ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

ছয় আসামীর পক্ষে লিখিত যুক্তি জমা

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮২৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৩, ২০১৪
ছয় আসামীর পক্ষে লিখিত যুক্তি জমা

চট্টগ্রাম: চাঞ্চল্যকর দশ ট্রাক অস্ত্র মামলায় পলাতক ও হাজতে থাকা ছয় আসামির পক্ষে লিখিত যুক্তি জমা দিয়েছেন তাদের আইনজীবীরা। এতে প্রত্যেক আইনজীবী রাষ্ট্রপক্ষ তাদের মক্কেলদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি দাবি করে আসামীদের নির্দোষ দাবি করেছেন।



বৃহস্পতিবার তাদের আইনজীবীরা চট্টগ্রামের স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক এস এম মুজিবুর রহমানের আদালতে এসব লিখিত যুক্তি জমা দেন ছয় আসামীর আইনজীবীরা।

ছয় আসামি হলেন, সিইউএফএলের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহসীন উদ্দিন তালুকদার ও সাবেক মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) কে এম এনামুল হক, এনএসআই’র সাবেক মহাপরিচালক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, সাবেক অতিরিক্ত শিল্প সচিব নুরুল আমিন, এনএসআই’র সাবেক পরিচালক অবসরপ্রাপ্ত উইং কমান্ডার শাহাবুদ্দিন এবং চোরাচালানি হাফিজুর রহমান।
এদের মধ্যে নূরুল আমিন ছাড়া বাকিরা সবাই হাজতে আছেন।

ট্রাইব্যুনালের বেঞ্চ সহকারী মো.ওমর ফুয়াদ বাংলানিউজকে বলেন, ‘বিকেল ৫টা পর্যন্ত ছয়জন আসামীর পক্ষে লিখিত যুক্তি পেয়েছি। সেগুলো আদালতের নজরে আনা হয়েছে। ’

গত ১৩ জানুয়ারি দশ ট্রাক অস্ত্র আটকের ঘটনায় দায়ের হওয়া দুটি মামলার সর্বশেষ শুনানির দিন বিচারক কোন আসামী প্রয়োজন মনে করলে ২৩ জানুয়ারি লিখিতভাবে যুক্তি জমা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এরপর আদালত মামলার রায় ঘোষণার জন্য ৩০ জানুয়ারি দিন ধার্য করেন।

২০০৪ সালের ১ এপ্রিল রাতে রাষ্ট্রায়ত্ত সার কারখানা চিটাগং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেডের (সিইউএফএল) জেটিঘাটে দশ ট্রাক অস্ত্রের চালানটি খালাসের সময় ধরা পড়ে। এমভি শাহ আমান ও এমভি খাজার দান নামে দু’টি ফিশিং ট্রলার থেকে অস্ত্রগুলো খালাসের সময় গোপন সংবাদের ভিত্তিতে পুলিশ গিয়ে সেগুলো আটক করে।

এ ঘটনায় কর্ণফুলী থানার তৎকালীন ওসি আহাদুর রহমান বাদি হয়ে অস্ত্র আইনের ১৯ (ক) ধারায় ও চোরাচালানের অভিযোগে বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৫ (বি) ধারায় পৃথক দু’টি মামলা মামলা দায়ের করেন।

এর মধ্যে অস্ত্র মামলায় ঘাট শ্রমিক, পরিবহন শ্রমিক, ট্রলারের সারেং, স্থানীয় ইউপি সদস্যসহ ৪৩ জনকে আসামী করা হয়। চোরাচালান মামলায় আসামী করা হয় ৪৫ জনকে।

দু’টি মামলা তদন্তের দায়িত্ব নিজেই নেন ওসি আহাদুর রহমান। পরবর্তীতে বাদি ও তদন্তকারী কর্মকর্তা একই ব্যক্তি নিয়ে সমালোচনা সৃষ্টি হলে  তদন্তভার ন্যস্ত হয় সিআইডির কাছে। ২৬ এপ্রিল তদন্তভার নেন সিআইডির এএসপি কবির উদ্দিন।

দু’মাস তদন্তের পর ২০০৪ সালের ১১ জুন সিআইডির এএসপি কবির উদ্দিন অস্ত্র আটক মামলায় ৪৫ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেন। একই বছরের ৯ নভেম্বর সিআইডির এএসপি নওশের আলী খান চোরচালান মামলায় ৪৩ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেন।

কিন্তু তৎকালীন মহানগর পিপি আব্দুস সাত্তার অস্ত্র আটক মামলার অভিযোগপত্রের উপর নারাজি দেন। তার যুক্তি, ট্রাকগুলো যে পরিবহন কোম্পানি থেকে ভাড়া করা হয়েছিল তার মালিককে আসামী কিংবা সাক্ষী করা হয়নি। এছাড়া অস্ত্র খালাসের সঙ্গে আবুল হোসেন নামে একজনের সম্পৃক্ততার বিষয় প্রকাশ পেয়েছিল। তার বিষয়েও কোন তদন্ত হয়নি।

আব্দুস সাত্তারের আবেদনের প্রেক্ষিতে সিআইডির এএসপি নওশের আলী খান পুন:তদন্ত করে অস্ত্র আটক মামলায় ২০০৪ সালের ২৫ আগস্ট আরও এক দফা অভিযোগপত্র দেন। কিন্তু তাতে আসামীর সংখ্যার কোন পরিবর্তন হয়নি। শুধুমাত্র ট্রাকের মালিক প্রতিষ্ঠান গ্রীণওয়েজ ট্রান্সপোর্টের মালিক হাবিবুর রহমানকে সাক্ষী করা হয়।

এরপর ২০০৫ সালের ২৩ এপ্রিল অস্ত্র আটক মামলায় এবং ২০০৪ সালের ৩০ নভেম্বর চোরাচালান মামলায় আসামীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়।

২০০৫ সালের ৬ জুলাই দু’মামলায় বাদি আহাদুর রহমান প্রথম সাক্ষ্য দেন। ২০০৭ সালের ১৪ আগস্ট পর্যন্ত সাক্ষ্যগ্রহণ চলে। তখন পর্যন্ত অস্ত্র আটক মামলায় ৩১ জন এবং চোরাচালান মামলায় ২৮ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দেন।

সেনাসমর্থিত তত্তাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালের ২০ নভেম্বর রাষ্ট্রপক্ষের তৎকালীন কৌসুলী ও অতিরিক্ত মহানগর পিপি হুমায়ন কবির রাসেল মামলার অধিকতর তদন্তের আবেদন করেন। সেই আবেদনের প্রেক্ষিতে অস্ত্রের চালানের উৎস, গন্তব্যসহ সাতটি পর্যবেকক্ষণসহ আদালত অধিকতর তদন্তের আদেশ দেন।

সিআইডির এএসপি ইসমাইল হোসেন প্রথম দফা অধিকতর তদন্তের দায়িত্ব পেলেও তিনি তদন্ত শেষের আগেই বিদায় নেন। পরে সিআইডি’র চট্টগ্রাম অঞ্চলের সিনিয়র এএসপি মনিরুজ্জামান চৌধুরী ২০০৯ সালের ২৯ জানুয়ারি তদন্তভার গ্রহণ করেন। মনিরুজ্জামানের তদন্তে বেরিয়ে আসতে থাকে ঘটনার সঙ্গে জড়িত রাঘববোয়ালদের নাম।
 
অধিকতর তদন্ত শেষে ২০১১ সালের ২৬ জুন দু’টি মামলায় সম্পূরক অভিযোগপত্র জমা দেন তদন্তকারী কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান।

দুই মামলায় নতুনভাবে ১১ জনকে আসামী করা হয় এবং উভয় মামলাতে পৃথকভাবে ২৬৫ জনকে সাক্ষী করা হয়। সাক্ষীদের মধ্যে ২০ জন ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।

নতুনভাবে দু’মামলায় অর্ন্তভুক্ত হওয়া আসামীরা হলেন, জামায়াতে ইসলামীর আমীর ও সাবেক শিল্পমন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী, বিএনপিনেতা সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক ভারপ্রাপ্ত শিল্প সচিব নুরুল আমিন, উলফানেতা পরেশ বড়–য়া, এনএসআই’র সাবেক দুই প্রধান অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী ও অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুর রহিম, সাবেক পরিচালক অবসরপ্রাপ্ত উইং কমান্ডার শাহাবুদ্দিন, সাবেক উপ-পরিচালক অবসরপ্রাপ্ত মেজর লিয়াকত হোসেন, সাবেক মাঠ কর্মকর্তা আকবর হোসেন, সিইউএফএল এর সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহসিন উদ্দিন তালুকদার এবং সাবেক জিএম (প্রশাসন) এনামুল হক।  
 
নতুন ১১ জনসহ অস্ত্র আইনের মামলায় আসামীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৫৪ জনে এবং চোরাচালান মামলায় আসামী হয় ৫২ জন। কিন্তু উভয় মামলায় আসামী হিসেবে থাকা চারজনের ইতোমধ্যে মৃত্যু হয়। এর ফলে শেষ পর্যন্ত অস্ত্র মামলায় ৫০ জন এবং চোরাচালান মামলায় আসামীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৫২ জনে।

মৃত্যুবরণ করা চার আসামী হলেন, ইয়াকুব আলী, মুনির আহমেদ, আতাউর রহমান ও আবুল কাশেম মধু।

২০১১ সালের ১৫ নভেম্বর চট্টগ্রামের স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক এস এম মুজিবুর রহমান দু’টি মামলার আসামীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। ২৯ নভেম্বর থেকে দু’মামলায় একযোগে পুনরায় সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়।

টানা দু’বছর ধরে সাক্ষ্যগ্রহণের পর ২০১৩ সালের ১০ অক্টোবর তদন্তকারী কর্মকর্তা মনিরুজ্জামানের জেরা শেষ হওয়ার মধ্য দিয়ে সাক্ষ্যগ্রহণ সমাপ্ত ঘোষণা করেন আদালত। অস্ত্র মামলায় মোট ৫৬ জন এবং চোরচালান মামলায় মোট ৫৩ সাক্ষী সাক্ষ্য দেন। এর মধ্যে অধিকতর তদন্তের আগে অস্ত্র মামলায় সাক্ষ্য দেন ৩১ জন এবং চোরাচালান মামলায় সাক্ষ্য দেন ২৮ জন। দু’টি মামলায় পাঁচজন দু’দফা সাক্ষ্য দেন।

বর্তমানে অস্ত্র আটক মামলায় ২৯ জন আসামী জামিনে, ১০ জন হাজতে এবং উলফা নেতা পরেশ বড়–য়া ও সাবেক ভারপ্রাপ্ত শিল্প সচিব নুরুল আমিনসহ ১২ জন পলাতক আছেন। পলাতক অন্যান্যরা হলেন, প্রদীপ কুমার দাশ, নূরনবী, সিরাজুল ইসলাম, হেলাল উদ্দিন, বাবুল মিয়া, আব্দুর রহিম মাঝি, আব্দুস সবুর, মো.শাহআলম, মো.সোবহান ও শাহজাহান।

চোরাচালান মামলায় ১১ জন হাজতে, ২৮ জন জামিনে এবং ১৩ জন আসামী পলাতক আছেন। অস্ত্র মামলায় পলাতক ১২ জন ছাড়া এ মামলায় আবুল হোসেন নামে আরও একজন পলাতক আছেন।

তবে অভিযোগপত্রে উল্লেখ থাকা ওই আবুল হোসেন এনএসআই’র সাবেক উপ-পরিচালক অবসরপ্রাপ্ত মেজর লিয়াকত বলে শনাক্ত করেছেন মামলার দু’জন সাক্ষী যারা অস্ত্র আটকের সময় সিইউএফএল অবস্থান করছিলেন।

সাক্ষ্য দিয়েছেন যারা
বাদি আহাদুর রহমান, হাবিলদার গোলাম রসুল, নূর আলম সওদাগর, সার্জেণ্ট মিজানুর রহমান, সুনিল কুমার সেন, কনস্টেবল ইউসুফ আলী, কনস্টেবল মোজাম্মেল হক, জয়নাল আবেদিন, সার্জেণ্ট আলাউদ্দিন ও হেলাল উদ্দিন, সিইউএফএল’র সাবেক প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা মোবিন হোসেন খান, সিইউএফএল’র সাবেক এমডি মহসিন উদ্দিন তালুকদার (বর্তমানে আসামী), চৌকিদার আহমেদ নূর, গোলাম মোরশেদ খান, ওমর ফারুক, নাজিমউদ্দিন, আব্দুল গফুর, মুরাদুজ্জামান, মো.সেকান্দর, আনসার সদস্য কাজী আবু তৈয়ব, মনসুর আলী ও কাইয়ূম বাদশা, সোলাইমান, শাহজাহান, ইসমাইল, আব্দুল কুদ্দুস, এনামুল হক, মো.লোকমান, আব্দুল মতিন মিয়া, মাশরুকুর রহমান, তছলিম উদ্দিন, শেখ আহাম্মদ, সাবেক পুলিশ সুপার মাহমুদুর রহমান, সাবেক শিল্প সচিব ড.শোয়েব আহমেদ, বিসিআইসি’র সাবেক চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল ইমামুজ্জামান বীরবিক্রম, গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএইফআই’র সাবেক মহাপরিচালক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল সাদিক হাসান রুমি, এনএসআই’র সাবেক পরিচালক অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এনামুর রহমান চৌধুরী, ডিজিএফআই’র সাবেক ডিটাচমেন্ট কমান্ডার অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল একেএম রেজাউর রহমান, এনএসআই’র সাবেক সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ আলী, সিএমপির বন্দর জোনের তৎকালীন উপ-পুলিশ কমিশনার আবদুল্লাহ হেল বাকী, সাবেক পুলিশ কমিশনার এস এম সাব্বির আলী, সাবেক স্বরাষ্ট্র সচিব ওমর ফারুক, সাবেক ডিআইজি (এসবি) শামসুল ইসলাম, সাবেক ডিআইজি (সিআইডি) ফররুখ আহমেদ, গ্রীণওয়েজ ট্রান্সপোর্টের মালিক হাবিবুর রহমান, সাবেক মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মুনতাসির আহমেদ, আবু হান্নান, ওসমান গণি, কিরণ চন্দ্র রায় ও মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান এবং মো.গোলাম মোস্তফা, একেএম মহিউদ্দিন চৌধুরী, মোহাম্মদ আব্দুস সালাম খান, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হাসান মাহমুদ তাইয়েবুর রহমান এবং তদন্তকারী কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান চৌধুরী।

বাংলাদেশ সময়: ১৮২৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৩, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।