তদন্ত শেষের আগেই বিদায় নেন। পরে সিআইডি’র চট্টগ্রাম অঞ্চলের সিনিয়র এএসপি মনিরুজ্জামান চৌধুরী ২০০৯ সালের ২৯ জানুয়ারি তদন্তভার গ্রহণ করেন। মনিরুজ্জামানের তদন্তে বেরিয়ে আসতে থাকে ঘটনার সঙ্গে জড়িত রাঘববোয়ালদের নাম, উলফার প্রসঙ্গ, একের পর এক স্পর্শকাতর ও চাঞ্চল্যকর বিষয়।
 
অধিকতর তদন্ত শেষে ২০১১ সালের ২৬ জুন দু’টি মামলায় সম্পূরক অভিযোগপত্র জমা দেন তদন্তকারী কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান। এতে দু’ মামলায় নতুনভাবে ১১ জনকে আসামী হিসেবে অর্ন্তভুক্ত করা হয়।

সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিলের পর নতুন ১১ জনসহ অস্ত্র আইনের মামলায় আসামীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৫৪ জনে এবং চোরাচালান মামলায় আসামী হয় ৫২ জন। কিন্তু উভয় মামলায় আসামী হিসেবে থাকা চারজনের ইতোমধ্যে মৃত্যু হয়। মৃত্যুবরণ করা চার আসামী হলেন, ইয়াকুব আলী, মুনির আহমেদ, আতাউর রহমান ও আবুল কাশেম মধু।

আসামী হিসেবে আছেন যারা
চারজনের মৃত্যুর পর বর্তমানে অস্ত্র আটক মামলায় আসামী হিসেবে আছে ৫০ জন এবং চোরাচালান মামলায় ৫২ জন।

অস্ত্র আটক মামলার আসামীদের মধ্যে ১১ জন হাজতে, ২৭ জন আসামী জামিনে এবং ১২ জন পলাতক আছেন।

হাজতে থাকা আসামীরা হলেন, জামায়াতে ইসলামীর আমীর ও সাবেক শিল্পমন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী (৮২), বিএনপি নেতা সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর (৫৩), এনএসআই’র সাবেক দুই প্রধান অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী (৬০) ও অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুর রহিম (৬১), সাবেক পরিচালক অবসরপ্রাপ্ত উইং কমান্ডার সাহাবুদ্দিন আহমেদ (৫৩), সাবেক উপ-পরিচালক অবসরপ্রাপ্ত মেজর লিয়াকত হোসেন (৪৩), সাবেক মাঠ কর্মকর্তা আকবর হোসেন (৪৭), সিইউএফএল এর সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহসিন উদ্দিন তালুকদার (৬২), সাবেক জিএম (প্রশাসন) একেএম এনামুল হক (৬১), চোরাচালানি হাফিজুর রহমান হাফিজ (৪৮) এবং অস্ত্র খালাসের জন্য শ্রমিক সরবরাহকারী দীন মোহাম্মদ (৪৫)।  

জামিনে থাকা আসামীরা হলেন, হাজী মো.আব্দুস সোবহান (৬০), সানোয়ার হোসেন চৌধুরী (৫০), দিলদার হোসেন চৌধুরী (৪৭) মরিয়ম বেগম ওরফে বদনি মেম্বার (৪৩), জসীম উদ্দিন ওরফে জসীম (৩৫), আব্দুল আজিজ (৪৯), মো. আকতার (৪৬), মো.জাহাঙ্গীর (৪৩), নূরুল আবছার ওরফে আবছার মেম্বার (৪৫), আরজু মিয়া প্রকাশ পাগলা (৫৮), এজাহার মিয়া (৫৫), মুজিবুর রহমান ভুলু (৫৭), শেখ মোহাম্মদ (৪৭), ফজল আহাম্মদ চৌধুরী (৪৩), আকবর আলী (৪৬), বাদশাহ মিয়া (২৪), ওসমান মিস্ত্রি (৩৬), আব্দুল মান্নান (৩২), কবির আহাম্মদ (৩৪), মো.রফিক (৩০), মনির আহাম্মদ (৩২), আব্দুল মালেক (৩৫), মঞ্জুরুল আলম (২৮), সালেহ জহুর প্রকাশ গুরা মিয়া (৩০), ফিরোজ আহম্মদ (৩২), সাইফুদ্দিন (৫০) এবং কামাল মিয়া (৩৮)।

পলাতক আসামীরা হলেন, উলফা’র সামরিক কমাণ্ডার পরেশ বড়–য়া (৫৪), সাবেক ভারপ্রাপ্ত শিল্প সচিব নুরুল আমিন (৫৮), প্রদীপ কুমার দাশ প্রকাশ ব্রজগোপাল (৩৮), নূরনবী (৩৬), সিরাজুল ইসলাম (৩৩), হেলাল উদ্দিন (৩০), বাবুল মিয়া (৩৪), আব্দুর রহিম মাঝি (৩৫), আব্দুস সবুর (৩২), মো.শাহআলম (৩৪), মো.সোবহান (৩৩) ও শাহজাহান (৩৮)।

চোরাচালান মামলায় ১১ জন হাজতে, ২৮ জন জামিনে এবং ১৩ জন আসামী পলাতক আছেন। অস্ত্র আটক মামলায় আসামী হিসেবে থাকা সবাই চোরাচালান মামলায়ও আসামী হিসেবে আছেন। অতিরিক্ত দু’আসামী হলেন,  পলাতক আবুল হোসেন এবং জামিনে থাকা সফিকুর ওরফে সফিউর রহমান।

তবে অভিযোগপত্রে উল্লেখ থাকা ওই আবুল হোসেন এনএসআই’র সাবেক উপ-পরিচালক অবসরপ্রাপ্ত মেজর লিয়াকত বলে শনাক্ত করেছেন মামলার দু’জন সাক্ষী যারা অস্ত্র আটকের সময় সিইউএফএল অবস্থান করছিলেন।  

10-trak-02অভিযোগ গঠন, সাক্ষ্যগ্রহণ
২০১১ সালের ১৫ নভেম্বর চট্টগ্রামের স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক এস এম মুজিবুর রহমান দু’টি মামলার আসামীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। ২৯ নভেম্বর থেকে দু’মামলায় একযোগে পুনরায় সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়।

টানা দু’বছর ধরে সাক্ষ্যগ্রহণের পর ২০১৩ সালের ১০ অক্টোবর তদন্তকারী কর্মকর্তা মনিরুজ্জামানের জেরা শেষ হওয়ার মধ্য দিয়ে সাক্ষ্যগ্রহণ সমাপ্ত ঘোষণা করেন আদালত। অস্ত্র মামলায় মোট ৫৬ জন এবং চোরচালান মামলায় মোট ৫৩ সাক্ষী সাক্ষ্য দেন। এর মধ্যে অধিকতর তদন্তের আগে অস্ত্র মামলায় সাক্ষ্য দেন ৩১ জন এবং চোরাচালান মামলায় সাক্ষ্য দেন ২৮ জন। দু’টি মামলায় পাঁচজন দু’দফা সাক্ষ্য দেন। উভয় অভিযোগ পত্রে পৃথকভাবে ২৬৫ জন সাক্ষী হিসেবে ছিলেন।

যারা সাক্ষ্য দিয়েছেন তারা হলেন, মামলার বাদি আহাদুর রহমান, হাবিলদার গোলাম রসুল, নূর আলম সওদাগর, সার্জেণ্ট মিজানুর রহমান, সুনিল কুমার সেন, কনস্টেবল ইউসুফ আলী, কনস্টেবল মোজাম্মেল হক, জয়নাল আবেদিন, সার্জেণ্ট আলাউদ্দিন ও হেলাল উদ্দিন, সিইউএফএল’র সাবেক প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা মোবিন হোসেন খান, সিইউএফএল’র সাবেক এমডি মহসিন উদ্দিন তালুকদার (বর্তমানে আসামী), চৌকিদার আহমেদ নূর, গোলাম মোরশেদ খান, ওমর ফারুক, নাজিমউদ্দিন, আব্দুল গফুর, মুরাদুজ্জামান, মো.সেকান্দর, আনসার সদস্য কাজী আবু তৈয়ব, মনসুর আলী ও কাইয়ূম বাদশা, সোলাইমান, শাহজাহান, ইসমাইল, আব্দুল কুদ্দুস, এনামুল হক, মো.লোকমান, আব্দুল মতিন মিয়া, মাশরুকুর রহমান, তছলিম উদ্দিন, শেখ আহাম্মদ, সাবেক পুলিশ সুপার মাহমুদুর রহমান, সাবেক শিল্প সচিব ড.শোয়েব আহমেদ, বিসিআইসি’র সাবেক চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল ইমামুজ্জামান বীরবিক্রম, গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএইফআই’র সাবেক মহাপরিচালক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল সাদিক হাসান রুমি, এনএসআই’র সাবেক পরিচালক অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এনামুর রহমান চৌধুরী, ডিজিএফআই’র সাবেক ডিটাচমেন্ট কমান্ডার অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল একেএম রেজাউর রহমান, এনএসআই’র সাবেক সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ আলী, সিএমপির বন্দর জোনের তৎকালীন উপ-পুলিশ কমিশনার আবদুল্লাহ হেল বাকী, সাবেক পুলিশ কমিশনার এস এম সাব্বির আলী, সাবেক স্বরাষ্ট্র সচিব ওমর ফারুক, সাবেক ডিআইজি (এসবি) শামসুল ইসলাম, সাবেক ডিআইজি (সিআইডি) ফররুখ আহমেদ, গ্রীণওয়েজ ট্রান্সপোর্টের মালিক হাবিবুর রহমান, সাবেক মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মুনতাসির আহমেদ, আবু হান্নান, ওসমান গণি, কিরণ চন্দ্র রায় ও মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান এবং মো.গোলাম মোস্তফা, একেএম মহিউদ্দিন চৌধুরী, মোহাম্মদ আব্দুস সালাম খান, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হাসান মাহমুদ তাইয়েবুর রহমান এবং তদন্তকারী কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান চৌধুরী।

রাষ্ট্রপক্ষের কৌসুলীর বক্তব্য
সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিলের পর থেকে রাষ্ট্রপক্ষে দশ ট্রাক অস্ত্র মামলা পরিচালনা করে আসছেন চট্টগ্রাম মহানগর পিপি অ্যাডভোকেট কামালউদ্দিন আহমেদ। তার দাবি, তিনি সব আসামীর বিরুদ্ধে অভিযোগপত্রে আনা অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন। এজন্য তিনি আসামীদের সর্বোচ্চ সাজাও আশা করছেন।

মহানগর পিপি বাংলানিউজকে বলেন, মামলায় দু’ধরনের আসামী আছেন। কিছু রাঘববোয়াল আছে আর কিছু শ্রমিক-কর্মচারী, ট্রাক চালক, হেল্পার আছেন। রাঘববোয়ালরা রিমোট কন্ট্রোল সিস্টেমে সিণ্ডিকেট করে অস্ত্র এনেছেন। তাদের কর্মকাণ্ডে এই জিনিসটা প্রতীয়মান হয় যে, তারা বিষয়টি আগে থেকে জানতেন। আর শ্রমিক-চালকরাও অপরাধ করেছেন কারণ তারা অস্ত্র বহন করেছেন। তবে দু’অপরাধের ধরণ ভিন্ন। এখন আদালত কি পর্যবেক্ষণ দেন সেটা রায়ে দেখা যাবে।

পিপি বলেন, আমি মনে করি, ঘটনার সঙ্গে যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত মূল আসামী তাদের বিরুদ্ধে সব অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করা গেছে।

আসামীপক্ষের আইনজীবীর বক্তব্য
আসামীপক্ষের আইনজীবীরা বলেছেন, যারা ঘটনাটি ঘটিয়েছেন তারা দেশের প্রচলিত অস্ত্র আইনে ও চোরাচালান আইনে অপরাধ করেছেন তাতে কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু তদন্তকারী কর্মকর্তার তদন্তে প্রকৃত আসামীরা বেরিয়ে আসেননি এবং যাদের আসামী করা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ সুনির্দিষ্ট কোন অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি।

আসামী সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের আইনজীবী মফিজুল হক বাংলানিউজকে বলেন, যেসব অস্ত্র আটক হয়েছে সেগুলো বাবর সাহেবের দখল, নিয়ন্ত্রণ থেকে উদ্ধার হয়নি। এ ঘটনা তিনি পূর্ব থেকে অবগত ছিলেন না। রাষ্ট্রপক্ষও এ ধরনের কোন অভিযোগ তার বিরুদ্ধে প্রমাণ করতে পারেননি। আমি মনে করি, বাবর সাহেব দু’টি মামলাতেই বেকসুর খালাস পাওয়ার যোগ্য।

ডিজিএফআই’র সাবেক পরিচালক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরীর আইনজীবী সাবেক পিপি কামরুল ইসলাম সাজ্জাদ বাংলানিউজকে বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ যে ৫৬ জন সাক্ষীকে আদালতে উপস্থাপন করেছেন, তাদের মধ্যে একজন সাক্ষীও প্রসিকিউশনের বক্তব্য সমর্থন করেননি। এতে আমরা আশা করছি, সব আসামীই বেকসুর খালাস পাবেন।

আসামী সিইউএফএল’র সাবেক এমডি মোহসীন উদ্দিন তালুকদারের আইনজীবী ফজলুর রহমান ভূঁইয়া বাংলানিউজকে বলেন, আসামী মোহসিন উদ্দিন পরিস্থিতির শিকার। সাক্ষ্যপ্রমাণে প্রতীয়মান হয়েছে, তিনি ঘটনার সঙ্গে কোনভাবেই জড়িত নন। আশা করছি, তাকে খালাস দেয়ার মধ্য দিয়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হবে।

বাংলাদেশ সময়: ০৭২৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩০, ২০১৪

দশ ট্রাক অস্ত্র মামলার রায় বৃহস্পতিবার

দশ ট্রাক অস্ত্র মামলা-৪
তদন্তে-যুক্তিতে এসেছে উলফা’র জন্য অস্ত্র আনার কথা

দশ ট্রাক অস্ত্র মামলা-৩
তদন্তে-সাক্ষ্যে এসেছে গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ততার কথা

দশ ট্রাক অস্ত্র মামলা-২
যেভাবে মামলায় জড়ালেন নিজামী-বাবর

দশ ট্রাক অস্ত্র মামলা-১

কোন জাহাজে এসেছিল, তদন্তে-সাক্ষ্যে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
welcome-ad