ঢাকা, শুক্রবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

শেখ হাসিনার গাড়িবহরে হামলার ২৬ বছর

রমেন দাশগুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৩০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৩, ২০১৪
শেখ হাসিনার গাড়িবহরে হামলার ২৬ বছর

চট্টগ্রাম: ঘটনার ২৬ বছর পূর্ণ হচ্ছে আগামীকাল শুক্রবার। এরপর থেকে দু’দফায় সরকারের মেয়াদ পার করে এখন তৃতীয় দফায় ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ।

কিন্তু ইতিহাসের নৃশংসতম ঘটনা চট্টগ্রামের সেই গণহত্যার কোন বিচার করতে পারেনি আওয়ামী লীগ।

স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের সময় ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার গাড়িবহরে  নিরস্ত্র জনতার উপর পুলিশ এলোপাতাড়ি গুলি চালালে সৃষ্টি হয় কলংকজনক এ ইতিহাস।
নিহত হয় ২৪ জন, আহত হন কমপক্ষে দু’শতাধিক মানুষ।

আহত-নিহতদের মধ্যে ছিল ছাত্র, শ্রমিক, পেশাজীবী এবং সাধারণ জনতা। ইতিহাসের এই নির্মম হত্যাকান্ডে নিহত হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান নির্বিশেষে সকলকে সেদিন নগরীর অভয়মিত্র মহাশ্মশানে পুড়িয়ে ফেলা হয়। পুলিশের কড়া প্রহরার মধ্যে শ্মশানের ডোমদের নিহতদের পুড়য়ে ফেলতে বাধ্য করা হয়।

অভিযোগ উঠেছে, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেও মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তিতে কোন আগ্রহ নেই। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের অবহেলায় গত পাঁচ বছরে হাতেগোণা কয়েকজনের সাক্ষ্যগ্রহণ ছাড়া মামলার আর কোন অগ্রগতি হয়নি। মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য কোন আগ্রহই দেখাননি রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা।

বর্তমানে মামলাটি চট্টগ্রামের প্রথম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন আছে।

ওই আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট অশোক কুমার দাশ বাংলানিউজকে বলেন, ১৬৮জন সাক্ষীর মধ্যে এ পর্যন্ত ৩৭ জন প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন। আগামী ১১ মার্চ আবারও সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য আছে। মামলাটির বিচার এখন নিষ্পত্তির দিকে।

রাষ্ট্রপক্ষের অবহেলার অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রপক্ষ আন্তরিক। কিন্তু আমরা আইনের উপর হস্তক্ষেপ করতে চায়না। না হলে, এতদিনের মামলার রায় হয়ে যেত। ’

২৪ জানুয়ারির ঘটনা নিয়ে ‘চট্টগ্রাম গণহত্যা: প্রত্যদর্শীর জবানবন্দি’ নামে একটি বই লিখেছেন চট্টগ্রামের সাংবাদিক নিরুপম দাশগুপ্ত।

নৃশংস এ ঘটনা ও বিচার প্রক্রিয়া সম্পর্কে নিরুপম দাশগুপ্ত বলেন, সেদিনের হত্যাযজ্ঞ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে বারুদ ঢেলেছিল। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র, পতন হয় স্বৈরাচারের। এ ধরনের চাঞ্চল্যকর একটি ঘটনার ২৬ বছরেও বিচার না হওয়া দু:খজনক, হতাশাজনক এবং অপরাধকে প্রশ্রয় দেয়ার নামান্তর।

তিনি বলেন, সরকারের বিশেষত আওয়ামী লীগের যথাযথ নজরদারি ও আন্তরিক মনোভাব থাকলে অনেক আগেই মামলাটির বিচারকাজ শেষ হয়ে যেত। সময়মত বিচার না পাওয়ায় স্বজন হারানোরা বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারাচ্ছেন।

`চট্টগ্রাম গণহত্যা: প্রত্যদর্শীর জবানবন্দি` শীর্ষক বইটিতে প্রত্যক্ষদর্শী বিভিন্নজনের বক্তব্যে ফুটে উঠেছে সেদিনের ভয়াবহ পরিস্থিতি, যে বইটি ইতোমধ্যে নিষ্ঠুর ওই গণহত্যার প্রামাণ্য দলিল হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনামতে, ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি বিকেলে চট্টগ্রাম শহরের লালদীঘি ময়দানে তৎকালীন ৮ দলীয় ঐক্যজোটের একটি পূর্ব নির্ধারিত সমাবেশ ছিল। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে আওয়ামীলীগ সভানেত্রী ও বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিত থাকার কথা ছিল।

কেন্দ্রীয় নেতাদের নিয়ে শেখ হাসিনা ওইদিন সকাল ৮টা ৩৫ মিনিটে ঢাকা থেকে বিমানযোগে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে আসেন। এরপর দুপুর ১টার দিকে কয়েক হাজার মানুষের মিছিল নিয়ে শেখ হাসিনার গাড়ীর বহর নগরীর কোতোয়ালী থানার কাছে পুরাতন বাংলাদেশ ব্যাংক ভবনের সামনের সড়ক অতিক্রমকালে পুলিশ নির্বিচারে নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের ওপর হামলে পড়ে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই এলোপাতাড়ি চালাতে থাকে গুলি, টিয়ারগ্যাস। সাথে বেপরোয়া লাঠিচার্জ।

সমাবেশে যোগদানের আগে শেখ হাসিনার সাথে আইনজীবী ভবনে চট্টগ্রাম পেশাজীবী সংগ্রাম পরিষদের মতবিনিময়ের কথা ছিল। জনতা মানব জাল তৈরী করে শেখ হাসিনাকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে সেদিন রক্ষা করে আইনজীবী ভবনে নিয়ে যান।

সেদিন আওয়ামীলীগ সভানেত্রীর সঙ্গে ছিলেন প্রয়াত অধ্যাপক পুলিন দে, সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, আমির হোসেন আমু, প্রয়াত আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমদ, আব্দুল জলিল, প্রয়াত সাইফুদ্দিন আহমদ মানিক, পঙ্কজ ভট্টাচার্য, দিলীপ বড়ুয়া, মোস্তফা মহসিন মন্টু, প্রয়াত আতাউর রহমান খান কায়সার, প্রয়াত এম এ মান্নান, প্রয়াত আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনসহ আরও অনেক কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতা।

২০০৪ সালের ৮ আগস্ট আইনজীবী ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুল আদালতে এ মামলায় সাক্ষ্য দেন।

সাক্ষ্যে তিনি বলেন, `আমরা দল বেঁধে আদালত ভবন থেকে রেজিস্ট্রি ভবনের সামনে পৌঁছার পর দেখি হিংস্র পুলিশের আক্রমণে অসংখ্য মানুষ হতাহত হয়ে পড়ে আছে। সাধারণ মানুষ প্রাণরক্ষা ও নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে পাগলের মত ছোটাছুটি করছে। চারপাশ খোলা, সামিয়ানা খাটানো একটা ট্রাকে দলীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে শেখ হাসিনা দাঁড়িয়ে আছেন এবং হ্যান্ডমাইকে পুলিশ বাহিনীকে লক্ষ্য করে বারবার বলে চলেছেন-আমি বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বলছি, আপনারা নিরস্ত্র জনতার উপর গুলি চালাবেন না। `

২০০০ সালের ২১ মে অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত`র (বর্তমানে মানবতা বিরোধী আর্ন্তজাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর) কাছ থেকে নেয়া একটি সাক্ষাৎকার ছাপানো হয় বইটির ২৮ থেকে ৩২ পৃষ্ঠায়।

লৌমহর্ষক এ ঘটনার বর্ণনা দিয়ে রানা দাশগুপ্ত জানান, পুলিশের অন্যায় গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে কয়েকজন আইনজীবী শ্লোগান দিতে দিতে আদালত ভবন থেকে নেমে যান। আইনজীবীদের মধ্যে ছিলেন, অ্যাডভোকেট ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুল, স্বপন চক্রবর্তী (বর্তমানে আমেরিকায় বসবাসরত), মাজেদুল হক, শামসুল ইসলাম, সব্যসাচী দত্ত ও অ্যাডভোকেট শহীদুল হুদা (পরবর্তীতে মামলার বাদি)।

তিনি বলেন, `চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে টেলিফোন করে জানা গেল, গুলিবিদ্ধ বহু লাশ ও আহত ব্যক্তিকে এ হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছে এবং আরও অনেক মৃতদেহ ও আহত মানুষ শহরের বিভিন্ন স্থানে তখনও পড়ে আছে। এ নিদারুণ মর্মান্তিক সংবাদটি এরশাদবিরোধী আন্দোলনের আরেক অগ্রনেত্রী, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে জানিয়ে দেয়ার জন্য শেখ হাসিনা সাথে থাকা একজনকে নির্দেশ দেন। `

আদালত সূত্র জানায়, ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর এরশাদ সরকারের পতন হলে ৯২ সালের ৫ মার্চ ক্ষতিগ্রস্তদের পক্ষ থেকে প্রয়াত আইনজীবী শহীদুল হুদা বাদি হয়ে চট্টগ্রাম মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় হত্যাকান্ডের সময় চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ (সিএমপি) কমিশনারের দায়িত্বে থাকা মীর্জা রকিবুল হুদাকে প্রধান আসামি করা হয়। মামলার আসামিরা সরকারি কর্মচারি হওয়ায় এবং মামলা চালানোর জন্য সরকারের অনুমতি না মেলায় আদালত মামলাটি ওই সময় খারিজ করে দেয়। পরবর্তীতে বাদিপক্ষ উচ্চ আদালতে রিভিশন মামলা দায়ের করলে মামলাটি তদন্তপূর্বক প্রতিবেদন দাখিলের জন্য সিআইডি’র ওপর দায়িত্ব পড়ে।
 
মূলত ১৯৯৬ সালে আওয়ামীলীগ সরকার গঠন করলে বহুল আলোচিত এই হত্যা মামলাটি পুনরুজ্জীবিত হয়। আদালতের নির্দেশে সিআইডি দীর্ঘ তদন্ত শেষে প্রথম দফায় ১৯৯৭ সালের ১২ জানুয়ারি সিএমপির তৎকালীন কমিশনার মীর্জা রকিবুল হুদাকে এবং পরবর্তীতে ১৯৯৮ সালের ৩ নভেম্বর দ্বিতীয় দফায় অধিকতর তদন্তের মাধ্যমে মীর্জা রকিবুল হুদাসহ ৮ পুলিশ সদস্যকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশীট দাখিল করে। অভিযুক্ত অন্যরা হলেন, কোতোয়ালী জোনের তৎকালীন পেট্রল ইন্সপেক্টর (পিআই) জে.সি. মন্ডল, পুলিশ কনস্টেবল আব্দুস সালাম, মুশফিকুর রহমান, প্রদীপ বড়ুয়া, বশির উদ্দিন, মো: আব্দুলাহ ও মমতাজ উদ্দিন।

আদালতে দু’দফায় আলোচিত এ মামলার চার্জ গঠন (দ্বিতীয় দফায় সংশোধিত আকারে) করা হয়। প্রথম দফায়  ১৯৯৭ সালের ৫ আগষ্ট এবং দ্বিতীয় দফায় ২০০০ সালের ৯ মে ৮ আসামির বিরুদ্ধে দন্ডবিধির ৩০২/২০১/১০৯/৩২৬/৩০৭/১১৪/৩৪ ধারায় অভিযোগ গঠন করা হয়।

উচ্চ আদালতের আদেশে জে.সি. মন্ডল ছাড়া অন্য সবাই জামিনে আছেন। তবে ঘটনার পর থেকে জে.সি. মন্ডল পলাতক আছেন।

এপিপি অ্যাডভোকেট অশোক কুমার দাশ বাংলানিউজকে বলেন, আর দু’একজনের সাক্ষ্য নিয়ে যুক্তিতর্কের তারিখ নির্ধারণের আবেদন জানাব। দ্রুততম সময়ের মধ্যে মামলাটি নিষ্পত্তির চেষ্টা অব্যাহত ‍রাখব।

বাংলাদেশ সময়:২১২৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৩, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।